ভালবাসা পেতে হলে
শেষ পর্ব
আর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কথা জানি। সে পরিবারের পুত্রবধূটি শ্বশুড় শাশুড়ীর পক্ষের কোনো মেহমান দেখলেই তার মুড অফ হয়ে যায়। সে কারো সাথে প্রাণ খুলে কথা বলে না। অথচ তার বাবার বাড়ির দিক থেকে কেউ এলে কতো যে উষ্ণ অভ্যর্থনা। এ ধরনের পুত্রবধূ গ্রাম গঞ্জে, ভদ্রলোক, ছোটলোক, নিন্মবিত্ত, মধ্যবিত্ত প্রায় ঘরেই পাওয়া যায়। এটা অবশ্য এক ধরনের রোগ। কুরআন মাজিদে আল্লাহ পাক মুনাফেকি ও কুফরিকেও রোগ বলেছেন। এই রোগ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে না পারলে দুনিয়ার শান্তি আর আখেরাতের মুক্তি কিছুতেই পাওয়া যাবেনা। এই রোগের নাম মনের কালিমা। মনের কালিমা দূর হয় অধিক পরিমাণে কুরআন তেলাওয়াত করলে আর বেশি বেশি মৃত্যুর কথা স্মরণ করলে। আর এই রোগটা হয় অন্তরে ভালোবাসার অভাব হলে।
বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপ্রাণের অভাবে শরীরে যেমন নানা ধরনের রোগ দেখা দেয় তেমনি ভালোবাসার ঘাটতি বা অভাব দেখা দিলে অন্তরে এই সব রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
তাইতো রাসূল (সা.) বলেছেন “তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে যেতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না। তোমরা ততক্ষণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালোবসতে পারবে।” (সহিহ মুসলিম)
আর এক জায়গায় তো আরো কড়া ভাবে বলেছেন “যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের শ্রদ্ধা করে না সে আমার দলের না।” (মুসতাদরাকে হাকেম, ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদীস সহিহ) এই ‘দলের না’ কথাটির অর্থ সে রাসূল (সা.) এর উম্মতই না, মানে মুসলমানই না। আর এই স্নেহ আর শ্রদ্ধা যা-ই বলি না কেন মূলতঃ এসব ভালোবাসারই বিভিন্ন নাম। একই বাগানে যেমন বসরাই গোলাপ ফোটে আবার ক্ষুদ্র ঘাসফুলও ফোটে, তেমনি সমাজের একদম তৃনমূল পর্যায় থেকে উচ্চস্তরের অনেকের ভালবাসায় ধন্য, পরিপূর্ণ আমার এই হৃদয় বাগানটি।
একবার দুই/তিন জন মহিলা এসে আমার কাছে নালিশ করল “আপা আপনার মধ্যপাড়া ইউনিটের কর্মী মনোয়ারা বেগম মারামারি করেছে।”
বললাম “কেনো?”
ঃ “ঝগড়া করতে করতে এক পর্যায় মনোয়ারা তার প্রতিবেশী মহিলাকে ধরে আচ্ছা মাইর দিয়েছে। এই সব কাজ যদি আপনার কর্মীরা করে তাহলে আপনাদের তালিমে লোক আসবে?”
অতি সত্যি কথা। আমি মধ্যপাড়া ইউনিটে গেলাম। আমার এই কর্মী বোনটির পূর্বে খুবই উগ্র মেজাজ ছিল। এই কারণে এলাকার সবাই তাকে ভয়ও করতো। কিন্তু এখন সে এতো ভদ্র হয়েছে যে তাকে কেউ দু’চারটা কটু কথা শুনিয়ে দিলেও কিছু বলে না মুখ বুজে সহ্য করে। সেই বোনটি কি কারণে হঠাৎ অতখানি উত্তেজিত হয়ে গেলো যে মেরেই বসল।
যাহোক আরো অনেক লোকের সামনে বললাম “আপনি মারামারি করতে গেলেন ক্যান? ছি! ছি! মানুষ শুনলে কি বলবে। যারা ইসলামের দাওয়াত প্রচার করে তারা মারামারি করে। আপনি এক্ষুনি ঐ আপার কাছে মাফ চেয়ে নেবেন। মাথা কাত করে সম্মতি জানাল মনোয়ারা বেগম। আমি আবার বললাম “আচ্ছা পাড়া প্রতিবেশীর সাথে একটু ঝগড়া ঝাটি হতেই পারে। আপনি তাকে মারতে গেলেন কেনো? এতো উত্তেজিত হওয়ার কারণ কি?” মনোয়ারা বেগম এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। বললেন “আপারে! ও আমার এমন জায়গায় হাত দিয়েছে যে আমি সহ্য করতে পারি নি। ও যদি আমার মাকে গালাগালি করত, ও যদি আমাকে মারপিট করত তাহলেও আমি ওকে কিছু বলতাম না। কাঁদতে লাগলো মনোয়ারা। আমি অবাক হলাম। কি এমন কথা বলেছে মহিলা? মনোয়ারার মা বাবাকে গালাগালি করলেও এতো রাগ হতো না। মারলেও না। আমি বুঝতে না পেরে বললাম “কি এমন বলেছে আপনাকে?” মনোয়ারার ‘জা’ বললো “আপা ঐ মহিলা আপনাকে গালাগালি করেছে। আর মনোয়ারা তাতেই মেরেছে।”
আমি হাসিমুখে বললাম “আমাকে? আমাকে গালাগালি করেছে তো কি হয়েছে? আমাকে কেউ গালাগালি করলে তাকে মারতে হবে?”
