সহিষ্ণুতা শব্দটি ব্যাপক অর্থ বহন করে। আভিধানিক অর্থে সহ্যকরণ, ধৈর্যধারণ, বরদাস্তকরণ,ইত্যাদি বোঝায়। ইংরেজি endure আর আরবি ‘সবর’ শব্দদ্বয় সহিষ্ণুতা শব্দের সমার্থক। সহিষ্ণুতা নিঃসন্দেহে মানবিক গুণাবলির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম এবং সামাজিক মূল্যবোধ নির্মাণের তাৎপর্যপূর্ণ বুনিয়াদ।
পরমত : পৃথিবীতে ব্যক্তিভেদে মানুষের চিন্তাচেতনায় বৈচিত্র্য রয়েছে। পারস্পারিক বিষয় ভাবনাকে নিজস্ব দৃষ্টিকোণে ব্যাখ্যা দেয়াকে ব্যক্তির মত বলে গণ্য করা হয়। মতের মিল না হলেই মতবিরোধ দেখা দেয়। অপরের কথা, বক্তব্য, মতামত, পরামর্শ ও জীবনাচার যতই বিরক্তিকর ও আপত্তিকর হোক না কেন, তা সহ্য করার মতো ধৈর্য যদি মানুষের মধ্যে না থাকে, তাহলে সমাজে নৈরাজ্য, উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে বাধ্য। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যদি বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে আধিপত্যবাদ, স্বৈরাচারসমাজ ও রাষ্ট্রে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
পরমতসহিষ্ণুতায় প্রিয়নবী সা: : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রাসূল সা:-কে উত্তম চরিত্রের সর্বোচ্চ চূড়ায় অধিষ্ঠিত করেছেন। সব দিক থেকে তাঁকে করেছেন শ্রেষ্ঠ। তাঁর নান্দনিক গুণাবলির মধ্যে সহিষ্ণুতা অন্যতম। সহিষ্ণুতা ও ােভ সংবরণে রাসূল সা: ছিলেন অনন্য। পরমতের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ ও সহিষ্ণুতা তার চরিত্রকে আরো উজ্জ্বল করেছে। মহানবী সা: নিজের জীবনে পরের মতামত ও বিশ্বাসের প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ ছিলেন, ইতিহাসে তার অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে।
১. মক্কার মুশরিকেরা একবার তাঁর কাছে এসে বলল, ‘আপনি কিছু দিন আমাদের নিয়মে উপাসনা করুন, আমরাও আপনার নিয়মে ইবাদত করব।’ এই প্রস্তাব শুনে তিনি তাৎণিক কোনো মন্তব্য করলেন না। এমনই সময় ওহি নাজিল হলোÑ ‘হে রাসূল, আপনি বলুনÑ হে কাফিররা, আমি তার ইবাদত করি না, যার উপাসনা তোমরা করো, আর তোমরা তার ইবাদতকারী নও, যার ইবাদত আমি করি এবং আমি তার ইবাদত করি না, যার ইবাদত তোমরা করে আসছ। তোমাদের দ্বীন তোমাদের জন্য, আমাদের দ্বীন আমাদের জন্য’ (সূরা আল কাফিরুন)।
২. ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মক্কা থেকে উত্তরে ২৯৬ মাইল দূরে অবস্থিত তখনকার ইয়াসরিবে হিজরত করলেন। সেখানে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন মদিনা রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের জন্য প্রণীত মদিনা সনদে পরমতসহিষ্ণুতার অনুরণন দেখা যায়। এতে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে একই জনগোষ্ঠীর শক্ত বুনিয়াদ রচিত হয়।
