ইসলামে সালাম ও মুসাফাহার গুরুত্ব ও নিয়মাবলী

Handshak-150x150

ইসলাম একটি সার্বজনীন ধর্ম। মানবজীবনের এমন কোনদিক নেই যার পূর্নাঙ্গ বিবরণ দেয়নি ইসলাম। ব্যক্তিজীবন, পারিবারিকজীবন, সামাজিকজীবন, আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডল সকল ক্ষেত্রেই চলার জন্য ইসলাম দিয়েছে বিস্তারিত ও ভারসাম্যপূর্ণ বিধান। পরস্পরে দেখা-সাক্ষাত মানবজীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। প্রত্যেক গোত্র, জাতি ও ধর্মালম্বীই মেনে চলে সেই দেখা-সাক্ষাতের শিষ্টাচার ও রীতি-নীতি।  একে-অপরের সঙ্গে সাক্ষাত হলে ব্যবহার করে থাকে হ্যালো, গুডমর্নিং, গুডইভেনিং, নমস্কার, আদাব ইত্যাদি শব্দ এবং করে থাকে হ্যান্ডশেক। ইসলামেরও রয়েছে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট শিষ্টাচার ও রীতিনীতি। ইসলামের রীতি অপরাপর জাতির মত এক-দুটো শব্দ ছুঁড়ে দেয়ার মত নয়। বরং এক্ষেত্রে ইসলামের শিষ্টাচার ও সংস্কৃতি অন্যান্য জাতির সংস্কৃতি থেকে আরও অনেক উন্নত, প্রাণসম্পন্ন, অর্থবহ, সমৃদ্ধ, স্বতন্ত্র ও কল্যাণমুখী। এক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা. কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতি হলো, “আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু” বলা এবং সুযোগ থাকলে মুসাফাহা ও মুয়ানাকা করা। সালাম, মুসাফাহা ও মুআনাকায় রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের বিপুল উপকারিতা ও ফজিলত। নিম্নে সালাম ও মুসাফাহার ফজিলত সম্বলিত কিছু হাদিস উল্লেখ করছি। যেন এর উপর আমলের আগ্রহ ও আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। সালামের উপকারিতা ও ফজিলত আল্লাহ তাআলা আদম আ. কে সৃষ্টি করার পর বললেন, “যাও অমুক স্থানে ফেরেস্তাদের একটি দল বসে আছে। তাদেরকে সালাম দাও আর তাঁরা তোমাদেরকে কি অভিবাদন করে তা শোন। তারা তোমাকে যে অভিবাদন করবে তাই হবে তোমার ও তোমার সন্তানদের অভিবাদন। আদম আ. গিয়ে ‘আস-সালামু আলাইকুম’ বলে ফেরেস্তাদের সালাম দিলেন। ফেরেস্তাগণ ‘ওয়া আলাইকুমস সালাম     ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলে উত্তর দিলেন। তাঁরা উত্তরে “ওয়া রাহমাতুল্লাহ” বাড়িয়ে বললেন। [বুখারি : ২/৯১৯] এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হলো, সালাম আল্লাহপ্রদত্ত এক মহা নিয়ামত। এত বড় নিয়ামত, যা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। অন্য এক হাদীসে সালামের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, “তোমরা জান্নাতে যেতে পারবেনা যাবত মুমিন না হবে। আর মুমিন হতে পারবেনা যাবত একে অপরকে মুহাব্বাত না করবে। আমি কি তোমাদের এমন একটি আমলের কথা বলে দিবনা যা করলে তোমাদের পরস্পরের মাঝে ভালবাসা সৃষ্টি হবে? (সেটি হলো) তোমরা তোমাদের পরপস্পরের মাঝে ব্যাপকভাবে সালামের প্রচলন করবে।” [মুসলিম : ১/৫৪ তিরমিযি : ২/৭] অপর বর্ণনায় এসেছে, “হযরত আব্দুল্লাহ বিন সালাম বলেন, আমি রাসুলুল্লাহকে সা. বলতে শুনেছি, হে লোক সকল! তোমরা সালামের ব্যাপক প্রচলন কর, (ক্ষুর্ধাতদের) আহার করাও, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখ এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়, তাহলে     তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে নিরাপদে। [তিরামিযীঃ ২/৭৫; মুসনাদে আহমাদ : ৫/৪৫১]  অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, জনৈক ব্যক্তি নবী কারিম সা. -এর নিকট এসে বলল, ‘আস্-সালামু আলাইকুম” তিনি তার সালামের উত্তর দিলেন। এরপর সে ব্যক্তি বসলে নবী কারিম সা. বললেন, “দশ” অর্থাৎ তার আমলনামায় দশটি নেকী লেখা হয়েছে। এরপর আরেক ব্যক্তি এসে বলল, “আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমুতুল্লাহ”। তিনি তার সালামের উত্তর দিলেন। এরপর সে ব্যক্তি বসলে তিনি বললেন, বিশ অর্থাৎ তার আমল নামায় বিশটি নেকি লেখা হয়েছে। তারপর অপর আরেক ব্যক্তি এসে বলল, আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমুতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। তিনি তার সালামের উত্তর দিলেন। এরপর সে বসলে তিনি বললেন, “ত্রিশ” অর্থাৎ তার আমল নামায় ত্রিশটি নেকি লেখা হয়েছে। [আবু দাউদ : ২/৭০৬] সালামের মধ্যে রয়েছে ৩টি দোয়া-১. শান্তির দোয়া ২. রহমতের দোয়া ৩. বরকতের দোয়া। একবার যদি সালামের এই দোয়াগুলো কবুল হয়, তাহলে আমাদের অন্তর হবে নিষ্কলুষ এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সমূহ সফলতা করবে পদচুম্বন। এই অমূল্য নিয়ামত অন্যান্য জাতির অভিবাদন পদ্ধতিতে কখনও পাওয়া যাবে না। অথচ এই মহা নিয়ামতকে ছেড়ে আমরা আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দিচ্ছি “গুডমর্নিং” আর “গুডইভেনিং”। এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে? এগুলোতে না আছে দুনিয়ার ফায়দা, না আছে আখেরাতের ফায়দা। এর বিপরীতে সালামের প্রতিটি শব্দ দুনিয়া ও আখেরাতের সমূহ কল্যাণ ও সফলতায় ভরপুর। মুসাফাহার ফজিলত হযরত আনাস রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. এর নিকট কেউ এলে তিনি তার সাথে মুসাফাহা করতেন। [তিরমিযি] মুসাফাহার ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে মহানবী সা. বলেন, এক মুসলমান অপর মুসলমানের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় মুসাফাহা করলে উভয়ে আলাদা হওয়ার পূর্বেই সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়। [আবু দাউদ : ২/৭০৮; তিরমিযি : ২/১০২] অপর বর্ণনায় এসেছে রাসুল্লাহ সা. বলেন, “দুজন মুমিন পরষ্পরে সাক্ষাত হলে, যদি সালাম বিনিময় করে মুসাফাহা করে তাহলে গাছের পাতা যেভাবে ঝড়ে পড়ে সেভাবে তাদের হাতের গুনাহগুলো ঝড়ে পড়ে।” [তাবরানী; বায়হাকী] কিন্তু অনেক সময় সঠিক মাসআলা জানা না থাকার কারনে আমরা আমল করেও আমলের ফজিলত ও কল্যাণ হতে মাহরুম হই। তাই বক্ষমান আলোচনায় সালাম ও মুসাফাহা সম্পর্কীয় কিছু জরুরী মাসআলা ও আদাব নিয়ে আলোচনা করব। যেন সঠিক মাসআলা জেনে সঠিকভাবে আমল করে সালাম ও মুসাফাহার ফজিলত ও কল্যাণ অর্জন করতে পারি। সালাম প্রদান সংক্রান্ত আদাব ও মাসায়েল ১। আগে সালাম দেয়া উত্তম। কারন প্রথমে সালাম প্রদানকারী অধিক সওয়াব প্রাপ্ত হয়। [আবু সাউদ : ২/৭০৬ তিরমিযি, হাদিস-২৬৯৫] ২। পরিচিত-অপরিচিত, ছোট-বড়, নিকাটাত্মীয়-দুরাত্মীয়, মাতা-পিতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তানাদী সকলকেই সালাম দিবে। [মুসলিম : ২/২১৪; আবু দাউদ : ২/৭০৬-৭০৭; মিশকাত : ৩৯৯; হিন্দিয়া : ৫/৩৩০] ৪। সালামের একটি আদব হলো, ছোট বড়কে, আরোহী পদচারীকে, চলন্ত ব্যক্তি উপবিষ্ট ব্যক্তিকে, আগুন্তুক অবস্থানকারীকে অগ্রে সালাম করবে। [মুসলিম : ২/২১২; আবু দাউদ : ২/৭০৬] ৫। একাধিক ব্যক্তি কি বা পুরো মাহফিলের পক্ষে থেকে একজন সালাম