ইবাদতের তাৎপর্য ইবাদত শব্দের আভিধানিক অর্থ হল- চূড়ান্ত বিনয়, আনুগত্য ও বশ্যতা বা দাসত্ব। শরী’আতের পরিভাষায়- প্রকাশ্য কিংবা গোপনীয় যতসব কথা ও কাজ আল্লাহ তা’আলা ভালবাসেন ও পছন্দ করেন, এবং যেগুলো করতে আদেশ করেছেন সেগুলোকে পালন করা এবং যা করতে নিধেষ করেছেন তা ছেড়ে দেওয়া, এ সবের একটি সামষ্টিক নাম হল ইবাদত।
তাই যতসব কথাবার্তা ও কাজ-কর্মকে আল্লাহ তা’আলা পছন্দ করেন যেমন- নামায কায়েম করা, রোযা পালন করা, কুরবানী, নযর-মানত প্রদান করা,যাকাত-ছাদক্বা প্রদান করা, আল্লাহর নিকট প্রা দো’আ করা, আল্লাহর উপর ভরসা রাখা, এবং রাসূলের আনুগত্য করা। কুরআনে কারীম তিলাওয়াত করা, কুরআন-সুন্নাহতে বর্ণিত ও নির্দেশিত দো’আ ও যিকর-আযকার করা, রাসূল (সা.) -এর প্রতি ছালাত ও ছালাম পাঠ করা ইত্যাদি – এ সব প্রতিটি কাজ হল একেকটি ইবাদত।
তাই যতসব কথা-বার্তা ও কাজ-কর্মকে আল্লাহ অনুসৃত ও রাসূল (সা.) প্রদর্শিত পন্থানুযায়ী একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উদ্দেশ্যে তাঁরই সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্তে তাঁরপ্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ ভয় ও সর্বোচ্চ ভালোবাসা নিয়ে, তাঁর প্রতি পূর্ণ বশ্যতা ও আনুগত্য প্রদর্শণ পূর্বক তাঁর মহত্বের সম্মুখে অবনত মস্তকে চূড়ান্ত বিনয়ের সাথে ছওয়াবের (আল্লাহর নিকট উত্তম প্রতিদান লাভের) আগ্রহ ও সুদৃঢ় আশা নিয়ে উপরিউক্ত যে কোন কর্ম সম্পাদন করাকে আল্লাহর ইবাদত বলে।
ইবাদতের রোকনসমূহ: ইবাদতের রোকন তিনটি
১। ইখলাস: বান্দা যখনই যে কোনো ইবাদত করবে, তার নিয়তকে বিশুদ্ধ করতে হবে, যে আমি এই আমলটি করছি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য এবং পরকালে এর প্রতিদান পাবার আশায়। রাসূলে কারীম (সা.) এরশাদ করেন:
عَنْ أَمِيرِ الْمُؤْمِنِينَ أَبِي حَفْصٍ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ – رضي الله عنه – قَالَ: سَمِعْت رَسُولَ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم يَقُولُ: “إنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ، وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ لِدُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا فَهِجْرَتُهُ إلَى مَا هَاجَرَ إلَيْهِ . الْبُخَارِيُّ مُسْلِمٌ
উমার রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, “আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, ‘‘যাবতীয় কার্য নিয়ত বা সংকল্পের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষের জন্য তাই প্রাপ্য হবে, যার সে নিয়ত করবে। অতএব যে ব্যক্তির হিজরত (সবদেশত্যাগ) আল্লাহর (সন্তোষ লাভের) উদ্দেশ্যে ও তাঁর রাসূলের জন্য হবে; তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্যই হবে। আর যে ব্যক্তির হিজরত পার্থিব সম্পদ অর্জন কিংবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যেই হবে, তার হিজরত যে সংকল্প নিয়ে করবে তারই জন্য হবে।
২। সততা: সততার সাথে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধগুলো পালন করতে হবে। আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে ভীরুতা ও অলসতা ছেড়ে দিয়ে সাহসিকতার পালন করতে হবে।
