আমরা লক্ষ্য করছি প্রতিটি রমজান মাসে বাড়িতে বাড়িতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে পেরিত আসমানি কিতাব কুরআনুল কারিমের চর্চা হয়। কুরআনুল কারিমকে নিয়ে পর্যালোচনা হয়। মা আয়েশা সিদ্দিকা রা:- কে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল নবী করিম সা:-এর জীবনযাপন কেমন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘নবী করিম সা: হচ্ছেন জীবন্ত কুরআন’। অর্থাৎ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে পেরিত কুরআনুল কারিমের প্রতিট অক্ষর মহানবী সা: পালন করতেন। নবী করিম সা: একদল সাহাবাকে কুরআনের হাফেজ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। এদের একটাই কাজ ছিল- পবিত্র কুরআনুল কারিমকে নিয়ে গবেষণা করা ও মুখস্থ করে রাখা- যেন পরবর্তীকালে এই কুরআনুল কারিমকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়া যায়। আসহাবে সুফ্ফার সম্মানিত সাহাবিগণ সারা দিন নবী করিম সা:-এর ভালোবাসার ছায়ায় থাকতেন। তারা কুরআনুল কারিমকে নিয়ে ভাবতেন এবং গবেষণা করতেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই কুরআনুল কারিমে জগতের সব কিছুকে তুলে ধরেছেন। যারা গবেষক তারা নিশ্চয়ই কুরআনুল কারিমের গবেষণা করে সব কিছু পেয়ে যাচ্ছেন। পৃথিবীর সব মহাপুরুষ কুরআনুল কারিমের চর্চা করে মহান রাব্বুল আলামিনের সর্বোচ্চ সান্নিধ্য পেয়েছেন। বিশ্বখ্যাত ফরাসি বিজ্ঞানী ড. মরিস বুকাইলি তার বিখ্যাত পুস্তক বাইবেল, বিজ্ঞান ও কুরআনে স্বীকার করেছেনÑ কুরআনুল কারিম একমাত্র পুস্তক, যা কখনোই বিকৃত হয়নি। মহান রাব্বুল আলামিন নিজেই কুরআনুল কারিমকে হেফাজতে রেখেছেন। একই সাথে তিনি এই পবিত্র কুরআনুল কারিমকে লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত করেছেন। সারা পৃথিবীর সব মহাপুরুষ, লেখক, গবেষকের কাছে কুরআনুল কারিম প্রতিদিন নতুন করে সবাইকে হেদায়াতের আলোতে আলোকিত করছে। অন্ধকারে যখন পথিক পথ হারিয়ে ফেলে তাকে যেমন চন্দ্র তার কিরণ দ্বারা পথ দেখিয়ে দেয়, তদ্রুপ উম্মতি মোহাম্মদির অনুসারীরা যখন পথ হারিয়ে ফেলে, তখন কুরআনুল কারিম তাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়ে দেয়। বাংলাদেশের প্রতিট বাড়িতে অত্যন্ত যতেœর সাথে কুরআনুল কারিম সংরক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু দু:খের বিষয় কেউ মারা না গেলে অথবা কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে কুরআনুল কারিম পাঠ করতে সহজে কাউকে দেখা যায় না। আমাদের উচিত প্রতিদন অন্তত একটিবারের জন্য হলেও অর্থসহ কুরআনুল কারিম পাঠ করা। যারা প্রতিদিন কুরআনুল কারিম চর্চা করছেন, পাঠ করছেন তাদেরকে হেদায়াতের পথ স্বয়ং কুরআনুল কারিম দেখিয়ে দেয়। একটি দেশে যখন আপনি ভ্রমণ করতে যাবেন তখন আপনার প্রয়োজন হবে একটি গাইডবুকের। কিন্তু সারা জীবন পৃথিবীতে যত দিন থাকবেন এবং অনন্ত অসীম পারলৌকিক জীবনে যদি সুখময় জীবন চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে-আমাকে, সবাইকে কুরআনুল কারিমকে সাথী করতে হবে। আমরা যদি কুরআনুল কারিমকে বরণ করে নিতে পারি তাহলে আমরা কখনো পথ হারাব না। সমগ্র পৃথিবীতে যে হানাহানি হচ্ছে তা বন্ধ হওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে কুরআনের আলোয় আলোকিত হওয়া। