কুরবানীর মাধ্যমে প্রতিটি মুসলিম পরিবারের আল্লাহর হুকুমের কাছে আত্মসমর্পণ করাই হবে একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। আল্লাহর হুকুমের বাইরে অন্য কোন মত ও পথের কাছে তাদের মাথা নত করা যাবে না। এর পাশাপাশি তাদের দায়িত্ব হবে আত্মত্যাগে উজ্জীবিত হওয়া, মানবিক কল্যাণ সাধন করা, সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা এবং সৌভ্রাতৃত্বের বাঁধনকে আরো সুদৃঢ় করা। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ) এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন তাঁর সন্তানদের।
১. যার ওপর ফিতরা ওয়াজিব তার ওপর কুরবানীও ওয়াজিব। (অর্থাৎ ১০ জিলহজের ফজর থেকে ১২ জিলহজের সন্ধ্যা পর্যন্ত পারিবারিক প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী বাদ দিয়ে কোনো ব্যক্তি যদি ‘নেসাব’ পরিমাণ মালের মালিক হয়, তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। (শরিয়তের ভাষায় নেসাব পরিমাণ মাল বলা হয়, সাড়ে ৫২ তোলা রুপা অথবা সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণ কিংবা তৎসম মূল্যের সম্পত্তি।)
কিন্তু ওয়াজিব না হওয়া সত্ত্বেও যদি কুরবানী করে, তবে নফল কুরবানীর জন্য অনেক সওয়াব পাবে।
২. ১০ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজের সন্ধ্যা পর্যন্ত এ তিন দিন কুরবানী করার সময়। কিন্তু প্রথম দিন সর্বাপেক্ষা উত্তম, তারপর দ্বিতীয় দিন, তারপর তৃতীয় দিন।
৩. নিজের কুরবানীর পশু নিজ হাতেই জবাই করা মুস্তাহাব। যদি নিজে জবাই করতে না পারে, তবে অন্যের দ্বারা জবাই করবে, কিন্তু নিজে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো। কুরবানীদাতা মেয়েলোক পর্দার ব্যাঘাত হয় বলে যদি সামনে উপস্থিত না থাকতে পারে, তবে তাতে কোনো ক্ষতি নেই।
৪. কুরবানী করার সময় মুখে নিয়ত করা ও দোয়া উচ্চারণ করা জরুরি নয়। যদি মনে মনে চিন্তা করে নিয়ত করে এবং মুখে শুধু ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করে তবুও কুরবানী জায়েয হয়ে যাবে।
৫. কুরবানী শুধু নিজের পক্ষ থেকে ওয়াজিব হয়। এমনকি নাবালেগ সন্তান যদি ধনী হয়, তবুও তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। যদি কেউ সন্তানের পক্ষ থেকে কুরবানী করতে চায় তবে তা নফল কুরবানী হবে। কিন্তু নাবালেগের মাল থেকে কিছুতেই কুরবানী করবে না।
৬. ছাগল, পাঁঠা, খাসি, ভেড়া, দুম্বা, গাভী, ষাঁড়, বলদ, মহিষ, উট এই কয় প্রকার গৃহপালিত পশু কুরবানী করা জায়েয আছে। এ ছাড়া হরিণ ইত্যাদি হালাল বন্য জন্তুর দ্বারা কুরবানী আদায় হবে না।
৭. গরু, মহিষ ও উট এই তিন প্রকার পশুর এক একটিতে এক থেকে সাতজন পর্যন্ত শরিক হয়ে কুরবানী করতে পারবে। তবে কুরবানী জায়েয হওয়ার জন্য শর্ত এই যে, কারো অংশ যেন সাত ভাগের এক ভাগের চেয়ে কম না হয় এবং কারো যেন গোশত খাওয়ার নিয়ত না হয়। সবার যেন কুরবানীর নিয়ত থাকে। অবশ্য যদি কারো আকিকার নিয়ত হয়, তবে তাও জায়েয আছে। (কারো কারো মতে, তবে বিশুদ্ধ মতানুযায়ী আকীকা সন্তান জন্মের সপ্তম দিন ছাগল দিয়ে করতে হবে। ) কিন্তু যদি শুধু গোশত খাওয়ার নিয়ত হয়, কুরবানী বা আকিকার নিয়ত না হয়, তবে কারো কুরবানী জায়েয হবে না। এভাবে যদি শুধু একজনের অংশ সাত ভাগের এক ভাগের চেয়ে কম হয়, তবে সবার কুরবানী নষ্ট হয়ে যাবে।
