মায়ের ভাষায় কথা বলা বা ভাব প্রকাশ করার নাম হলো মাতৃভাষা। মাতৃভাষাই মানুষ সর্বপ্রথম আয়ত্ব করে। তাই ভাষা হিসেবে এটিই সর্বপ্রথম স্মৃতিপটে অঙ্কিত হয়ে যায়। এর পর আর যত ভাষাই শিখুক না কেন, প্রতিটি ভাষাই সে তার স্মৃতিপটে রক্ষিত ভাষার সঙ্গে তুলনা করে বুঝার চেষ্টা করে। আমরা বাংলাদেশী, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, তাই I eat rice’’ বললে আমাদের স্মৃতিপট সহজেই অনুবাদ করে- “ আমি ভাত খাই’’এভাবে আমরা সবকিছু সহজ করে বুঝতে পারি। এই তুলনা পদ্ধতি ছাড়া অন্যভাষা শিক্ষা করা ও বুঝা খুবই দুরূহ ব্যাপার। মাতৃভাষার প্রতি মানুষের এ নির্ভরতার কথা মহান আল্লাহ ভাল করেই জানেন। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা থেকে জানা যায় যে, হক্ব তথা সত্যের বিপরীতে বাতিল তথা মিথ্যা যে যুগে যে রূপ নিয়ে এসেছে তার মুকাবিলায় আল্লাহ তাআ’লা তার নবীদের সেধরণের মুজেযা দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যেমন: নূহ (আঃ) এর যুগ ছিল জাহাজ শিল্পের উন্নতির যুগ এজন্য তার শ্রেষ্ঠ মুজেযা ছিল তৎকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ জাহাজ। দাউদ (আঃ) যুগে গানবাদ্য চর্চায় সুরের মূর্ছনার মাধ্যমে মানুষকে আকর্ষণের প্রবণতা, তার মুকাবিলায় আল্লাহর নবী দাউদকে এমন সুমধুর কন্ঠ দিলেন যখন তিনি যাবুর তিলাওয়াত করতেন সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত কিনারায় চলে আসতো! সুলায়মান (আঃ) এর যুগছিল ধন সম্পদ এবং রাজ ক্ষমতা এর বিপরীতে সারা দুনিয়ার বাদশাহী আল্লাহ তাকে দান করলেন। মূসা (আঃ) এর যুগছিল যাদু বিদ্যার উৎকর্ষতার যুগ এর বিপরীতে তাকে দিলেন লাঠি। ঈসা (আঃ) এর যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সোনালী যুগ ছিল এর মুকাবিলায় মহান আল্লাহ তাকে এমন মুজেযা দিলেন যে তার হাতের স্পর্শে জন্মান্ধ এবং কুষ্ঠ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যেত! তদরূপ বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর যুগ ছিল সাহিত্য সাধনায় উৎকর্ষতার যুগ এর মুকাবিলায় আল-ক্বুরআনুল কারীম নামের এমন এক উজ্জ্বল অদ্বিতীয় সাহিত্য গ্রন্থ তার ওপর নাযিল করলেন ক্বিয়ামাত পর্যন্ত যার মুজেযা থাকবে অব্যয় ও অক্ষয়। এভাবে মানব জাতির হিদায়াতের জন্য তিনি যত নবী-রাসূল পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, প্রত্যেককে তার স্বজাতীয় ভাষায় তথা মাতৃভাষায় ওহী দিয়ে প্রেরণ করেছেন। ইসলাম মাতৃভাষাকে খুবই মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করেছে। যেহেতু নবী রাসূলগণ মাতৃভাষার মাধ্যমেই দ্বীন প্রচার করেছেন, যেমন-
قال صلّى الله عليه وسلم أرسل كل نبىّ إلى أمّته بلسانها وأرسلنى الله إلى كلّ أحمر و أسود من خلقه (ابو نعيم ، حلية الأولياء(