৩। রাসূলের আনুগত্য করা: কোন ইবাদতই রাসূলের আনুগত্য ছাড়া আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। রাসূলের তরীকা ছাড়া যে ইবাদত হবে, তা বিদআত হিসেবে গণ্য হবে।
সম্মানিত পাঠক! প্রত্যেক নবী রাসূলের প্রথম কাজ ছিলো, তার কাওম বা জাতীকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে দাওয়াত প্রদান করা। আল্লাহ তায়ালা বলছেন:
لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَىٰ قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـٰهٍ غَيْرُهُ
নিশ্চয় আমি নূহকে তার সম্প্রদায়ের প্রতি পাঠিয়েছি। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই। (সূরা আ‘রাফ: ৫৯)
يَقولُ جَلَّ شَأنُهُ: وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلاَّ نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلاَّ أَنَا فَاعْبُدُونِ
আপনার পূর্বে আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি,তাকে এ আদেশই প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। সুতরাং আমারই এবাদত কর। (সূরা আম্বিয়া: ২৫)
ইবাদত শব্দটির মূল ধাতু হচ্ছে; আবদ। অর্থ আরাধনা করা বা উপাসনা করা।
আবদ এর বহুবচন ইবাদ । ‘আবদ’ শব্দটির মূল অর্থ গোলামী ও দাসত্ব করা। আর যে দাসত্ব ও গোলামী করে সে হচ্ছে ‘আবিদ’। আর দসত্বকে বলা হল ইবাদত। অর্থাৎ আবদ হচ্ছে দাস বা গোলাম। আল্লাহ তাঁর অনুগতদের ‘আবদ’ বলে সম্বোধন করতে ভালবাসেন। কুরআন মজীদে যত জায়গায় ‘আবদ’ ও ‘ইবাদ’ শব্দটির ব্যবহার হয়েছে সকল জায়গাতেই আল্লাহর ভালবাসার সুস্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠেছে। তিনি তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাতটি জায়গায় ‘আবদ’ বলে সম্বোধন করেছেন। কোথাও বলেছেন ‘আবদুহু- তাঁর বান্দা’ কোথাও বলেছেন ‘আবদানা- আমার বান্দা’। তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকেই আবদ ও ইবাদ বলে সম্বোধন করেছেন। তিনি মুমিনদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘ইবাদী- আমার বান্দারা।’ কোথাও তিনি তাদেরকে সম্বোধন করেছেন ‘ইয়া ইবাদী’ বলে- মানে ‘হে আমার বান্দারা’।
অর্থাৎ আল্লাহর বিধি-বিধান মেনে চলাটাই একজন বান্দার কাজ। আর খাঁটি বান্দা হতে পারলে তার জন্য জান্নাত নিশ্চিত। মহান আল্লাহ বলছেন: فَادْخُلِي فِي عِبَادِي وَادْخُلِي جَنَّتِي অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।(ফজর: ২৯-৩০)
সম্মানিত পাঠক! ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থাৎ মধ্যমপন্থার জীবন বিধানের নাম, কোন কিছুতে বাড়াবাড়ি নেই এখানে।
সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগী করার জন্য মানবের সৃষ্টি। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করছেন: وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ ﴿٥٦﴾ এমনিভাবে,তাদের পূর্ববর্তীদের কাছে যখনই কোন রসূল আগমন করেছেন,তারা বলছেঃ যাদুকর,না হয় উম্মাদ।
ধরাপৃষ্ঠে মানব ও দানবের আগমন এ উদ্দেশ্যেই। কিন্তু এ ইবাদত করতে যেয়ে আমাদের অনেকে এর নির্ধারিত সীমা ছাড়িয়ে যাই। ভারসাম্য রাখতে পারি না। নিজের শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখি না। ভুলে যাই পরিবার-পরিজন ও অন্যান্য মানুষদের প্রতি আমার দায়িত্ব-কর্তব্য। আমার ইবাদত-বন্দেগী দেখে অন্যরা মনে করে এ যদি হয় ইসলাম,তাহলে আমরা অনেক ভাল আছি। আমাদের ভাগ্য ভাল আমাদের জীবনে ইসলাম আসেনি। (নাউযুবিল্লাহ)