৮. যদি গরু খরিদ করার সময় অন্যকে শরিক করার ইচ্ছা না থাকে, একা একাই কুরবানী করার নিয়ত থাকে, পরে অন্যকে শরিক করতে চায় এমতাবস্থায় যদি ওই ক্রেতা গরিব হয় অর্থাৎ তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব না হয়, তবে পরে সে অন্য কাউকেও শরিক করতে পারবে না, একা একাই পশুটি কুরবানী করতে হবে। আর যদি ওই ক্রেতা ধনী হয় অর্থাৎ তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হয়, তবে ইচ্ছা করলে পরে অন্য শরিকও নিতে পারবে।
(তবে নেক কাজে যতটুকু পারা যায় জায়েয থাকলেও নিয়ত পরিবর্তন না করাই ভালো।)
৯. যদি কুরবানীর পশু হারিয়ে যায় ও তৎপরিবর্তে অন্য একটি খরিদ করে, এরপর প্রথম পশুটিও পাওয়া যায়, এমতাবস্থায় যদি ক্রেতার ওপর কুরবানী ওয়াজিব থাকে, তবে একটি পশু কুরবানী করা ওয়াজিব হবে। যদি ক্রেতার ওপর কুরবানী ওয়াজিব না থাকে, তবে উভয় পশু কুরবানী করা তার জন্য ওয়াজিব।
১০. ছাগল পূর্ণ এক বছরের কম হলে জায়েয হবে না। গরু, মহিষ দুই বছরের কম হলে জায়েয হবে না। উট পাঁচ বছরের কম হলে জায়েয হবে না। দুম্বা এবং ভেড়ার হুকুম ছাগলের মতো; কিন্তু ছয় মাসের বেশি বয়সের দুম্বার বাচ্চা যদি এরূপ মোটা তাজা হয় যে, এক বছরের দুম্বার মধ্যে ছেড়ে দিলে চেনা যায় না, তবে সেরূপ দুম্বার বাচ্চা কুরবানী জায়েয আছে।
১১. যে পশুর দু’টি চোখ অন্ধ, অথবা একটি চোখ পূর্ণ অন্ধ বা একটি চোখের তিন ভাগের এক ভাগ বা আরো বেশি দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে, সে জন্তুর কুরবানী জায়েয নয়। অনুরূপভাবে যে পশুর একটি কানের বা লেজের এক-তৃতীয়াংশ বা তদপেক্ষা বেশি কেটে গিয়েছে সে পশু দ্বারা কুরবানী জায়েয নয়।
১২. যে পশু এমন খোঁড়া যে, মাত্র তিন পায়ের ওপর ভর দিয়ে চলে, চতুর্থ পা মাটিতে লাগেই না, অথবা মাটিতে লাগে বটে, কিন্তু তার ওপর ভর দিতে পারে না, এরূপ পশু দ্বারা কুরবানী জায়েয নয়। আর যদি খোঁড়া পায়ের ওপর ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে চলে, তবে সে পশুর কুরবানী জায়েয আছে।
১৩. যে পশুর একটি দাঁতও নেই, সে পশু দ্বারা কুরবানী জায়েয নেই। আর যতগুলো দাঁত পড়ে গেছে তা অপেক্ষা যদি অধিকসংখ্যক দাঁত বাকি থাকে, তবে কুরবানী জায়েয আছে।
১৪. যে পশুর কান জন্ম থেকে নেই, তার কুরবানী জায়েয নেই। কান হয়েছে কিন্তু অতি ছোট; তার দ্বারা কুরবানী জায়েয আছে।
১৫. যে পশুর শিং ওঠেইনি বা শিং উঠেছিল, কিন্তু কিছু ভেঙে গেছে তার দ্বারা কুরবানী জায়েয আছে। অবশ্য যদি একেবারে মূল থেকে ভেঙে যায়, তার দ্বারা কুরবানী জায়েয নেই।
১৬. যে পশুকে খাসি বানানো হয়েছে তার দ্বারা কুরবানী জায়েয আছে। এভাবে যে পশুর গায়ে বা কাঁধে দাদ বা খুজলি হয়েছে তার দ্বারা কুরবানী জায়েয আছে। অবশ্য খুজলির কারণে যদি পশু একেবারে কৃশ বা দুর্বল হয়ে যায় তার দ্বারা কুরবানী জায়েয নেই।
