কুরআন শেখার গুরুত্ব ও  না শেখার পরিণতি

কুরআন শেখার গুরুত্ব ও  না শেখার পরিণতি

কুরআন শেখার গুরুত্ব ও  না শেখার পরিণতি

আল্লাহ তা‘আলার বড়ই মেহেরবান যে,তিনি আমাদের উপর কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। কুরআন এমন একটি কিতাব যার মাধ্যমে আরবের সেই জাহেলী জাতি সৌভাগ্যবান জাতিতে পরিণত হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন দিয়েই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ তৈরি করেছিলেন। এতো গুরুত্বপূর্ণ কিতাব কুরআনের শিক্ষা আজ অবহেলিত। দিন দিন আমরা কুরআন শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। একজন মুসলিম হিসাবে কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব ও যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারছি না। সেজন্য আমাদেরকে কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে।

আল কুরআনের পরিচয় :

কুরআন শব্দের অর্থ: পাঠ করা, যা পাঠ করা হয়। আর পরিভাষায়-আল্লাহ তা‘আলা জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে সুদীর্ঘ ২৩ বছরে মানব জাতির হেদায়াত হিসাবে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তার নাম আল কুরআন।

আল-কুরআন কি?
এ প্রশ্নের জবাব স্বয়ং কুরআনই দিয়েছে। কুরআনের ভাষায়إِنَّهُ لَقُرْ‌آنٌ كَرِ‌يمٌ  فِي كِتَابٍ مَّكْنُونٍ
‘নিঃসন্দেহ এটি তো এক সম্মানিত কুরআন, এক সুরক্ষিত গ্রন্থে। [সূরা ওয়াকিয়া : ৭৭-৭৮]

১. কুরআন আল্লাহর কিতাব :

আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে মানবতার হেদায়াতের জন্য যেসব কিতাব অবতীর্ণ করেছেন সেগুলোকে আসমানী কিতাব বলা হয়। আল-কুরআন হলো সর্বশেষ আসমানী কিতাব, যা বিশ্বমানবতার জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :  وَإِنَّهُ لَتَنْزِيْلُ رَبِّ ٱلعَٰلَمِينَ [الشعراء

অর্থ:‘নিশ্চয় এ কুরআন বিশ্ব জাহানের রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা হয়েছে’ [আশ-শু‘আরা ১৯২]

২. কুরআন হলো নূর বা আলো :

অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতিকে সত্যিকার আলোর দিকে নিয়ে আসার জন্য আল-কুরআন হলো আলো বা নূর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿ قَدْ جَاءَكُم مِّنَ اللهِ نُورٌ‌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ * يَهْدِي بِهِ اللهُ مَنِ اتَّبَعَ رِ‌ضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلَامِ وَيُخْرِ‌جُهُم مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ‌ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَىٰ صِرَ‌اطٍ مُّسْتَقِيمٍ ﴾ [المائ‍دة: ١٥،  ١٦]

‘অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো ও সুস্পষ্ট গ্রন্থ এসেছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে শান্তির পথ দেখান, যারা তাঁর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে এবং তাঁর অনুমতিতে তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করেন। আর তাদেরকে সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন’ [সূরা মায়িদাহ-১৫,১৬]।

৩. কুরআন সংরক্ষণ করার দায়িত্ব আল্লাহ তাআলার :

কুরআন যাবতীয় বিকৃতি থেকে মুক্ত। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এর সংরক্ষণ করবেন। কুরআনে বলা হয়েছে:

       إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ 

 ‘নিশ্চয় আমি উপদেশ বাণী তথা কুরআন নাযিল করেছি এবং নিঃসন্দেহে এর হেফাজতকারী আমি নিজেই’ [সূরা আল-হিজর-৯]।

৪. কুরআনে রয়েছে সর্ববিষয়ে জ্ঞানের ভাণ্ডার মানবজাতির জন্য হেদায়াত :

আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবন কীভাবে পরিচালিত হবে, তার প্রতিটি বিষয় কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِّكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَ‌حْمَةً وَبُشْرَ‌ىٰ لِلْمُسْلِمِينَ ﴿٨٩

‘আমি তোমার নিকট কিতাবটি নাযিল করেছি। এটি এমন যে তা সবকিছুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, আর এটা হেদায়াত, রহমত ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ স্বরূপ’ [সূরা আননাহল: ৮৯]।