– রাসূল (সাঃ) বলেন প্রত্যেক নবীকে তার উম্মতের নিকট তাদের স্বভাষায় প্রেরণ করা হয়, আর আমাকে আল্লাহ তা’আলা তার সৃষ্টির লাল-কালো সকলের নিকট প্রেরণ করেছেন। (আবু ন’আইম, খন্ড-৫, পৃষ্ঠা ১১৮) অর্থাৎ সকল ভাষাভাষী লোকের জন্য তিনি রাসূলরূপে প্রেরিত। সেহেতু সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) পৃথিবীর যে ভূখণ্ডেই গেছেন আগে সেখানের ভাষা শিখেছেন তারপর দ্বীনের দাওয়াতী কাজ করেছেন। যেমন- রাসূল (সাঃ) যায়েদ ইবনে সাবিত (রাঃ) সুরইয়ানী ভাষা শিক্ষা করার নির্দেশ দেন এবং এই ভাষা অল্প কিছুদিনের মধ্যে তার আয়ত্বে চলে আসে। আর বড় বড় আসমানী কিতাব সমূহও স্ব স্ব রাসূলগণের মাতৃভাষায়ই অবতীর্ণ হয়েছিল। যেমন:- হযরত মূসা (আঃ) এর জাতি কথা বলতো হিব্রু বা ইবরানী ভাষায়। এজন্য তাওরাত কিতাব অবতীর্ণ হয়েছিল ইবরানীতে। হযরত দাউদ (আঃ) এর জাতির ভাষা ছিল গ্রিক বা ইউনানী। যাবুর অবতীর্ণ হয়েছিল ইউনানী ভাষায়। হযরত ঈসা (আঃ)এর জাতির মাতৃভাষা ছিল সূরিয়ানী। তাই ইনজিল শরীফ নাযিল হয়েছিল সূরিয়ানী ভাষায়। তেমনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাতৃভাষা ছিল আরবী। এজন্য কুরআন আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে। (আল্লামা সুয়ূতী, আল ইতকান খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৮৭) । যাতে তারা তাদের স্বজাতির লোকদেরকে স্পষ্ট ও সহজ ভাষায় আল্লাহর দ্বীন বুঝাতে পারেন। এতে মাতৃভাষার মর্যাদা আল্লাহ তাআ’লা কর্তৃক সমুন্নত হয়েছে। ভাষা আল্লাহ তায়ালার দান। আল্লাহ তাআলার সেরা নেয়ামত; তাইতো স্বাধীন বাংলার ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ বলেছিলেন-
মাতৃভাষা বাংলা ভাষা,
খোদার সেরা দান,
বিশ্ব ভাষার সভায় তোমার,
রূপ যে অনির্বাণ।
ঠিক একই সুর বেজে উঠে কবিয়াল খ্যাত কবি রামনিধিগুপ্ত রচিত কবিতার ভাষায়-
নানান দেশের নানান ভাষা বিনে স্বদেশী ভাষা/ পুরে কি আশা? / কতো নদী সরোবর কী বা ফল চাতকীর? /ধারাজল বিনে কভু / ঘুচেকি তৃশা? অর্থাৎ পৃথিবীতে হাজারো ভাষা থাকা সত্ত্বেও যেমন মাতৃভাষা ছাড়া মনের আশাই অপূর্ণ থেকে যায়, ঠিক তেমনি পৃথিবীতে অজস্র সাগর-মহাসাগর, নদী-নালা, পুকুর দিঘী টৈটুম্বুরে জল থাকা সত্ত্বেও বৃষ্টির পানি ছাড়া চাতক পাখির তৃষ্ণা নিবারিত হয় না।
ভাষা মনুষ্য পরিচয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করতে শেখায়; কারণ, সব ভাষাই আল্লাহর দান ও তাঁর কুদরতের নিদর্শন। তিনি অসংখ্য ভাষা সৃষ্টি করে তার কুদরতের নিদর্শন প্রকাশ করেছেন। পৃথিবীর সকল কওম বা জাতি-গোষ্ঠীতে নবী-রাসূল এসেছেন। সকল নবী-রাসূল প্রত্যেক জাতির মাতৃভাষায় দাওয়াতী কাজ করেছেন। স্বয়ং রাসূল (সাঃ) বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলতেন। তাই বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলা সুন্নাত। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ জন্য উলামায়ে কেরামের উচিত বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা শিক্ষা ও চর্চা করা।