এ বিষয়টি কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে আজকের খুতবায় আলোচনা করা হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
طَهَ ﴿١﴾ مَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقَىٰ ﴿٢﴾ سورة طه
ত্বা-হা। আমি তোমার উপর কুরআন এ জন্য নাযিল করিনি যে তুমি দুঃখ-কষ্ট ভোগ করবে। (সূরা ত্বা-হা: ১-২)
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন:
يُرِيدُ اللهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ البقرة: ١٨٥
আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান এবং কঠিন চান না। (সূরা আল বাকারা: ১৮৫)
আয়াত দু’টো থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআন নাযিল করেছেন, ইসলামকে ধর্ম হিসাবে মনোনীত করেছেন তার অনুসারীদের থেকে দুঃখ কষ্ট দূর করার জন্য। তাদের দুর্ভোগ বা কষ্টে নিপতিত করার জন্য নয়।
দুই. আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার ধর্ম পালনকে কঠিন করতে চান না। তিনি সহজ করতে চান। কাজেই মানুষের উচিত হবে এমন কোন কাজ ও কথা না বলা যাতে ধর্মকে কঠিন মনে হয়। বা অন্য ধর্মের মানুষের কাছে কঠিনভাবে উপস্থাপিত হয়।
তিন. দ্বিতীয় আয়াতটি যদিও নাযিল হয়েছে সফরে রোযা না রাখার অনুমতি সম্পর্কে তবুও এর শিক্ষা সাধারণভাবে সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ * الحج: ٧٨
ধর্মের ব্যাপারে তিনি তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেননি। (সূরা হজ: ৭৮)
مَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُمْ مِنْ حَرَجٍ *المائدة: ٦
আল্লাহ তোমাদের উপর কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে চান না। (সূরা আল মায়েদা:৬)
চার. ইসলাম মধ্যপন্থার ধর্ম। কোন ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা যাবে না,তেমনি ছাড়াছাড়িও করা যায় না। এটাকে বলা হয়, ইফরাত ও তাফরীত। উভয়টাই পরিত্যাজ্য। আর এ মধ্যপন্থার নির্দেশ প্রতিটি ক্ষেত্রেই। যেমন আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় বান্দাদের গুণাবলি উল্লেখ করতে যেয়ে বলেছেন :
وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَٰلِكَ قَوَامًا الفرقان: ٦٧
আর তারা যখন ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না। বরং মাঝামাঝি অবস্থানে থাকে। (সূরা আল ফুরকান: ৬৭)
এমনিভাবে এ মধ্যপন্থা জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনুসরণ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে।
হাদীস
عنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا أَنَّ النَّبِيَّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم دخَلَ عَلَيْهَا وَعِنْدَهَا امْرأَةٌ قَالَ : مَنْ هَذِهِ ؟ قَالَتْ : هَذِهِ فُلَانَةٌ تَذْكُرُ مِنْ صَلاتِهَا قالَ : مَهُ عَلَيْكُمْ بِمَا تُطِيقُون ، فَوَ اللهِ لا يَمَلُّ اللهُ حتَّى تَمَلُّوا وكَانَ أَحَبُّ الدِّينِ إِلَيْهِ مَا دَاوَمَ صَاحِبُهُ علَيْهِ : متفقٌ عليه .
