অপসংস্কৃতির নির্মূলে মহানবী (সা.)
সকালের সূর্যের নবকিরণের ছোঁয়ায় গোটা সাগরের বুকজোড়ে এক বিস্ময়কর ঝিলিমিলি খেলা শুরু হয়। আর সন্ধ্যায় সূর্য যখন তার প্রতাপ হারিয়ে ম্লিয়মান মুখে দিগন্তে পৌঁছে, ‘আল বিদা’ ‘আল বিদা’ বলতে থাকে, তখন মাগরিব বুকে রক্তিম রঙ্গের ছড়াছড়িতে মন উতলা হয়ে উঠে। বৈচিত্র্যময় পাখিরা তখন আনন্দ কলরব তুলে ডানা মেলে উড়ে যায় নীড়ের সন্ধানে। প্রকৃতির এ মোহময় ধারা চলে আসছে আদিকাল থেকে। মহা প্রলয়ের দিন পর্যন্ত তা চলতে থাকবে।
এ প্রকৃতির পরিবর্তনের পেছনে এক সত্যশক্তি রয়েছে, যিনি সমগ্র সৃষ্টিকুলকে সৃজন করে ক্ষয়-অক্ষয়, ভাল-মন্দ, সংস্কৃতি-অসংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞাত করণার্থে এ ধরাপৃষ্ঠে হাজার হাজার আম্বিয়ায়ে কেরাম প্রেরণ করে নগ্ন-পতিত সমাজকে সংস্কার করেছেন বহুবার। এবং তিনিই নির্ধারণ করেছেন সামাজিক বিধি-নিষেধ ও সমাজচ্যুত্ত ব্যক্তির দণ্ডবিধি।
তারা আখেরাতের প্রতি মানবজাতীকে অনুপ্রাণিত করেছেন, তাই নয়। বরং পৃথিবী হতে অপসংস্কৃতি দূরিভূত করে মানব সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ধরাপৃষ্ঠ হতে সমস্ত ফেতনা আর চরিত্রহীনের অতল গহ্বর থেকে মুক্তির দিক নির্দেশনা দেখায়েছেন। এদের মধ্যে মহান রাব্বুল ইজ্জত সবচেয়ে ভালোবাসার পাত্ররূপে প্রেরণ করলেন সমগ্র মানবজাতির শিরোমণি বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে।
তিনি অপরাধ ও দুর্নীতি দমনে অত্যন্ত স্পষ্ট, তুলনাহীন শিক্ষা নির্দেশনা উম্মতকে দান করেছেন এবং এসব অপকর্মের দুনিয়াবী ক্ষতি ও আখেরাতের আযাবের ব্যাপারে সাবধান করেছেন। তিনি সমাজে এমন একটি নীতি চালু করে গিয়েছেন যার আলোকে অপরাধী ব্যক্তি তার অপরাধ থেকে মুক্তি পাবে এবং মাবনজাতির অপরাধে মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারে, নিজেকে এর থেকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে পারে। শুধু তাই নয় বরং এজন্য সস্পষ্ট বিধানও কায়েম করে গিয়েছেন।
নিম্নে কতিপয় বিধানের অতি সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো-
তরুণ-তরুণীর অবাধ মিলা-মিশা নির্মূলে:
আল্লাহর বাণী; হে নারী জাতি! তোমরা তোমাদের ঘরে অবস্থানরত থাক। তোমরা জাহিলি যুগের নারীদের ন্যায় বাইরে ঘুরাফেরা করো না। (সূরা আহযাব: ৩৩)
ব্যভিচার ও চুরি নির্মূলে:
ব্যভিচারের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঙ্কর মেরে হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে জাতিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখিয়ে দিয়েছিলেন এবং দশ দেরহাম পরিমাণ কিছু চুরি করলেও তার হস্তকে কর্তন করে জাতিকে এর থেকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
সমাজ থেকে মুনাফেকী, চোগলখুরী, মিথ্যাবাদিতা এবং অন্যায়ভাবে হত্যা মূলোৎপাটনে:
আল্লাহ তায়ালা বলেন: মুনাফেকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে। (সূরা নিসা : ১৪৫) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: চোগলখুরেরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (বুখারী ও মুসলিম) তিনি আরো বলেন: মিথ্যা বলা মহাপাপ। (বুখারী) এবং অন্যায়ভাবে হত্যার প্রথাকে দমন করার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তায়ালার এ বিধান জারি করলেন। হে মুমিনগণ! তোমার উপর কেসাস ফরয করা হয়েছে নিহত ব্যক্তির ব্যাপারে। (সূরা: বাকারা ১৭৮)