বিদায় হজের ভাষণে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘কালোর ওপর সাদার প্রাধান্য নেই, অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ (বুখারী শরীফ) সুতরাং কোনো ভাষাকে হেয় জ্ঞান করা যাবে না, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যাবে না এবং অবহেলা করা যাবে না; কেননা, ভাষার স্রষ্টাও মহান আল্লাহ। তাঁর সৃষ্টির অবমূল্যায়ন করা তাঁর প্রতি অসম্মান প্রদর্শনেরই নামান্তর। আল্লাহ তাআ’লা মানুষের হিদায়াতের জন্য নবী-রাসূলদের পাঠিয়েছেন। তাঁদের ধর্ম প্রচারের প্রধান মাধ্যম ছিল দাওয়াত বা মহা সত্যের প্রতি আহ্বান। আর এর জন্য ভাষার কোনো বিকল্প ছিল না। আল্লাহ তাআলা বলেন:
ما أَرسَلنا مِن رَسولٍ إِلّا بِلِسانِ قَومِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُم فَيُضِلُّ اللَّـهُ مَن يَشاءُ وَيَهدي مَن يَشاءُ وَهُوَ العَزيزُ الحَكيمُ
‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।’ (সূরা ইবরাহিম-৪) আল্লাহ জাল্লাহ শা-নুহু আরো বলেন-
فَإِنَّما يَسَّرناهُ بِلِسانِكَ لِتُبَشِّرَ بِهِ المُتَّقينَ وَتُنذِرَ بِهِ قَومًا لُدًّا
– আমি ক্বুরআনকে আপনার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে আপনি এর দ্বারা পরহেযগারদেরকে সুসংবাদ দেন এবং কলহকারী সম্প্রদায়কে সতর্ক করেন।’ (সূরা-মারইয়াম: ৯৭) এ আয়াতে কারীমাহ দুটিতে এ কথা পরিস্কার হল যে, মাতৃভাষা ছাড়া কোন কিছুই স্পষ্ট ও সহজভাবে বর্ণনা করা সম্ভব নয়, আর সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হলো যে, ইসলাম পৃথিবীর সকল মানুষের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব ও মর্যাদা দেয়।
মাতৃভাষার গুরুত্ব, মর্যাদা, প্রয়োজনীয়তা, উপকারিতা ও অপরিহার্যতার আরো কিছু দিক নিম্নে তুলে ধরা হলো-
* মাতৃভাষা জীবন ও জগতের রহস্যময়তা এবং আত্মলোকের দ্বার উদ্ঘাটনের চাবী স্বরূপ।
* মাতৃভাষা সমগ্র ভাব প্রকাশের এবং জগৎ ও জীবনকে উপলব্ধি ও উপভোগের সর্বশ্রেষ্ঠ অবলম্বন।
* মাতৃভাষা ও চিন্তাশক্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একে অন্যের পরিপূরক ও পরিপোষক। নিজেকে পরিপুষ্ট ও জাগ্রত করা এবং ব্যক্তিত্বের উম্মেষ, বিকাশ ও পূর্ণতা সাধন করা এক মাত্র মাতৃভাষায়ই সম্ভব। অন্য ভাষায় তা সম্ভব নয়। কারণ আমরা যখন অন্য ভাষায় কথা বলি বা লিখি, তখন আমাদের মস্তিষ্কের ক্রিয়া দ্বৈতভাবে চলতে থাকে। অর্থাৎ প্রথমে মাতৃভাষায় চিন্তা করি, তারপর অন্য ভাষায় তা প্রকাশ করি। তাতে স্বতঃস্ফুর্ততা ও সহজ সাবলীলতা আসে না। অথচ ভাষার গতি স্বচ্ছ ও সাবলীল না হলে ভাব ও চিন্তার প্রকাশ গভীর এবং স্বচ্ছ হতে পারে না। মস্তিষ্ক অযথা ক্রিয়া-ক্লান্তিতে ভারাক্রান্ত হয়। ফলে আত্মপ্রকাশের গতি মন্থর ও আড়ষ্ট হয়ে আসে।