করলে সকলের পক্ষ হতেই আদায় হবে। [হিন্দিয়া : ৫/৩২৫; আদাবুল মুআশারাত : ২৮] ৬। সালামের সময় হাত দিয়ে ইশারা করা, হাত কপালে ঠেকানো, ও মাথা-ঝুকানো শরিয়ত সম্মত নয়। তাই এ প্রথা পরিত্যাজ্য। তবে দূরবর্তী লোককে সালাম বা উত্তর দিলে যার পর্যন্ত আওয়াজ না পৌছার সম্ভবনা রয়েছে সেরূপ ক্ষেত্রে মুখে সালাম  বা উত্তর দিয়ে শুধু বুঝানোর জন্য হাত দিয়ে ইশারা করার অনুমতি রয়েছে। [তিরমিয়ী ২/৯৯; মিরকাত : ৪/৫২২; আল কাউকাবুদ্ দুররি : ২/১৩৬; আহকামুল কুরআন : ৩/২৬০; মাহমুদিয়া : ২৮/১৮৭] ৭। অমুসলিমকে সালাম দেয়া জায়িয নেই। কোন অমুসলিমের সঙ্গে সাক্ষাত হয়ে গেলে আর সালাম দেয়ার প্রয়োজন হলে, সেই শব্দই ব্যবহার করবে, যা তারা এ জাতীয় মুহূর্তে ব্যবহার করে থাকে। [মুসলিম : ২/২১৪; আবু দাউদ : ২/৭০৭; ইসলাহি খুতুবাত : ৬/১৩১] ৮। কোন মজলিস কিংবা অনুষ্ঠানে মুসলিম-অমুসলিম উভয় প্রকারের লোক থাকলে শুধু মুসলমানের নিয়তে সালাম দিবে কিংবা “আস-সালামু আলা মানিত তাবাআল হুদা ”বলে সালাম দিবে। [বুখারি : ২/৭২৪; নববী-আলাল মুসলিম : ২/২১৪; হিন্দিয়া : ৫/৩২৫; আল বাহরুর রায়েক : ৯/৩৮০] ৯। নিচের ব্যক্তিদেরকে সালাম দেয়া মাকরুহ। এরূপ ব্যক্তিদেরকে সালাম দিলে সালামের জবাব দেয়া জরুরি নয়। (ক) কোনো গুনাহের কাজে লিপ্ত ব্যক্তিকে। ২. পেশাব-পায়খানায় রত ব্যক্তিকে (গ) পানাহারকারী ব্যক্তিকে (তার মুখে খাদ্য-পানীয় থাকা অবস্থায়)। (ঘ) কোনো ইবাদত যেমন- নামায, তিলাওয়াত, যিকির, দীনি কিতাব নিয়ে আলোচনায় রত ব্যক্তিকে (ঙ) কোন মজলিসে আলোচনা চলা অবস্থায়। সারকথা কেউ যদি কোন কাজে ব্যস্ত থাকে, আর সালামের কারণে সেই কাজে বিঘœ ঘটার আশংকা থাকে, তাহলে এমতাবস্থায় সালাম না দেয়া উচিৎ। [রদ্দুল মুহতার : ২/৩৭৪; ৯/৫৯৫; হিন্দিয়া : ৫/৩২৬]১০। গায়রে মাহরাম নারী-পুরুষের মধ্যে যেসব ক্ষেত্রে ফেতনার আশংকা রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে সালাম আদান প্রদান নিষেধ। [বুখারি : ২/৯২৩; আবু দাউদ : ২/৭০৭; রদ্দুল মুহতার : ৯/৫৩০ আল বাহরুর রায়েক : ৮/২০৭; মাহমুদিয়া : ২৮/২০০।] ১১। কোন খালি ঘরে প্রবেশ করলেও সালাম দিবে তখন সালাম দিবে এই বলে; আস-সালাম আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহহিছ ছালিহিন। [সূরা-নুরঃ ৬১; রদ্দুল মুহতারঃ ৯/৫৯৬-৫৯৭; হিন্দিয়াঃ ৫/৩২৫] ১২। মসজিদে প্রবেশের পর যদি দেখা যায় যে, সকলেই আমলে রত, তাহলে সালাম দেয়া অনুচিৎ। যদি আমলে রত না থাকে, তাহলে সালাম দেয়া যেতে পারে। আর যদি কিছুলোক আমলে থাকে আর বাকীরা আমলে না থাকে, তাহলে সালাম দেয়া-না দেয়া উভয়টারই সুযোগ রয়েছে। [রুদ্দুল মুহতার : ২/৩৭৫; হিন্দিয়া : ৫/৩২৫; মাহমুদিয়া : ২৮/১৯৭; আদাবুল মুআশারাত : ২৭] ১৩। সাক্ষাতৎ ও বিদায় উভয় সময়ই সালাম দেয়া সুন্নাত। [তিরমিযি : ২/১০০; আবু দাউদ : ২/৭০৭; আদাবুল মুআশারাত : ২৭] ১৪। কবরস্থানে গেলে কবরবাসীকে সালাম দিবে এই বলে, “আস-সালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর আন্তুম লানা সালাফুন ওয়া নাহনু লাকুম তাবিউন।” [আল-বাহরুর রায়েক : ৯/৩৮০; আদাবুল মুআশারাত : ২৭] ১৫। যার উপর গোসল ফরজ-এমন ব্যক্তি সালাম ও সালামের উত্তর দিতে পারবে। [রুদ্দুল মুহতার : ১/৪৮৮; হিন্দিয়া  : ১/৩৮] ১৬। মোবাইল/ফোনে কথা বলার সময় প্রথমে সালাম দিবে। এরপর অন্য কথা বলবে। [তিরমিযি : ২/৯৯; রদ্দুল মুহতার : ৯/৫৯২; আল ফিকহুল ইসলামি : ৩/৫৭৮]

Related Post