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত,নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ঘরে প্রবেশ করলেন তখন একজন মহিলা তাঁর ঘরে বসা ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন,মেয়েটি কে? আয়েশা বললেন,অমুক মেয়ে। সে তার নামাজ সম্পর্কে আলোচনা করছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,রাখো! তোমরা যা সামর্থ রাখো সেটা তোমাদের দায়িত্বে। আল্লাহ তাআলার শপথ! তোমরা ক্লান্ত হলেও আল্লাহ তাআলা ক্লান্ত হন না। আর তার নিকট অধিক পছন্দনীয় দ্বীন (ইবাদত-বন্দেগী) ছিল,সম্পাদনকারী যা নিয়মিতভাবে সম্পাদন করে। (বুখারী ও মুসলিম)
এই হাদীস থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল :
এক. ইবাদত-বন্দেগী করতে হবে যার যার সামর্থের মধ্যে থেকে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সামর্থের বাইরে কোন কিছু করার জন্য আদেশ দেন না। لَا يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا ۚ
দুই. মানুষ ইবাদত-বন্দেগী অধিক পরিমাণে করতে করতে অনেক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। জীবনের অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ-কর্ম ব্যহত হয়। এ রকম করতে নিষেধ করা হয়েছে।
তিন. মানুষ ইবাদত-বন্দেগী করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা বান্দাদের ইবাদতের বিনিময় প্রদানে কখনো ক্লান্ত হন না।
চার. এক দিন বা একটি রাত সম্পূর্ণ জাগ্রত থেকে শত শত রাকাত নামাজ আদায় করার চেয়ে প্রতিদিন,প্রতি সপ্তাহে বা প্রতি মাসে নিয়মিতভাবে অল্প অল্প আদায় করা উত্তম। সকল ইবাদত বন্দেগীর ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য।
পাঁচ. যদি ঘরে কোন অপরিচিত নারী বা পুরুষ আসে তবে গৃহকর্তার উচিত হবে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা: সে কে? কি বলে? কেন এসেছে? ইত্যাদি। এটা পরিবারের প্রতি যত্নবান হওয়ার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কারণ,ঘরে সাধারণত শিশু ও মেয়েরা বেশি থাকে। অপরিচিত কোন লোক এসে তাদের কোন বিষয়ে বিভ্রান্ত করতেই পারে। পরিবারের কর্তা যদি এটার খোঁজ খবর রাখেন তাহলে অনেক অনাকাঙ্খিত বিষয় এড়িয়ে যাওয়া যায়। আমাদের প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রিসালাতের বিশাল দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি পরিবারের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পূর্ণভাবে পালন করেছেন। তাই আমরা এ হাদীসে দেখলাম,একজন মেয়ে ঘরে আসল,নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। আর আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার সম্পর্কে বর্ণনা দিলেন।
ইবাদতে মধ্যমপন্থা অবলম্বন সম্পর্কে একটি হাদীস:
وَعَنْ أَنسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ : جَاءَ ثَلاثةُ رَهْطٍ إِلَى بُيُوتِ أَزْواجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسْأَلُونَ عَنْ عِبَادَةِ النَّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم، فَلَمَّا أُخْبِرُوْا كأَنَّهُمْ تَقَالَّوْها وَقَالُوا: أَيْنَ نَحْنُ مِنَ النَّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم قَدْ غُفِر لَهُ ما تَقَدَّم مِنْ ذَنْبِهِ وما تَأَخَّرَ، قالَ أَحَدُهُمْ : أَمَّا أَنَا فأُصلِّي الليل أَبداً ، وقال الآخَرُ : وَأَنَا أَصُوْمُ الدَّهْرَ أَبَدًا وَلَا أُفْطِرُ ، وَقَالَ الْآخَرُ: وأَنَا اعْتَزِلُ النِّسَاءَ فَلَا أَتَزوَّجُ أَبَدًا، فَجَاءَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّمَ إلَيْهمْ فَقَالَ : أَنْتُمُ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا ؟، أَمَا واللَّهِ إِنِّي لأَخْشَاكُمْ للَّهِ وَأَتْقَاكُم لَهُ لَكِنِّي أَصُومُ وَأُفْطِرُ ، وَأُصلِّي وَأَرْقُدُ، وَأَتَزَوّجُ النِّسَاءَ، فمنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيسَ مِنِّى : متفقٌ عليه
