অভিবাদন বা সম্ভাষণ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো-সম্মান প্রদর্শন,সালাম,অভ্যর্থনা,অভিনন্দন ইত্যাদি। আরবিতে এর প্রতিশব্দ হলো তাহিয়্যাহ । আর তাহিয়্যাহ এর আভিধানিক অর্থ হলো- জীবনের জন্য দোআ করা।. ইসলামী পরিভাষায়-পারস্পরিক সাক্ষাতের সময় একে অন্যের জন্য কল্যাণ কামনার্থে আসসালামু আলাইকুমবলাকে অভিবাদন বলা হয়।
আর এই অভিবাদনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এর সূচনা হয় আমাদের আদিপিতা আদম আ:-এর সৃষ্টির পর থেকেই। তবে এ অভিবাদন ছিল ইসলামী অভিবাদন অর্থাৎ সালাম।
আদম আ: সৃষ্টির পর মহান রাব্বুল আলামীন তাকে ইসলামী অভিবাদন শিক্ষা দেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে- আল্লাহ তায়ালা আদম আ:কে স্বীয় আকৃতিতে সৃষ্টি করলেন। তাঁর উচ্চতা ছিল ৬০ হাত। তাঁকে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ তায়ালা তাঁকে বললেন,যাও! ওই দলটিকে সালাম দাও। তারা ফেরেশতাদের উপবিষ্ট একটি দল। তারা তোমার অভিবাদনের যে উত্তর দেন,তা তুমি মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করো। কেননা তা তোমার ও তোমার বংশধরদের জন্য অভিবাদন হবে।তখন আদম আ: গেলেন এবং বললেন-আসসালামু আলাইকুম আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। ফেরেশতারা জবাবে বললেন-আসসালামু আলাইকাস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ(আপনারওপর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক) ।রাসূল সা: বলেন- ফেরেশতাগণ অভিবাদনের জবাবেওয়ারাহমাতুল্লাহবৃদ্ধি করেছিলেন।(সহিহ বুখারি,হাদিস নং-৬২২৭,সহিহ মুসলিম,হাদিস নং-২৮৪১)
অভিবাদনের শব্দাবলিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে:
১. অভিবাদনের সাধারণ শব্দাবলি, ২. অভিবাদনের ইসলামী শব্দাবলি।
১. সাধারণ অভিবাদনের ক্ষেত্রে: শুভ সকাল/শুভ সন্ধ্যা/আল্লাহ তোমার চক্ষুকে শীতল করুন, প্রভৃতি শব্দগুলো ব্যবহার হয়ে থাকে।
২. অভিবাদনের ইসলামী শব্দাবলি : অভিবাদনের ইসলামী শব্দাবলি আমরা নিম্মোক্ত হাদিস থেকে পেতে পারি: ইমরান ইবনে হোসাইন থেকে বর্ণিত,একদা এক ব্যক্তি নবী করিম সা:-এর কাছে এলো এবং বললো-আসসালামু আলাইকুম। তিনি তার সালামের জবাব দিলেন। অতঃপর লোকটি বসলো। তখন রাসূল সা: বললেন-এ লোকটির জন্য দশটি সওয়াব। অতঃপর আরেক ব্যক্তি এলো এবং বললো আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। তিনি তার সালামের জবাব দিলেন। অতঃপর লোকটি বসলো। তখন রাসূল সা: বললেন-বিশটি সওয়াব। এরপর আরেক ব্যক্তি এলো এবং বললো- আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ ওয়াবারাকাতুহু। তিনি তার সালামের জবাব দিলেন। তখন রাসূল সা: বললেন- ত্রিশটি সওয়াব। (সুনানে আবু দাউদ,হাদিস নং-৫১৯৫,দারেমি,হাদিস নং-২৫২৬)।
ওই হাদিস দ্বারা বোঝা গেল অভিবাদনের ইসলামী শব্দাবলি হলো আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু তবে সংক্ষিপ্তাকারে আমাদের মাঝে আসালামু আলাইকুম সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। ইসলামী অভিবাদনের জবাব দেয়ার ক্ষেত্রে ওয়ালাইকুম আসসালাম বলতে হয়। তবে উত্তম হলো সালাম প্রদানকারী যে বাক্যের মাধ্যমে সালাম দেবে সালামের জবাবদানকারী তার থেকে অধিক শব্দের মাধ্যমে জবাব দেবে। এ প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামীন বলেন- আর যখন তোমাদেরকে অভিবাদন জানানো হয়, তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তম অভিবাদন প্রদান করো অথবা অনুরূপ ফিরিয়ে দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সর্ববিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী। (সূরা নিসা : ৮৬)
ইসলামী অভিবাদনের বিধান : ইসলামী অভিবাদন সালাম ইসলামের অন্যতম শিয়ার। সকল ওলামায়ে কিরামের ঐক্যমতে,এক মুমিন অপর মুমিনকে সালাম দেয়া সুন্নাত এবং এর জবাব দেয়া ওয়াজিব। যখন সালাম দ্বারা এক ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করা হয়। আর যদি সালামের দ্বারা কোন দল বা সমষ্টিকে উদ্দেশ্য করা হয় তাহলে তার জবাব দেয়া ওয়াজিবে কেফায়াহ। তবে যদি সকলেই উত্তর দেয় তা হলে অতি উত্তম। কারো কারো মতে,সালাম দেয়ার মত এর জবাব দেয়াও সুন্নাত। সালাম দেয়া সুন্নাত এ বিষয়টি রাসূল সা. এর অগণিত হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত। আর এর জবাব দেয়া সূরা নিসার উল্লেখিত ৮৬নং আয়াত দ্বারা ওয়াজিব হিসেবে প্রমাণিত। ইবনে কাসীর (রহ) বলেন, কোন মুসলিম সালাম দিলে উত্তর দেবে তার চেয়ে উত্তমভাবে অথবা তার মত করে। বাড়িয়ে বলা মোস্তাহাব, আর তার মতে,উত্তর দেয়া ফরজ।