১৭. ভালো পশু ক্রয় করার পর যদি এমন কোনো দোষ এসে পড়ে যে কারণে কুরবানী জায়েয হয় না, এমতাবস্থায় ক্রেতার অবস্থা যদি এমন হয় যে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব, তাহলে ওই পশুটি রেখে অন্য একটি পশু কিনে কুরবানী করতে হবে। অবশ্য যার ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়, নিজেই আগ্রহ করে কুরবানী করার জন্য কিনেছে, সে ওই পশুটিই কুরবানী করে দেবে। অন্য আরেকটি কেনার দরকার নেই।
১৮. কুরবানীর পশু জবাইকারী ও গোশত প্রস্তুতকারীর পারিশ্রমিক পৃথকভাবে দেবে, কুরবানীর গোশত, চামড়া, মাথা বা পায়া দ্বারা দেবে না। তবে উক্ত কুরবানীর গোশত তাদেরকে কোনো বদলা ছাড়া দান করা বা দাওয়াত করে খাওয়াতে পারবে।
১৯. কুরবানীর পশুর গায়ে যদি দড়ি বা কোনো পোশাক থাকে তাহলে তা গরিবদেরকে দিয়ে দেবে, নিজে ব্যবহার করবে না।
২০. গর্ভবতী পশু কুরবানী করা জায়েয আছে। যদি পেটের বাচ্চা জীবিত পাওয়া যায়, তবে সে বাচ্চাও জবাই করে দেবে।
২১. কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের, একভাগ আত্মীয়স্বজনের ও এক ভাগ গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া মুস্তাহাব। কুরবানীর চামড়া বা তার নগদ অর্থ গরিব-দুঃখীদের দান করে দিতে হবে। (এ ব্যাপারে বিশেষ করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত এতিম অসহায় গরিব শিক্ষার্থীদের খেয়াল করা উচিত। কারণ তারা এর মাধ্যমে দ্বীনি শিক্ষা অর্জনে বিশেষভাবে উপকৃত হয়। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত এবং দীন-দুঃখীদেরও দেয়া যেতে পারে।)
শেষকথা
কুরবানীর মাধ্যমে প্রতিটি মুসলিম পরিবারের আল্লাহর হুকুমের কাছে আত্মসমর্পণ করাই হবে একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। আল্লাহর হুকুমের বাইরে অন্য কোন মত ও পথের কাছে তাদের মাথা নত করা যাবে না। এর পাশাপাশি তাদের দায়িত্ব হবে আত্মত্যাগে উজ্জীবিত হওয়া, মানবিক কল্যাণ সাধন করা, সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা এবং সৌভ্রাতৃত্বের বাঁধনকে আরো সুদৃঢ় করা। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ) এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন তাঁর সন্তানদের। সুতরাং আমরা যেন নিছক লৌকিকতা, আত্মম্ভরিতা, বাহাদুরি ও প্রতিযোগিতামূলক রক্তক্ষরণ ও গোশত ভক্ষণ করে মহান ঈদুল আজহার তাৎপর্য ও শিক্ষাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত না করি। ইবরাহিমি ঈমান ও ইসমাইলি আত্মত্যাগের উত্থান যদি আবার জাগ্রত হয়, তবে আধুনিক জাহেলিয়াতের গাঢ় তমসা ভেদ করে পুনরায় মানবতার বিজয়নিশান উড্ডীন হবে। সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরে আসবে। তাই কুরবানীর পশুর গলায় ছুরি দেয়ার আগে নিজেদের মধ্যে লুক্কায়িত পশুত্বের গলায় ছুরি দিতে হবে। মহান আল্লাহর দরবারে আত্মসমর্পণকারী ও আত্মত্যাগী হতে হবে। তাকওয়া ও আল্লাহভীতি অর্জনের মাধ্যমে প্রকৃত মুমিন বা মুত্তাকি হতে হবে। আমাদের নামাজ, কুরবানী, জীবন-মরণ সবকিছু আল্লাহর জন্যই উৎসর্গ হোক, ঈদুল আজহায় মহান রবের নিকট এই থাকুক প্রার্থনা।