৫. কুরআন এমন মহান কিতাব যা সর্ব রোগের মহৌষধ ও মুমিনদের জন্য রহমাত : 

কুরআন বিশ্ববাসীর জন্য রহমাত হিসাবে নাযিল করা হয়েছে। যারা এ কুরআন পড়বে, তা অনুযায়ী আমল করবে তারা আল্লাহর রহমাতপ্রাপ্ত হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿ وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْ‌آنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَ‌حْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ ۙ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارً‌ا  ﴾ [الاسراء: ٨٢] 

‘আর আমি কুরআন নাযিল করি যা মুমিনদের জন্য শিফা ও রহমত, কিন্তু তা যালিমদের ক্ষতিই বাড়িয়ে দেয়’ [সূরা বনি ঈসরাইল:৮২]।

৬. কুরআন জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস : 

কুরআন মাজীদ সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস। এবং কুরআন যে নির্দেশনা দিয়েছে তা নির্ভুল ও বাস্তবভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, ﴿ يسٓ  وَٱلقُرءَانِ ٱلحَكِيمِ  ﴾ [يس: ١،  ٢] 

অর্থ: ‘ইয়া-সীন। বিজ্ঞানময় কুরআনের শপথ’ [সূরা ইয়াছিন:১-২]।

৭. কুরআন শিক্ষা সহজ

যারা কুরআন শিক্ষা করতে চান বা দিতে চান, তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা সহজ করে দিয়েছেন। বুঝমান যেকোন বয়সের মানুষ তা শিখতে পারবে। কুরআনে ঘোষণা:

 ﴿ َ وَلَقَدْ يَسَّرْ‌نَا الْقُرْ‌آنَ لِلذِّكْرِ‌ فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍ‌ ﴾ [القمر: ١٧]

‘আর আমি তো কুরআন শেখার জন্য সহজ করে দিয়েছি। অতএব কোন উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি’? [সূরা আল-ক্বামার:১৭]

কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব

১. কুরআন শিক্ষা ফরয :

প্রত্যেক মুসলিমকে কুরআন পড়া জানতে হবে। যে নিজেকে মুসলিম হিসাবে দাবী করবে তাকে অবশ্যই কুরআন শিক্ষা করতে হবে। কুরআন শিক্ষা করা এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, আল্লাহ তা‘আলা কুরআন শিক্ষা করা ফরয করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

  اقْرَ‌أْ بِاسْمِ رَ‌بِّكَ الَّذِي خَلَقَ ﴾ [العلق: ١  

‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ [সূরা আলাক : ১]।

কুরআন শিক্ষায় কোন প্রকার অবহেলা করা যাবে না। উম্মাতকে কুরআন শিক্ষার নির্দেশ দিয়ে ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, «تَعَلَّمُوا الْقُرْآنَ ، وَاتْلُوهُ»

অর্থ:‘তোমরা কুরআন শিক্ষা কর এবং তিলাওয়াত কর’ [মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ:৮৫৭২]।

২. সালাত আদায়ের জন্য কুরআন শিক্ষা:

আল্লাহ তা‘আলা ঈমানদার বান্দাহদের উপর প্রতিদিন পাচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। কুরআন তেলাওয়াত ছাড়া সালাত আদায় হয় না। সালাত আদায় করার জন্যও কুরআন শিখতে হবে। কুরআনে বলা হয়েছে, ﴿ فَاقْرَ‌ءُوا مَا تَيَسَّرَ‌ مِنَ الْقُرْ‌آنِ﴾ [المزمل: ٢٠]

‘অতএব তোমরা কুরআন থেকে যতটুকু সহজ ততটুকু পড়’[সূরা আল-মুযযাম্মিল: ২০]।

এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ».