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে আমাদের বিনীত ফরিয়াদ- হে দয়াময় আল্লাহ, দয়া করে আপনি আমাদের হেদায়েত দান করুন। কুরআনুল কারিমের আলোয় আলোকিত করুন। আমাদের দেশের কুরআন পাঠকেরা, গবেষকেরা যদি আন্তর্জাতিক মানের কুরআনের তাফসির পড়তে চান তাহলে আজই সংগ্রহ করুন ,তাফসিরে তাফহীমুল কুরআন ,তাফসিরে ইবনে কাসির, তাফসিরে জালালাইন, প্রভৃতি তাফসির গ্রন্থ সংগ্রহ করে পড়তে পারেন। –
এবং শব্দে শব্দে কুরআনের অর্থ জানাও জরুরি কুরআন তেলাওয়াত অর্থাৎ পড়ার উদ্দেশ্য কি কেবল শব্দ পড়া, না কি অর্থ বুঝে পড়া? রাসূল (সাক্স) বলেছেন, কুরআনের প্রতিট অক্ষর পড়ার জন্য রয়েছে ১০টি নেকি। এটা কি অর্থ ছাড়া পড়ার জন্য, না কি অর্থসহ পড়ার জন্য, এটা কি আবার কেবল অর্থসহ বুঝার জন্য, না কি তা জীবনে প্রয়োগ করার জন্যও? আরবের লোকের মাতৃভাষা আরবি। তাই তারা আরবিতে লেখা কুরআন সহজে বুঝতে পারে। যেমন আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় লেখা কোন বই সহজেই বুঝতে পারি। কুরআন বাংলায় নাজিল হলে আমরা সহজে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থও বুঝতে পারতাম। উল্লেখ্য, আল্লাহ বলেছেন, রাসূলদের মাতৃভাষা অনুযায়ীই তাদের ওপর কিতাব ও সহিফা নাজিল হয়েছিল।
একটি বতলভর্তি মধু ছিপি দিয়ে বদ্ধ। এখন এ বোতলটার বাইরের অংশ চুষলে বা বোতলটি মুখে লাগালে কি মধু খাওয়া হবে? উদ্দেশ্য তো মধু খাওয়া। তাই ছিপি খুলে মধু খেতে হবে। তেমনি অর্থসহ কুরআন পড়লে প্রকৃত কোআন পড়া হবে। এবং তা হলেই হৃদয়-মন-কলব পরিপুষ্ট হবে। রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আন্তরিকতা সহকারে কলেমা পড়ে সে অবশ্য বেহশতে যাবে। সাহাবারা আন্তরিকতার অর্থ জানতে চাইলে তিনি বলেন, যখন কলেমার বাক্য মানুষকে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হারাম ও অবৈধ কর্ম থেকে বিরত রাখবে তখন তা আন্তরিকতা সহকারে পড়া হবে।রাসূল (সা:) এও বলেছেন, এমন দিন আসবে যখন ইসলামের কিছুই থাকবে না শুধু নাম ছাড়া ও কুরআনের বাহ্যিক রূপ ছাড়া। মুসলমানদের মসজিদগুলো হবে ভক্তি ও জ্ঞানশূন্য।
আল্লাহ কুরআনে (সূরা আনআম আয়াত ৫০) বলেছেন, ‘চক্ষুষ্মান ও অন্ধ কি সমান? তোমরা কি অনুধাবন করবে না?’ তেমনি সূরা মুহাম্মদ আয়াত ২৪-এ আল্লাহ বলেন, ‘তবে কি ওরা কুরআন সম্বন্ধে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা করে, না ওদের অন্তর তালাবদ্ধ? তোমরা কি ভেবে দেখবে না? (কাসাস-আয়াত ৭১-৭২)। এগুলো কি কুরআনের অর্থ ও তাৎপর্য জানার কথা বলে না? ইসলাম প্রথম পর্যায়ে আরব এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। পরে তা অন্যান্য ভাষাভাষী অঞ্চলে প্রসার লাভ করে। অর্থ ছাড়া পড়লেই যদি প্রতিট অক্ষরের জন্য ১০টি নেকি পাওয়া যায়, তাহলে অর্থসহ পড়লে কি অনেক বেশি নেকি পাওয়া যাবে না?