* মাতৃভাষার উপর যার ভাল দখল থাকবে, পৃথিবীর সকল বিষয়ের উপর দখল প্রতিষ্ঠা করা তার পক্ষে অতি সহজ হবে। যেমন- চীন ও জাপান উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছার অন্যতম কারণ হলো মাতৃভাষার প্রতি যথাযথ মর্যাদা দেয়া, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি বিষয় তারা জাতীয় স্বার্থে মাতৃভাষায় অনুবাদ করে নিয়েছে।
* কোন জাতির কাছে তাদের মাতৃভাষায় কোন কিছু প্রচার-প্রসার করা যত সহজে সম্ভব অন্য কোন ভাষায় তা সম্ভব নয়।
* প্রত্যেক ভাষাভাষি লোকের নিকট তার মাতৃভাষা অত্যন্ত প্রিয়। মায়ের ভাষা ছাড়া তৃপ্তি সহকারে মনের ভাব প্রকাশ করা যায় না। বিদেশী ভাষায় যতই পাণ্ডিত্য অর্জন করা হোক না কেন, তবুও নিজের মাতৃভাষা ছাড়া নিজস্ব ভাব ও অভিব্যক্তি সর্বাঙ্গীন মাধুর্যপূর্ণ ও সুষমামণ্ডিত করে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
অতএব মাতৃভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরীসীম। এ ভাষায় মানুষ অংকুরিত হয় এবং তাদের অস্তিত্ব স্বাক্ষরিত হয়। দুর্ভাগ্য এ জাতির জন্য যাদের রক্তে অর্জিত মাতৃভাষার চর্চা আজ হচ্ছে ভিনদেশী ভাষায়!
মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা না করার কুফল ও পরিণাম: উপরের বর্ণনা থেকে আমরা মাতৃভাষার গুরুত্ব, মর্যাদা, প্রয়োজনীয়তা, উপকারিতা ও অপরিহার্যতা সসম্পর্কে সংক্ষেপে জানতে পারলাম এবং এর সুফল গুলোও অনুধাবন করলাম। নিম্নে এই মাতৃভাষা চর্চা না করার কুফল বর্ণনা এবং এর পরিণাম সম্পর্কে কিছু অলোকপাত করা হলো।
* মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দ্বীন চর্চা না করলে আল্লাহ রাব্বুল‘আলামীনের দিক নির্দেশনা অমান্য করার শামিল। কেননা প্রত্যেক নবী রাসূলকে আল্লাহ তা’আলা মাতৃভাষায় দ্বীন বুঝাবার জন্য মানব জাতির কাছে পাঠিয়েছেন।
* মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দ্বীন চর্চা না করা নবী-রাসূল (আঃ) গণের সুন্নতের খেলাফ। কেননা তারা যে তদের উম্মতের কাছে মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দ্বীন চর্চা করেছেন, নিম্নোক্ত হাদীস থেকে আমরা তার প্রমাণ পাই-
قال الإمام أحمد حدثنا عن عمر بن ذرّ قال قال مجاهد عن ابى ذرّ قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لم يبعث الله عزّ وجلّ نبيا إلا بلغة قومه (مسند أحمد) (لم يسمع مجاهد من ابى ذرّ(.