অর্থ: ‘যে ব্যক্তি সূরা ফাতেহা পড়ে না তার সালাতই হয় না’। [সহীহ বুখারী:৭৫৬]

৩. কুরআন প্রচারের জন্য শিক্ষা করা :

কুরআন মাজীদে কুরআন প্রচারের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সে নির্দেশের আলোকে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম কুরআন প্রচার-প্রসারে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছেন। যে ব্যক্তি কুরআন পড়তে জানে না,সে কীভাবে তা প্রচার করবে? সুতরাং কুরআন প্রচার-প্রসারে ভূমিকা পালন করার জন্য তা শিক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন। কুরআনে বলা হয়েছে, ﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلرَّسُولُ بَلِّغْ مَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ ﴾ [المائ‍دة: ٦٧] হে রাসূল, তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে, তা পৌঁছে দাও [সূরা মায়িদাহ : ৬৭]।

৪. কুরআন শিক্ষা অন্তরের প্রশান্তি :

মানব জীবনে অর্থ বা অন্যান্য কারণে জাগতিক তৃপ্তি আসলেও প্রকৃত তৃপ্তি ও শান্তি কুরআন শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। এজন্য কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿ الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ‌ اللَّـهِ ۗ أَلَا بِذِكْرِ‌ اللَّـهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ ﴾ [الرعد: ٢٨]  

যারা ঈমান আনে,বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে। জেনে রাখ,আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়’ [সূরা আর-রা‘দ:২৮]।

৫. হেদায়াত লাভের জন্য কুরআন শিক্ষা :

কুরআনের মাধ্যমেই হেদায়াতের সন্ধান পাওয়া যাবে। সেজন্য কুরআন থেকে হেদায়াত পাবার জন্য কুরআন শিক্ষা করতে হবে । কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿ إِنَّ هَـٰذَا الْقُرْ‌آنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ ﴾ [الاسراء: ٩] 

 ‘নিশ্চয় এ কুরআন এমন পথ-প্রদর্শন করে,যা সর্বাধিক সরল ও সঠিক’।[সূরা বনি-ইসরাঈল:০৯]

৬. জান্নাতে যাওয়ার জন্য কুরআন শিক্ষা:

প্রত্যেক মুমিনের সর্বোচ্চ কামনা হলো জান্নাতে যাওয়া। তাই  জান্নাতে যাওয়ার  জন্য কুরআন শিক্ষা করতে হবে। হাদীসে এসেছে,

«اَلصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَقُولُ الصِّيَامُ أَيْ رَبِّ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ وَيَقُولُ الْقُرْآنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ قَالَ فَيُشَفَّعَانِ»

সিয়াম ও কুরআন কিয়ামাতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে হে আমার রব, আমি দিনের বেলায় তাকে পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবূল কর। অনুরূপভাবে কুরআন বলবে, হে আমার রব,আমাকে অধ্যয়নরত থাকায় রাতের ঘুম থেকে আমি তাকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবূল কর। তিনি বলেন, অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবূল করা হবে [মুসনাদ আহমাদ: ৬৬২৬]।

কুরআন শিক্ষা ও তিলাওয়াতের ফযীলত

১. কুরআন তিলাওয়াত আল্লাহর সাথে একটি লাভজনক ব্যবসা:

বিভিন্ন ব্যবসায় লাভ এবং ক্ষতি দুটিরই সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এখানে লাভ ছাড়া কোন প্রকার ক্ষতির অংশ নেই। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَتْلُونَ كِتَٰبَ ٱللهِ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنْفَقُواْ مِمَّا رَزَقْنَٰهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً  يَرْجُونَ تِجَارَةً لَّنْ تَبُوْرَ * لِيُوَفِّيَهُمْ أُجُورَهُمْ وَيَزِيْدَهُمْ مِّنْ فَضْلِهِ ۚ إِنَّهُۥ غَفُورٌ شَكُوْرٌ ﴾ [فاطر: ٢٩،.٣] 

‘‘যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে,সালাত কায়েম করে,আমার দেয়া রিজিক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে,তারাই আশা করতে পারে এমন ব্যবসার যা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরো অধিক দান করবেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান।’’ [সূরা ফাতির ২৯-৩০]

২. কুরআন পাঠকারী প্রত্যেক হরফের জন্য সওয়াব লাভ করে: 

কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে বিরাট সওয়াব অর্জন করার সুযোগ রয়েছে। এর সাথে অনেক উপকারিতাও রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ»

‘‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করে,তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে,আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ,লাম একটি হরফ,মীম একটি হরফ।’’[সুনান আত-তিরমিযি:২৯১০]

৩. কুরআনের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সর্বোত্তম ব্যক্তি:

কুরআন শিক্ষার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা যায়। উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা,) বলেছেন,   «خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ»