৩. ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা থেকে ৯ মাইল দূরে হুদায়বিয়ায় যে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয় তার সূচনাতে হজরত আলী রা: লিখেছিলেন ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। কিন্তু তা দেখে কোরাইশ মুশরিক প্রতিনিধি সুহায়ল বলল, ‘আমরা রহমানকে চিনি না, এ স্থলে লেখা হোকÑ বিসমিকা আল্লাহুম্মা।’ তখন রাসূল সা: হজরত আলী রা:-কে বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে। ওভাবেই লেখো। এরপর হজরত আলী রা: রাসূলুল্লাহ লিখলে সুহায়ল আপত্তি জানিয়ে বলল, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ মানি না। রাসূলুল্লাহর স্থলে লিখুন মুহাম্মদ ইবন আব্দুল্লাহ।’ এরপর প্রিয় নবী সা: বললেন, ‘তোমরা মানো আর না-ই মানো আমিই আল্লাহর রাসূল।’ এর পর তিনি হজরত আলী রা:-কে বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ শব্দটি কেটে দাও। হজরত আলী রা:) বললেন, আমি আমার কলম দিয়ে রাসূলুল্লাহ শব্দ কাটতে পারব না। তখন রাসূল সা: বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি নিজ হাতেই তা কেটে দিচ্ছি।’ এই বলে তিনি কলম দিয়ে রাসূলুল্লাহ শব্দ কেটে দিলেন। শুধু শান্তি প্রতিষ্ঠার খাতিরে তিনি সব কিছু মেনে নিলেন। পরমতসহিষ্ণুতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন রাসূল সা:। এই সন্ধিকে আল্লাহ তায়ালা সূস্পষ্ট বিজয় হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
৪. ওহুদের যুদ্ধে মহানবী সা:-এর মত ছিল মদীনা শহরের অভ্যন্তরে অবস্থান করে শত্র“র সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া। কিন্তু হজরত হামজা রা: এবং অপোকৃত যুবক সাহাবিগণ শহরের বাইরে কোনো উন্মুক্ত প্রান্তরে গিয়ে যুদ্ধ করার পে মতামত ব্যক্ত করেন। রাসূলুল্লাহ সা: তাদের মতামত গ্রহণ করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
৫. একদা মহানবী সা: যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী যোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করেন। একজন বলে ওঠেন, ‘গণিমতের মাল বণ্টন আল্লাহর ইচ্ছার পরিপন্থী হয়েছে।’ রাসূল সা: বলেন, ‘আমি যদি ইনসাফ না করি তাহলে ইনসাফ করবে কে?’ কিন্তু ভিন্নমত পোষণকারীদের মুখ বন্ধ করেননি।
৬. একদা হজরত জুবায়ের রা: এবং এক আনসারীর মধ্যে সৃষ্ট বিরোধের মামলা বিশ্বনবী সা:-এর আদালতে প্রেরিত হয়। সাীপ্রমাণ ও তথ্যাদি যাচাই করে রাসূল সা: হজরত জুবায়েরের অনকূলে রায় প্রদান করেন। কিন্তু আনসারী ক্রোধান্বিত হয়ে মন্তব্য করেন, ‘আপনি ফুফাতো ভাইয়ের পে রায় দিয়েছেন।’ এটা ছিল বিশ্বনবীর সততা ও ন্যায়পরায়ণতার প্রতি খোলা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ভিন্ন মতের জন্য শাস্তি না দিয়ে বরং রাসূল সা: তাকে মা করে দেন।
৭. এক যুদ্ধ অভিযানের সময় রাসূল সা: মুসলমানদের হুকুম দিলেন যে, অমুক জায়গায় তোমরা শিবির স্থাপন করো। এক সাহাবী জানতে চাইলেন, এই হুকুম কি আল্লাহপ্রদত্ত ওহি, নাকি আপনার নিজস্ব অভিমত? রাসূল সা: জবাব দিলেন, আমার ব্যক্তিগত অভিমত। সাহাবি বললেন, অমুক জায়গা শিবির স্থাপনের জন্য উপযোগী নয়, এর পরিবর্তে অমুক অমুক জায়গায় শিবির স্থাপন বেশি উপযোগী। রাসূল সা: তখন তার কথা মেনে নিলেন।