“মুজাহিদ (রঃ) বলেন আবু জার গিফারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল (সাঃ) বলেছেন- আল্লাহ তা’আলা কোন নবী-রাসূলকে তার স্বজাতির ভাষা ব্যতীত পাঠাননি। (আহমাদ-২০৪৪১)
* মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দ্বীন চর্চা না করা আকাবীরগণের (দ্বীনের পূর্ববর্তী পণ্ডিতগণের) কর্মেরও খেলাফ। কারণ আমরা জানি যে, ফার্সী ও উর্দ্দু ভাষার যত উলামায়ে আকাবিরীন রয়েছেন তাদের প্রত্যকেই স্ব- স্ব ভাষায় ব্যাপক অবদান রেখে গেছেন। মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দ্বীন চর্চা করেছেন, বলেই তারা এ বিশাল অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। যে কারণে ফার্সীভাষীরা আল্লামা রুমী, শেখ সাদী ও জামীর মত বহু পণ্ডিত পেয়েছে এবং উর্দ্দুভাষীরা পেয়েছে আল্লামা ইকবালের মত বহু পণ্ডিত। কিন্তু আফসোস আমাদের বাংলাভাষী উলামায়ে কিরামদের মাঝে মাতৃভাষার প্রতি অবহেলার কারণে আমরা সেরকম কাউকেই পাইনি।
* মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চা না করলে বিপুল পরিমাণ শ্রম, মেধা ও সময়ের অপচয় হয়। তার পরও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না।
* শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক মাতৃভাষায় না হয়ে বিদেশী ভাষায় হলে দুর্বোধ্যতার কারণে শিক্ষার্থীরা পাঠে মনযোগ সৃষ্টি করতে পারে না। ফলে পড়া-লেখা হতে পালিয়ে বেড়ানোর মানসিকতা সৃষ্টি হয়।
* কোন মানুষের মাতৃভাষায় পরিপূর্ণ দখল না থাকলে নিজ গৃহে পরবাসী’র মত থাকতে হয়।
* মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চা না করলে বিশ্বসভায় নিজেদের স্বকীয় অস্তিত্ব ও পরিচিতি তুলে ধরা যায় না।
* আমাদের বাংলাদেশে আলীয়া ও কাওমী মাদ্রাসাগুলোতে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই মাতৃভাষায় শিক্ষাদান পদ্ধতি অবলম্বন না করে উর্দ্দু-ফার্সীকে মাধ্যম হিসেবে নেয়া হয়েছিল। ফলে মুসলিম জনসাধারণের নিকট ক্বুরআন-সুন্নাহর প্রকৃত শিক্ষা অনেকাংশেই অজানা রয়েগেছে। জনশ্রুতি ও লোকাচারের মাধ্যমে দ্বীন চর্চা করতে গিয়ে অনেক শিরক-বিদ’আত, কুসংস্কার এবং ভ্রান্ত আক্বীদাহ দ্বীনের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে। যা আমাদের অগ্রগতিকে বহুদূর পিছিয়ে দিয়েছে। আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, অনেক ক্বওমী মাদ্রাসায় এখনো উর্দ্দু-ফার্সীর মাধ্যমে দ্বীন শিক্ষাদানের প্রয়াস চালানো হচ্ছে। অথচ ভাষা হিসেবে উর্দ্দু এবং ফার্সীর কোন প্রয়োজনীয়তা যে আমাদের জাতীয় এবং ধর্মীয় জীবনে আর অবশিষ্ট নেই; এ কথা বুঝতে না পারা আমাদের অজ্ঞতা, গোঁড়ামী ও অদূরদর্শিতার প্রমাণকে আরো স্পষ্ট করছে।
শেষকথা: অতিমাত্রায় ধার্মিকতা দেখানোর উদ্দেশ্যে যেমন একটা সম্প্রদায় বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের ভাষা মনে করে মাতৃভাষার গুরুত্বকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে, অথচ এ মাতৃভাষা আল্লাহর সেরা দান তার বান্দাদের জন্য। অনুরূপভাবে তার বিপরীতে অন্য এক সম্প্রদায় নিজেদেরকে অতিমাত্রায় বাঙ্গালীপনা প্রদর্শন এবং নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে গিয়ে ধর্মীয় রীতি-নীতি উপেক্ষা করে সংখ্যা গরিষ্ঠ জাতির উপর সংখ্যা লঘিষ্ঠ জাতির ধর্মীয় আচার-আচরণ চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। উভয়টাই স্বদেশী ভাষাকে তার সমহিমায় টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায়। যেহেতু মাতৃভাষা ছাড়া জাতির অধিকাংশ জনসাধারণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় বিচরণ করতে অক্ষম হয়ে যাচ্ছে, সেহেতু এর ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহারই জাতিকে বৈশ্বিক ভাষার দরবারে মাথা উঁচু করে চলার ও বলার সুযোগ সৃষ্টি করবে বলে মনে করি। এক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি বিষয় আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় অনুবাদ করে শিক্ষা-দীক্ষার প্রত্যেকটি স্তরে মাতৃভাষার যথাযথ ব্যবহার করা উচিত। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে মাতৃভাষার মাধ্যমে সহজ ও সুস্পষ্টভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দ্বীন চর্চা করার পরিবেশ ও তাওফীক দান করুন। (আমীন)