‘‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়’’ [বুখারী: ৫০২৭]।

৪. কুরআন, তিলাওয়াতকারীর পক্ষে সুপারিশ করবে :

কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াতকারীর পক্ষে সুপারিশ করবে।এটা বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : «اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لِأَصْحَابِهِ»

অর্থ:‘তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর, কারণ, কুরআন কেয়ামতের দিন তিলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে’ [মুসলিম: ১৯১০]।

৫. কুরআন পড়া উত্তম সম্পদ অর্জন

কুরআন পড়া বা শিক্ষা দেয়ার কাজে নিয়োজিত থাকা উত্তম সম্পদ অর্জন করার অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«أَيُّكُمْ يُحِبُّ أَنْ يَغْدُوَ كُلَّ يَوْمٍ إِلَى بُطْحَانَ أَوْ إِلَى الْعَقِيقِ فَيَأْتِيَ مِنْهُ بِنَاقَتَيْنِ كَوْمَاوَيْنِ فِي غَيْرِ إِثْمٍ وَلَا قَطْعِ رَحِمٍ فَقُلْنَا يَا رَسُولَ اللهِ نُحِبُّ ذَلِكَ قَالَ أَفَلَا يَغْدُو أَحَدُكُمْ إِلَى الْمَسْجِدِ فَيَعْلَمُ أَوْ يَقْرَأُ آيَتَيْنِ مِنْ كِتَابِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ خَيْرٌ لَهُ مِنْ نَاقَتَيْنِ وَثَلَاثٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ ثَلَاثٍ وَأَرْبَعٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَرْبَعٍ وَمِنْ أَعْدَادِهِنَّ مِنْ الْإِبِلِ»

‘তোমাদের কোন ব্যক্তির এটা পছন্দ যে,সে আল্লাহর অবাধ্যতা ছাড়াই এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট না করে বুতহান অথবা আকিক প্রান্তরে গিয়ে দু‘টো টিলা বিশিষ্ট উট নিয়ে আসবে? আমরা বললাম, আমাদের সবারই তা পছন্দ। তিনি বললেন, তোমাদের কেউ প্রতিদিন মসজিদে গিয়ে কিতাবুল্লাহ হতে দু‘টো আয়াত শেখা কিংবা পড়া দু‘উটের চেয়েও তার জন্য উত্তম। আর তিনটি আয়াত তিনটি উটের চেয়ে এবং চারটি আয়াত চারটি উটের চেয়ে উত্তম। আর যতোগুলো আয়াত সে অধ্যয়ন করবে তা সমসংখ্যক উটের চেয়ে উত্তম। সহীহ মুসলিম : ১৩৩৬]।

 কুরআন শিক্ষা না করার পরিণতি

১. তাদের বিরুদ্ধে রাসূলের অভিযোগ পেশ :

কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিতে রাসূলুল্লাহ (সা.) উম্মাতের জন্য শাফায়াত চাইবেন। কিন্তু যারা কুরআন শিক্ষা করেনি, কুরআনের যেসব হক রয়েছে তা আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন নবী (সা.) তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ পেশ করবেন। কুরআনে এসেছে , মহান আল্লাহ বলেন:

 ﴿ وَقَالَ الرَّ‌سُولُ يَا رَ‌بِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَـٰذَا الْقُرْ‌آنَ مَهْجُورً‌ا﴾ [الفرقان: ٣٠]

 ‘আর রাসূল বলবেন, হে আমার রব,নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে’ [সূরা আল-ফুরকান-৩০]

ইবন কাসীর (রহ.) বলেন, কুরআন না পড়া, তা অনুসারে আমল না করা, তা থেকে হেদায়াত গ্রহণ না করা,এ সবই কুরআন পরিত্যাগ করার শামিল।

২. কিয়ামতে অন্ধ হয়ে উঠবে :

যে কুরআন শিখা থেকে থেকে বিমুখ হয়ে থাকল, সে কতইনা দুর্ভাগা! আলকুরআনে এসেছে,

﴿ وَمَنْ أَعْرَ‌ضَ عَن ذِكْرِ‌ي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُ‌هُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَىٰ ﴿١٢٤﴾ قَالَ رَ‌بِّ لِمَ حَشَرْ‌تَنِي أَعْمَىٰ وَقَدْ كُنتُ بَصِيرً‌ا ﴿١٢٥﴾ قَالَ كَذَٰلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا ۖ وَكَذَٰلِكَ الْيَوْمَ تُنسَىٰ ﴾  [طه: ١٢٤،  ١٢٦]   