সমাজ থেকে যৌতুক নামী ব্যাধি নির্মূলে:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সকল প্রকার অপরাধ থেকে উম্মতকে বারণ করেছেন এর মধ্যে অন্যতম হলো যৌতুক প্রথা। এর জন্য হিলফুল ফুযুল নামে প্রতিরোধমূলক একটি সংগঠন তৈরী করেন। সাথে সাথে সমাজ যখন দুষিত ও অপসংস্কৃতিময় কালচারে ডুবুডুবু তখন এর প্রতিকার কি হবে? ঈমানদারদের কি করতে হবে এর বিস্তারিত আলোচনা উম্মতের মাঝে উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন: তোমাদের মধ্যে যদি কেউ কোন অন্যায় কাজ দেখে, তবে সে যেন (সামর্থ থাকলে) তাতে হস্তক্ষেপ করে তা বন্ধ করে দেয়, আর যদি তা না পারে, তবে মুখে নিষেধ করে দেয়, আর যদি তাও করতে সক্ষম না হয় তবে যেন অন্তরে সেই অন্যায় কাজের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে, আর এটাই ঈমানের দুর্বলতর স্তর। (মুসলিম)
তিনি একজন দরদী অভিবাবক ও শিক্ষক হিসেবে এবং সমাজের রোগ সম্পর্কে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মত একটি আদর্শ সমাজে মূল চালিকাশক্তি নির্ণয় করলেন, কেননা মূল চালিকাশক্তি ঠিক থাকলে সমাজ নামক এ কারখানাটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে এবং অপসংস্কৃতির সয়লাব থেকে নিজের ব্যক্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে।
তাছাড়া সমাজে অন্যায় অপরাধ দমন করতে হলে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে হলে সমাজে ভাল মানুষের সংখ্যাধিক্য সৃষ্টি করা জরুরি। সেই ভালো মানুষের হৃদয়ের বীজতলাকে সৎকাজের উপযোগী করে প্রস্তুত করার জন্য সেখানে আল্লাহর ভয়ের চাষ দেওয়া আবশ্যক। কেননা যদি মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর ভয় না থাকে তবে তাকে অন্যায়-অপরাধ ও পাপাচার থেকে কোন আইন কানুনই বিরত রাখতে পারবে না। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা বলেন; তোমরা আল্লাহকে যথাযাথভাবে ভয় কর, তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা আলে ইমরান: ১০২)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার প্রতিপালক আমাকে নয়টি বিষয়ের নির্দেষ দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি হলো, গোপনে ও প্রকাশ্যে সর্বাবস্থায় আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো। (মিশকাতুল মাসাবীহ, রযীন)
আর মানুষ আল্লাহ তায়ালাকে ভয় না করার মূল কারণ হচ্ছে দুনিয়ার প্রতি মোহ, ভালোবাসা। যার কারণে মানুষের মৃত্যুর কথা স্মরণ থাকে না। কবর, জান্নাত ও জাহান্নামের কথা ভুলে যায়।
এর প্রতিবাদে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: দুনিয়ার মোহই সকল গোনাহের মূল। (বায়হাকী ও রযীন) তিনি আরো বলেন: তুমি দুনিয়াতে এমনভাবে বসবাস করো যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথিক এবং তুমি নিজেকে কবরবাসীদের মধ্যে গণ্য করো। (বুখারী, আহমদ, ইবনে মাযা, তিরমিযী) তিনি আরো বলেন: মৃত্যুর স্মরণ মানুষের জন্য উপদেশ দাতা হিসেবে যথেষ্ট এবং পরকালের হিসাব-নিকাশের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস দুনিয়ার প্রতি নির্মোহতা সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। (বায়হাকী, মুসনাদ)
অতএব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শবাণীকে যারাই শক্তভাবে আঁকড়ে ধরতে পেরেছে, তারাই মূলত আখেরাতের পাথেয় পরিপূর্ণভাবে অর্জন করতে পেরেছেন। এমনকি দুনিয়াতেই জান্নাতের সার্টিফিকেট অর্জন করতে পেরেছেন।
অবশেষে আরজ করছি, আমরাও যেন তাদের মত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শকে আঁকড়ে ধরে দেশ ও দশকে অপসংস্কৃতির কালো থাবা থেকে মুক্তি দিতে পারি এবং দুষিত সমাজকে সুসিত করতে পারি। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন।