বিজয়ের নানামাত্রিক দিক আছে। প্রকৃত বিজয় আসে আল্লাহর রহমতে, আল্লাহর অনুগ্রহে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, “আর তোমাদের পছন্দনীয় আরও একটি অনুগ্রহ হচ্ছে আল্লাহর সাহায্য ও আসন্ন বিজয়। ” (সূরা সাফ : আয়াত ১৩)
আমরা জানি, প্রিয় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য কয়েকটি যুদ্ধের মোকাবেলা করতে হয়। সব যুদ্ধেই বিজয় অর্জিত হয়েছে। একমাত্র উহুদের যুদ্ধে সাময়িক সঙ্কট সৃষ্টি হলেও শেষমেশ সে যুদ্ধেও বিজয় এসেছে। কুরআন মজীদের ৪৮ নম্বর সূরার নাম ফাত্হ। ফাত্হ শব্দের অর্থ বিজয়। এই সূরা ফাত্হ বা বিজয় সূরাখানি নাযিল হবার প্রেক্ষাপট বা শানেনুযুল থেকে জানা যায়, এই সূরাখানি নাযিল হয় ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পাদনের পর পরই।
ষষ্ঠ হিজরী মোতাবেক ৬২৮ খ্রিস্টাব্দের শাওয়াল মাসে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নে দেখলেন যে, তিনি সাহাবায়ে কেরামের একটি কাফেলা নিয়ে মক্কা মুকাররমা তশরীফ নিয়ে এসেছেন এবং বায়তুল্লাহ তওয়াফ করছেন, বায়তুল্লাহ শরীফের অভ্যন্তরেও প্রবেশ করেছেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আওয়াল মাসে জন্মভূমি মক্কা মুকাররমা থেকে মদীনা মুনওয়ারায় হিজরত করে আসেন। মক্কায় যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাঁরাও হিজরত করেন। দেখতে দেখতে ছয়টি বছর মদীনা মুনওয়ারায় অতিবাহিত হয়েছে। জন্মভূমি ছেড়ে আসার সময় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কাঁদছিলেন আর বলছিলেন: হে আমার জন্মভূমি মক্কা! আল্লাহর জমিনে তুমি আমার কাছে প্রিয়তম স্থান। ছয় বছর জন্মভূমি থেকে বহুদূরে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই তাঁর অন্তরে মক্কায় যাবার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠল এবং পবিত্র বায়তুল্লাহ তওয়াফ করবার ইচ্ছাও জাগ্রত হলো। তাই তিনি সেই শাওয়াল মাসের পরের মাস জিলকদে তিন হাজার চার শ’ সাহাবার এক কাফেলা নিয়ে মক্কার উদ্দেশে রওয়া হলেন। যুলহুলায়ফা নামক স্থানে এসে উমরার নিয়তে ইহরাম বাঁধলেন, সাহাবায়ে কেরামও ইহরাম বাঁধলেন। ওদিকে, মক্কার কাফির-মুশরিকদের কাছে খবর পৌঁছল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার দিকে আসছেন। তাঁর সঙ্গে কয়েক হাজার সহচর রয়েছে। তারা এই কাফেলার গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য একটি অশ্বারোহী বাহিনী মোতায়েন করল।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার কাছে হুদায়বিয়া নামক স্থানে এসে একটি কূপের কাছে অবস্থান করলেন। কূপটিতে সামান্য পানি ছিল, যে কারণে তিন হাজার চার শ’ সাহাবীর জন্য তা নিহায়ত কম ছিল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর তীরের খাপ (তুনী)-এর মধ্য থেকে একটি তীর বের করে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত বরাআ ইবনে আযিব রাদিআল্লাহু আনহুর হাতে দিয়ে বললেন, এই তীরটি ওই কূপের ভেতর নিক্ষেপ কর। সাহাবী নির্দেশ অনুযায়ী তীরটি কূপের ভেতর নিক্ষেপ করার সঙ্গে সঙ্গে কূপটি কানায় কানায় পানিতে ভরপূর হয়ে গেল। এটা ছিল প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক অনন্য মু’জিযা।
চূড়ান্ত বিজয় লাভ হয় আল্লাহর রহমতে হুদায়বিয়ার সন্ধির মধ্যদিয়ে। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত উসমান (রা.)-কে মক্কায় পাঠান, এই কথা বলার জন্য যে, আমরা শুধু উমরা করে চলে যাবো। কিন্তু তারা উসমান (রা.)-কে আটক করে রাখে, ঐদিকে গুজব ছড়ানো হয় যে, উসমানকে হত্যা করা হয়েছে। এমন অবস্থায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম একটি গাছের নিচে কাফেলার সকল সাহাবায়ে কেরামকে সমবেত করে প্রত্যেকের কাছ থেকে জান কুরবান করবার অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন। এই অঙ্গীকার বায়আতুর রিদওয়ান নামে অভিহিত হয়েছে। কুরআন মজীদে এই অঙ্গীকার সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, (হে রাসূল!) আল্লাহ তো মুমিনদের ওপর সন্তুষ্ট হলেন যখন তারা বৃক্ষতলে আপনার কাছে বায়আত গ্রহণ করল। তাদের অন্তরে যা ছিল তা তিনি অবগত ছিলেন, তাদের তিনি দান করলেন প্রশান্তি এবং তাদের পুরস্কার দিলেন আসন্ন বিজয়। (সূরা ফাত্হ: ১৮) বৃক্ষতলে সেই বায়আতুর রিদওয়ান সম্পন্ন হবার পর পরই হযরত উসমান রাদিআাল্লাহু আনহু হুদায়বিয়ায় ফিরে এসে এই বায়আত গ্রহণ করলেন। অতঃপর মক্কার কাফেরদের সঙ্গে সন্ধি চুক্তি হয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরের বছর অর্থাৎ ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে সাহাবায়ে কেরামসহ মক্কা মুকাররমা গিয়ে উমরা পালন করেন। হুদায়বিয়ার এই সন্ধিকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু ফাতহুম মুবীন অর্থাৎ প্রকাশ্য বিজয় হিসেবে অভিহিত করেন। নাযিল হয় সূরা ফাত্হ। এই সূরার শুরুতেই ইরশাদ হয়েছে : (হে রাসূল!) নিশ্চয়ই আমি আপনাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট। (সূরা ফাত্হ: ১)
মূলত হুদায়বিয়ার সন্ধিই ইসলামের চূড়ান্ত বিজয়ের পথ উন্মোচিত করে দেয়। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ২১ রমাদান সেই চূড়ান্ত বিজয় সাধিত হয় দশ হাজার সাহাবায়ে কেরামসহ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের মক্কা-মুকাররমায় উপস্হিত হবার মধ্য দিয়ে। সেদিন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালাম মজীদের যে আয়াতে কারীমা বার বার বলছিলেন তা হচ্ছে : আর বলো সত্য সমাগত, মিথ্যা দূরীভূত, নিশ্চয়ই মিথ্যা দূর হয়। (সূরা বনী ইসরাঈল: ৮১)
আল্লাহ জাল্লা শানুহুর অনুগ্রহ এলেই সত্যের বিজয় অবশ্যই হয়। সূরা নাসরে ইরশাদ হয়েছে : আল্লাহর সাহায্য এলে বিজয় আসে। (আয়াত: ১)
তেমনিভাবে যখন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যখন পূর্ব পাকিস্তানের লোকেদের তাদের অধিকার হতে বঞ্চিত করা শুরু করলো এবং তাদের ন্যায্য অধিকার বাস্তবায়ন করতে অস্বীকৃত জানালো, তখনই বাংলার মুক্তিকামী জনতা দূর্বার আন্দোলন গড়ে তুললো। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে দীর্ঘ ৯ মাস হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসরদের সঙ্গে যুদ্ধ করে অনেক রক্ত ঝরানোর মাধ্যমে আল্লাহর রহমতে বিজয় এসেছে উত্তাল আনন্দ নিয়ে ১৬ ডিসেম্বর তারিখে।
এ দেশের মানুষ ইনশা আল্লাহ দৃঢ় প্রত্যয় বুকে ধারণ করে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে, যে কারণে আল্লাহর রহমতে স্বাধীনতা আসে পলাশীতে লুট হয়ে যাওয়ার প্রায় ২১৪ বছর পর।
মানুষ সত্যের জন্য, ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করলে, লড়াই করলে সেখানে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে। (সূরা রাদ: -১১)
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার যে সমস্ত প্রচারপত্র ইশতেহার কিংবা জরুরী নির্দেশপত্র প্রকাশ করেছিল সেগুলো পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাব তাতে আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্বার গতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য অনুপ্রেরণা প্রদান করা হয়েছে এবং অধিকাংশ ইশতেহার বা প্রচারপত্র সমাপ্ত করা হয়েছে এই বলে : আল্লাহ আমাদের সহায়, নাসরুম মিনাল্লাহি ফাতহুন কারীব। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল প্রকাশিত এক ইশতেহারের শীর্ষে ছাপানো ছিল : আল্লাহু আকবার এবং শেষ করা হয়েছিল এই বলে : আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী।
বিজয় আল্লাহর দান। হানাদার ও তাদের দোসরদের সঙ্গে যুদ্ধ করে অনেক রক্তের বিনিময়ে আমাদের বিজয় অর্জিত হয়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।
বিজয়ের ৪৪ বছর পরও আপামোর জনতার দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় তারা নিরাপত্তাহনীতায় ভোগছেন, শঙ্কিত জনতা, কখন যে গুম হয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। অনেকেই উৎকণ্ঠাও হতাশায় ব্যক্ত করেন এই জন্যই কি স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম? আমরা কি স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারছি? এই প্রশ্ন অনেকের?
হে আল্লাহ! তোমার রহমতে যে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করলো, আমাদেরকে সেই দেশে পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দাও। সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত লোকেদের হাতে দেশের পরিচালনা ভার ন্যস্ত কর। আমীন