আর যে আমার যিকর (কুরআন) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে,  নিশ্চয় তার জীবন-যাপন হবে  সংকুচিত এবং আমি কিয়ামতের দিন তাকে অন্ধ অবস্থায় উঠাবো। সে বলবে, হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন ? অথচ আমিতো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্নণ? তিনি বলবেন,  অনুরূপভাবে তোমার নিকট আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, অতঃপর তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল’ [সূরা তাহা-১২৪-১২৬]।

৩. মূকবধির অবস্থায় উঠবে:

সবচেয়ে বড় হেদায়েত আল-কুরআন প্রত্যাখ্যানকারীদের কবর হবে সংকীর্ণ, যার দরুন তাদের দেহের পাঁজরগুলো বাঁকা হয়ে যাবে। অবশেষে কিয়ামতের দিন মূক ও বধির হয়ে উঠবে । আলকুরআনে এসেছে :

وَنَحْشُرُ‌هُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَىٰ وُجُوهِهِمْ عُمْيًا وَبُكْمًا وَصُمًّا ۖ مَّأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ ۖ كُلَّمَا خَبَتْ زِدْنَاهُمْ سَعِيرً‌ا [الاسراء: ٩٧] 

আমি কিয়ামতের দিন তাদেরকে সমবেত করব তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায়,অন্ধ অবস্থায়,মূক অবস্থায়,বধির অবস্থায়। তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম। যখন জাহান্নামের আগুন নির্বাপিত হওয়ার উপক্রম হবে আমি তখন তাদের জন্য অগ্নি আরও বাড়িয়ে দেব। [সূরা বনি-ঈসরাইল:৯৭]

৪. তারা গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত :

কুরআন শিক্ষা না করা গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শামিল। কুরআনে এসেছে,

أُولَـٰئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ ۚ أُولَـٰئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ ﴾ [الاعراف: ﴿١٧٩]

‘এরা চতুস্পদ জন্তুর ন্যায় বরং এরা তাদের চেয়েও আরো অধম ও নিকৃষ্ট এরাই হলো গাফেল’ [সূরা আরাফ-১৭৯] ।

৫. কুরআন তার বিরুদ্ধে দলীল বা প্রমাণ হিসাবে আসবে :

কুরআন শিক্ষা থেকে বিরত থাকার কারণে কুরআন তার বিপক্ষের দলীল হিসাবে উপস্থিত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন : «وَالْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ»

কুরআন তোমার পক্ষে কিংবা বিপক্ষের দলীল।   [সহীহ মুসলিম: ৩২৮ ]

৬. জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে :

জাহান্নামের মত ভয়াবহ কঠিন জায়গা আর নেই। কুরআন শিক্ষা না করার কারণে জাহান্নামে যেতে হবে। নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«الْقُرْآنُ شَافِعٌ مُشَفَّعٌ ، وَمَا حِلٌ مُصَدَّقٌ ، مَنْ جَعَلَهُ إِمَامَهُ قَادَهُ إِلَى الْجَنَّةِ ، وَمَنْ جَعَلَهُ خَلْفَ ظَهْرِهِ سَاقَهُ إِلَى النَّارِ.»

অর্থ: ‘কুরআন সুপারিশকারী এবং তাঁর সুপারিশ গ্রহণযোগ্য। সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআনকে সামনে রেখে তাঁর অনুসরণ করবে, কুরআন তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি একে নিজ পশ্চাতে রেখে দিবে, কুরআন তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে’ [সহীহ ইবনে হিববান : ১২৪]।

৭. আখেরাতে জবাবদিহি করতে হবে:

কুরআন শিক্ষায় যথাযথ ভূমিকা পালন না করলে এ বিষয়ে আখেরাতে জবাবদিহি করতে হবে । তা‘আলা বলেন, ﴿ وَإِنَّهُ لَذِكْرٌ‌ لَّكَ وَلِقَوْمِكَ ۖ وَسَوْفَ تُسْأَلُونَ ﴾ [الزخرف: ٤٤] 