৮. বদরযুদ্ধে জয়লাভের পর যুদ্ধলব্ধ মালামাল বণ্টন নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। যারা শত্রুদের পরাজয়ের পর পিছু হটেছিলেন তারা বললেন, আমরা শত্র“দের তাড়িয়ে এই মালামাল সংগ্রহ করেছি, অতএব এই মালামাল আমাদেরই প্রাপ্য। আবার যারা নবী সা:-এর দেহরী ছিলেন, তারাও এ মালের ভাগ চাইলেন। কারণ তারা বললেন, নবীজিকে রা করতে না পারলে এ মালামাল তারাও সংগ্রহ করতে পারতেন। যারা এ মাল হেফাজত করেছিলেন, তারাও মালের ভাগ চাইলেন। মতবিরোধ যখন চরমে উঠল, তখন রাসূল সা: সব মালামাল তাঁর সামনে আনতে নির্দেশ দিলেন। তখনই আল্লাহ কুরআনের সূরা আনফালের নিম্নোক্ত আয়াত নাজিল করলেন ‘যুদ্ধলব্ধ মালামালের মালিক স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আর তাঁর রাসূল সা:। অতএব তোমরা নিজেদের মধ্যে সংশোধন করে নাও’ (সূরা আনফাল : ১)।
উপসংহার : পাশ্চাত্য চিন্তাবিদেরা ব্যক্তির পাঁচটি অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অপর দিকে ইসলাম মানুষকে সতেরোটি অধিকার সুনিশ্চিত করেছে। ১৯৪৮ সালে জাতিসঙ্ঘ ঘোষণায় মানবাধিকারের ৩২টি উপধারা ও ৩০টি ধারা বিশ্বে শান্তির সমাজ এনে দিতে পারেনি। কিন্তু আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে রাসূল সা: যে রূপরেখা দিয়েছিলেন সেটি সব যুগেই হয়ে থাকবে বাস্তসম্মত ও যথার্থ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার েেত্র ইসলাম সব সময় সহিষ্ণু মনোভাব প্রদর্শন করেছে। কারণ সহনশীলতার অভাবে মতপ্রকাশ বাধাগ্রস্ত হলে সুষ্ঠু সমাজ বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। বিবেকের স্বাধীনতা না থাকলে ব্যক্তি হয়ে পড়ে নির্জীব। আল্লাহর রাসূল মানুষের এই সহজাত অধিকার নিশ্চিত করেছেন। যে জাতি যত বেশি সহনশীল, সে জাতি তত বেশি সুখী, সমৃদ্ধিশালী ও অগ্রসর। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন, আস্থা, বিশ্বাস, সৌহার্দ্য সৃষ্টির জন্য পরমতসহিষ্ণুতার গুণ অপরিহার্য পূর্বশর্ত। রাসূল সা:-এর জীবনে এই অনন্য গুণটি সুশোভিত হয়ে উঠেছে। তর্কবিতর্ক ও কথাবার্তার জবাব তিনি দিয়েছেন নম্র ভাষায়, ক্রোধের জবাব তিনি দিয়েছেন সহনশীলতায় এবং মূর্খতামূলক হট্টগোলের জবাব দিয়েছেন গাম্ভীর্যপূর্ণ কথাবার্তার মাধ্যমে। আল্লাহর রাসূলের শিা হচ্ছে পারস্পারিক একতা, ভ্রাতৃত্ব, সমতা, ন্যায় ও কল্যাণের, যেখানে সঙ্কীর্ণতা সম্পূর্ণই অনুপস্থিত। চরম হতাশাব্যঞ্জক ও ভেঙে পড়া একটি পরিবেশে আবির্ভূত হয়ে তিনি সমাজকে আবার গড়ে তুলেছেন। জাহেলিয়াত ও মূর্খতার মাঝে একটি পরিষ্কার বিভাজন টেনে দিয়েছেন। পৃথিবীকে দিয়েছেন একটি নতুন সমাজব্যবস্থা, নুতন চিন্তা ও উপলব্ধি এবং উপমাতুল্য একটি চেতনাকাঠামো। পরমতসহিষ্ণুতার অনন্য শিাকে কাজে লাগিয়ে তিনি সমাজকে শুদ্ধ করেছেন, যেই সমাজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ক. মানবজাতির ঐক্য, খ. কল্যাণের বিকাশ ও মন্দের রুদ্ধকরণ, গ. মানবচিন্তার ঐক্য, ঘ. মানবতার সম্মান, ঙ. সমতা, চ. রাসূলের আনুগত্য।
বর্তমান এই ঘুণেধরা সমাজে রাসূলের আনীত আদর্শ বাস্তবায়নই একমাত্র সমাধান। রাসূলের উম্মত হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো, এই সিরাতে তাইয়্যেবার প্রসার ঘটানো। মানুষ যেন সত্যের আহ্বানকারী ও কল্যাণকর কাজের সঞ্চালক হয়ে ওঠে, সে জন্য উদ্যোগ নিতে হবে আমাদের সবাইকে। চেষ্টা করতে হবে মানুষকে সহিষ্ণুতায় অভ্যাস করাতে, ধৈর্য ও বরদাশত-যোগ্যতা অর্জন করা