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, তিনজন লোক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীদের ঘরে আসল। তারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইবাদত-বন্দেগী সম্পর্কে জানতে চাইল। যখন তাদেরকে এ সম্পর্কে জানানো হল, তখন তারা যেন এটাকে অপ্রতুল মনে করল। আর বলল, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথায় আর আমরা কোথায়? তাঁর আগের পরের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। তাদের একজন বলল,আমি সম্পূর্ণ রাত নামাজ পড়তে থাকব। আরেকজন বলল,আমি সারা জীবন রোযা রাখব। কখনো রোযা ছাড়ব না। আরেকজন বলল, আমি মেয়েদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখব,কখনো বিয়ে করব না। ইতোমধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে আসলেন। আর বললেন,তোমরা তো এ রকম সে রকম কথা বলেছ। আল্লাহর কসম! তোমাদের চেয়ে আমি আল্লাহকে বেশি ভয় করি। তাঁর সম্পর্কে বেশি তাকওয়া (সতর্কতা) অবলম্বন করি। কিন্তু আমি রোযা রাখি আবার রোযা ছেড়ে দেই। আমি নামায পড়ি আবার নিদ্রা যাই। আর বিয়ে শাদীও করি। যে আমার আদর্শ (সুন্নাত) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে আমার দলভুক্ত নয়। (বুখারী ও মুসলিম)
হাদীস থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল :
এক. সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইবাদত-বন্দেগীর ধরণ, পদ্ধতি ও পরিমাণ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলেন। আমাদেরও জানার জন্য চেষ্টা করা উচিত। তাদের জানার উদ্দেশ্য ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহর অনুসরণ।
দুই. ইসলামে কোন ধরনের বৈরাগ্যবাদের স্থান নেই। খাওয়া-দাওয়া,ঘুম-নিদ্রা, বিয়ে-শাদী,পরিবার পরিজন ইত্যাদি সবকিছু নিয়েই ইসলামী জীবন। এগুলো বাদ দিয়ে বা এগুলোকে অবজ্ঞা করে যদি কেউ শুধু নামায রোযা হজ্জ ও যাকাতকে ইবাদত-বন্দেগী মনে করে ইসলাম পালন করতে চায় সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতভুক্ত বলে গণ্য হবে না।
তিন. দুনিয়ার সকল কাজ-কর্ম,অন্যের অধিকার আদায় করার সাথে সাথে সাধ্য সামর্থানুযায়ী ইবাদত-বন্দেগী সম্পাদন করার নাম হল মধ্যপন্থা অবলম্বন। এটাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ। তাই দুনিয়াদারী ছেড়ে ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত হওয়া বা ইবাদত-বন্দেগী বাদ দিয়ে দুনিয়ারীতে লিপ্ত হয়ে যাওয়া কখনো মধ্যপন্থা বলে গণ্য হবে না। দু’টোই চরমপন্থা।
চার. নিজেদের প্রতি বাড়াবড়ি করার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যে,সেগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বোঝাই বাড়িয়েছে। যেমন দেখুন,আল কুরআনে সূরা বাকারার ৬৭ আয়াত থেকে ৭১ আয়াত পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাইলের একটি বাড়াবাড়ির বিষয় আলোচনা করেছেন। তাদের বলা হল একটি গাভী জবেহ করতে। কিন্তু তারা প্রশ্ন করতে থাকল, গাভীটি কি ধরনের হবে? তার রং কি রকম হবে? তার বয়স কত হবে ইত্যাদি। পরিণামে তাদের এ বাড়াবাড়ির ফলটা তাদেরই ভোগ করতে হল কঠিন ভাবে।
ইবাদত করার ফলাফল:
১। ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহভীতি পয়দা হয়, এবং আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়: মহান আল্লাহ এরশাদ করেন:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার এবাদত কর, যিনি তোমাদিগকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদিগকে সৃষ্টি করেছেন। তাতে আশা করা যায়, তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারবে।(সূরা বাকারা: ২১)
২। ইবাদতের মাধ্যমে ব্যক্তি সফলতা ও কামিয়াবী হাসিল করতে পারে: মহান আল্লাহ এরশাদ করছেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ارْكَعُوا وَاسْجُدُوا وَاعْبُدُوا رَبَّكُمْ وَافْعَلُوا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
হে মুমিনগণ! তোমরা রুকু কর, সেজদা কর, তোমাদের পালনকর্তার এবাদত কর এবং সৎকাজ সম্পাদন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা হজ্জ: ৭৭)
৩। ইবাদতের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে: আল্লাহ তায়ালা বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَاشْكُرُوا لِلَّهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ
হে ঈমানদারগণ!তোমরা পবিত্র বস্তু সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসাবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় কর আল্লাহর, যদি তোমরা তাঁরই বন্দেগী কর। (সূরা বাকারা: ১৭২)
আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন: بَلِ اللَّهَ فَاعْبُدْ وَكُنْ مِنَ الشَّاكِرِينَ বরং আল্লাহরই এবাদত করুন এবং কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত থাকুন। (সূরা যুমার: ৬৬)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে সকল কাজের পাশাপাশি ইবাদত বন্দেগীতেও মধ্যপন্থা অবলম্বন করার তাওফীক দান করুন। আমীন