অর্থ: নিশ্চয় এ কুরআন তোমার জন্য এবং তোমার কওমের জন্য উপদেশ। আর অচিরেই তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে। [সূরা যুখরুফ : ৪৪]

কুরআন শিক্ষায় করণীয়

১. ভাল শিক্ষকের কাছে পড়া:

যিনি সহীহভাবে কুরআন পড়তে পারেন তার নিকটই কুরআন শিক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে যে শিক্ষকের কুরআন শিক্ষার বিষয়ে প্রশিক্ষণ আছে তার কাছে পড়লে আরো ভাল হয়।

২. নিয়মিত পড়া : 

সহীহভাবে কুরআন শিক্ষার জন্য নিয়মিত সময় দেয়া দরকার। যদিও কম সময় হয়। প্রতিদিন শেখার মধ্যে থাকলে সহীহভাবে কুরআন শিক্ষা সহজ হবে এবং যা শেখা হবে তা আয়ত্ত্বে থাকবে।

৩. মশক করা :

কোন যোগ্য শিক্ষকের কাছে মশক করলে পড়ার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। মশক হলো- শিক্ষক পড়বে তারপর সেভাবে ছাত্রও পড়বে। এ ছাড়া বিভিন্ন সিডির মাধ্যমেও মশক করা যায়। এক্ষেত্রে বিশ্ববিখ্যাত ক্বারী মুহাম্মাদ সিদ্দিক মানশাওয়াভীর কুরআন প্রশিক্ষণ সিডির সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে।

৪. পরিবার পরিজন ও সন্তানদের শিক্ষা দেয়া: 

প্রত্যেক মুসলিমকে তার পরিবার পরিজন ও সন্তানদের কুরআন শিক্ষা দেয়া অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। কুরআনে এসেছে,

﴿ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارً‌ا ﴾ [التحريم: ٦] 

হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও’ [সূরা তাহরীম-৬]।

আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,

«عَلَيْكُم بِالْقُرْآنِ ، فَتَعَلَّمُوْهُ وَعَلِّمُوْهُ أَبْنَائَكُمْ ، فَإِنَّكُمْ عَنْهُ تُسْأَلُوْنَ ، وَبِهِ تُجْزَوْنَ»

কুরআনের বিষয়ে তোমাদের উপর অবশ্য পালনীয় এই যে, কুরআন শিক্ষা করা এবং তোমাদের সন্তানদের কুরআন শিক্ষা দেয়া। কেননা এ বিষয়ে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে এবং তার প্রতিদানও দেয়া হবে। [শরহে সহীহ বুখারী, ইবন বাত্তাল : ৪৬]

৫. ফযীলাতপূর্ণ সূরাগুলো বেশি বেশি তেলাওয়াত করা : 

ফযীলতপূর্ণ সূরাগুলো ভালোভাবে শিক্ষা করা এবং সেগুলো বেশি বেশি তিলাওয়াত করা। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

«أَيَعْجِزُ أَحَدُكُمْ أَنْ يَقْرَأَ فِى لَيْلَةٍ ثُلُثَ الْقُرْآنِ. قَالُوا  :وَكَيْفَ يَقْرَأُ ثُلُثَ الْقُرْآنِ قَالَ : (قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ) يَعْدِلُ ثُلُثَ الْقُرْآنِ.»

‘তোমাদের কেউ কি রাত্রিকালে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াতে অক্ষম? তারা বললেন, কুরআনের এক তৃতীয়াংশ কিভাবে পড়া পড়বে তিনি বললেন, (সূরা ইখলাস) কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল্য’ [সহীহ বুখারী: ৫০১৫] ।

অতএব যেসব সূরা ও আয়াত সম্পর্কে অধিক ফযীলত ও বেশি নেকীর কথা বর্ণিত হয়েছে এবং যেগুলো ভালোভাবে শেখা ও বেশি বেশি পড়া দরকার তার মধ্যে রয়েছে, শুক্রবার ফজর নামাজে সূরা আলিফ-লাম-সিজদাহ পড়া, ঘুমানোর আগে সূরা মুলক এবং ফরয নামাজের পর সূরা নাস, সূরা ফালাক ও আয়াতুল কুরসী পড়া।  আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে কুরআন শিক্ষার তাওফীক দিন। আমীন।

Related Post