যে কোন বিবেকবান ব্যক্তি বলবেন, অবশ্য বেশি নেকি পাওয়া যাবে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, কোন কোন ধর্মবিশারদকে দেখেছি, কেবল কুরআন শব্দ পড়ার কথা বলেন। অর্থসহ পড়ার জন্য তেমন তাকিদই দেন না। ফলে সুখ ও শান্তিময় জীবন (ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক) নির্বাহের জন্য, সুষ্ঠু প্রশাসন, বিচার, অর্থনীতি ইত্যাদি ব্যবস্থার জন্য, উত্তম চরিত্র গঠনের জন্য শাশ্বত কল্যাণময় কুরআনে যে শত শত বিধিবিধান ও দিকনির্দেশনা রয়েছে, সেগুলো সম্বন্ধে আমরা অজ্ঞই থেকে যাই।
সমাজ থেকে তাই অসত্যতা, কুসংস্কার, কলুষতা, পঙ্কিলতা, অশান্তি, অস্থিরতা দূরীভূত না হয়ে বরং বেড়েই চলছে যদিও আমরা নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদির বাহ্যিক অনুষ্ঠানাদি পালন করে যাচ্ছি। মানুষ কে, কোথা থেকে এসেছে, তাকে এবং এ বিশ্ব জগৎকে কে সৃষ্টি করেছেন এবং নিয়ন্ত্রণ করছেন, ¯্রষ্টার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, সৃষ্টির সঙ্গে মানুষের কি সম্পর্ক কি, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কি? সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি, এ দুনিয়াই কি শেষ, নাকি মৃত্যুর পর আরেক জগৎ আছে, কারও কাছে মানুষের জবাবদিহিতা আছে কি ? ইত্যাদি অনেক মৌলিক, গূঢ়, সূক্ষ্ম ও জীবনধর্মী প্রশ্ন মনোজগতে জাগে। মানুষ যুগে যুগে এগুলো সম্পর্কে বিভিন্ন ভুল ও অস্বচ্ছ ধারণা পোষণ করে আসছিল। এগুলোর অকাট্য, সত্য ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান আমরা কুরআন পড়ে জানতে পারি। তেমনি কুরআনে প্রায় ৭০০টি বিজ্ঞানবিষয়ক আয়াত পড়লে আল্লাহর অস্তিত্ব একত্ব সার্বভৌমত্ব অসীমত্ব বিশালত্ব বিশ্বজগৎ পরিচালন প্রকৗশলী প্রভৃৃতি অবহিত হয়ে আল্লাহর প্রতি আমাদের বিশ্বাস দৃঢ়তর হয় এবং অনুগত্যে মাথা নত হয়ে আসে। তাই ঈমান তাজা রাখার জন্যে অর্থ জানা জরুরি। আসুন আমরা কুরআনের অর্থ ও তাফসির পড়ার জন্যে আমাদের দৈনন্দিনের রুটিনের মধ্যে এক ঘন্টা সময় নির্দ্বারিত করি , আজই আমরা তোবাহ করি এবং আল্লাহর কাছে সঠিক হেদায়েত পাওয়ার জন্যে প্রার্থনা করি । আমিন।