ইসলামী অভিবাদন সালাম বহু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে এর ব্যবহার রীতি সংক্ষিপ্তাকারে উপস্থাপিত হলো-
১. কথা শুরু করার পূর্বে : মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশমূলক কথা-বার্তা শুরু করার পূর্বে সালাম দেয়া অপরিহার্য। মহানবী সা. বলেছেন- কথা বলার পূর্বে সালাম।(জামে তিরমিযি,হাদিস নং-২৬৯৯ ইমাম তিরমিযি বলেছেন,এ হাদিসটি মুনকার হাদিস) অপর হাদিসে রাসূল সা. বলেন,নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট সেই সর্বোত্তম ব্যক্তি যে প্রথমে সালাম দেয়।(সুনানে আবু দাউদ,হাদিস নং-৫৯৯৭)
২. সাক্ষাতের সময় : এক মুমিনের সাথে অপর মুমিনের সাক্ষাত হলে ইসরামী অভিবাসন সালাম দিতে হয়্। সালাম দেওয়া ব্যাপারে রাসূল সা. বলেন এক মুমিনের জন্য অন্য মুমিনের কর্তব্য বা হক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হাদিসে এক মুমনের জন্য অন্য মুমিনের প্রতি ছয়টি কর্তব্য রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো : যখন তার সাথে সাক্ষাত হবে,তখন তাকে সালাম দিবে। (জামে তিরমিযি,হাদিস নং-২৭৩৭)।
৩. অন্যের বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনার সময় : কারো বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনার জন্য সালাম প্রদান করার ব্যাপারে কুরআনে এসেছে- হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের বাড়ি ব্যতিত অন্য কারো বাড়িতে অনুমতি ও সালাম প্রদান ব্যতীত প্রবেশ করবে না।(সূরা নূর,আয়াত নং-২৭) পর পর তিনবার সালাম প্রদানের পর অনুমতি না পেলে ফিরে যাওয়াই ইসলামী শিষ্টাচার।
৪. আগমন ও প্রস্থানের সময় : আগমন ও প্রস্থানের সময় ইসলামী অভিবাদন সালাম দিতে হবে। আবু হুরায়রা ও যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল সা. বলেছেন- যখন তোমাদের কেউ কোন সমাবেশে পৌঁছে,তখন সে যেন সালাম দেয়। যদি তথায় তার বসার প্রয়োজন হয়,তবে যেন বসে পড়ে। অতঃপর যখন সে প্রস্থানের জন্য দাঁড়ায়,তখন যেন সালাম করে। কেননা,প্রথম সালাম দ্বিতীয় সালামের চেয়ে অধিক হকদার নয়।(জামে তিরমিযি,হাদিস নং-২৭০৬, সুনানে আবু দাউদ,হাদিস নং-৫২০৮)
৫. নিজের বাড়িতে প্রবেশকালে : নিজের বাড়িতে প্রবেশকাল পরিবারের সদস্যদের প্রতি ইসলামী অভিবাদন সালাম প্রদান করা সুন্নাত। পবিত্র কুরআনে এসেছে, যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করবে,তখন তোমরা তোমাদের স্বজনদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র অভিবাদন স্বরূপ সালাম পেশ করবে।(সূরা নূর, আয়াত নং-৬১) আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন, হে বৎস! যখন তোমার বাড়িতে প্রবেশ করবে,তখন সালাম দিবে। কেননা, তোমার সালাম তোমার ও তোমার পরিবারের লোকদের জন্য বরকতের কারণ হবে।(জামে তিরিমিযি,হাদিস নং-২৬৯৮)।
ইশারা-ইঙ্গিতে ইসলামী অভিবাদন : হাতের তালু,আঙ্গুল বা মাথার ইশারা-ইঙ্গিতে ইসলামী অভিবাদন বা সালাম প্রদান করা বা জবাব দেয়া মাকরুহ। কেননা ইশারা-ইঙ্গিতে অভিবাদন জানানো ইয়াহুদী-নাসারাদের সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। রাসূল সা. বলেছেন- যে ব্যক্তি অমুসলিমদের সাথে সাদৃশ্য রাখে,সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। তোমরা ইয়াহুদী ও নাসারাদের সাথে সাদৃশ্য রাখবে না। কেননা, ইয়াহুদিরা আঙ্গুলের ইশারায় এবং নাসারাগণ হাতের তালুর ইশারায় সালাম প্রদান করে থাকে। (জামে তিরমিযি, হাদিস নং-২৬৯৫)
ইমলামী অভিবাদনের নিষিদ্ধ সময় : বিভিন্ন সময় ইসলামী অভিবাদন প্রদান করা উচিত নয়। যথা- প্রাকৃতিক কাজ সারার সময়,ঘুমন্ত অবস্থায়, নামাযরত অবস্থায়, গোসল খানায় গোলরত অবস্থায়,খাবার গ্রহণের সময়,কুরআন তেলোয়াতকালীন,খুতবা চলাকালীন, ইহরাম অবস্থায় তালবীয়া পাঠকালে।