মনোয়ারা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আমারও কান্না এলো। মনোয়ারা বলতে লাগলো “আপারে! আপনাকে কেউ কিছু বললে আমি সহ্য করতে পারি না। আমার তখন হুঁশ জ্ঞান থাকে না——। বললাম “আপা আমার জন্য কারো সাথে মারামারি করবেন না। ঝগড়াও করবেন না।” মনোয়ারা বললো, “আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি যেনো ধৈর্য ধরতে পারি। এই একটাই এখন আমার দুর্বল জায়গা আপা এই জায়গায় কেউ হাত দিলে আমি ঠিক থাকতে পারিনা।” মনোয়ারার এই কথায় আমার আরও কর্মী বোনেরা সায় দিলেন। তারাও বললেন “মনোয়ারা ঠিকই বলেছে আপা আপনাকে কেউ কিছু বললে আমাদের কলিজায় আঘাত লাগে।”
আমি অবাক হয়ে, অভিভূত হয়ে তাকিয়ে থাকলাম এই ভালোবাসার দিকে। বৈঠক শেষে প্রাণ উজার করে বললাম ‘মাবুদ গো এই ভালোবাসা শুধু তোমার জন্য। তোমার আরশের ছায়ার নিচে আমাদের সবাইকে জায়গা দিও।’ আমীন
আবার আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটি সুদুর লন্ডনে যেয়েও যখন আমার খোঁজ নেন। বলেন “শাশুড়ী আম্মা-কেমন আছ? ঢাকায় এসে কষ্ট হচ্ছে নাতো?
বাংলাদেশে এসে ফোন করেন। “শাশুড়ী আম্মা কেমন আছ? গতকাল এলাম। তুমি এসো তোমার মেয়ে তোমার জন্য অস্থির হয়ে আছেন ‘তোমার জন্য কি যেনো একটা গিফট এনেছেন।”
ভালোবাসার বসরাই গোলাপে তখন আমার হৃদয় বাগান খানি মোহিত হয়ে যায়। তখন সেই বাগান খানি চোখের পানিতে সিক্ত করা ছাড়া আমার আর উপায় থাকে না। হ্যাঁ আমি সাবেক আমীরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের কথা এবং তার মহিয়সী স্ত্রী সাইয়েদা আফিফা আযমের কথা বলছি। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবকে তো আজ ভালোবাসিনি তাকে ভালোবাসার বীজটি বপন করেছিলাম ১৯৮৪/৮৫ সালে। সেই বীজ অংকুরদগম হয়েছে। ধীরে ধীরে সতেজ চারাটি বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। সেই বৃক্ষটি ভালোবাসার ফুলে ফলে সুশোভিত এখন।
১৯৮৯ সালে প্রথম রুকন সম্মেলনে আসি। সেই সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্য দিয়েছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিলাম আমার নেতার বক্তব্য সেই প্রথম। সাধারণ প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রশ্ন করেছিলাম। লিখেছিলাম “প্রিয়তম নেতা আমার, আস্সালামু আলাইকুম। সাংগঠনিক কাজে আমাকে এক থানা থেকে অন্য থানায় যেতে হয়। এই যেমন সুদূর নওগাঁ থেকে ঢাকা আসতে হয়েছে। কিন্তু মাহরাম সফর সঙ্গী তো আমার নেই। এই ক্ষেত্রে আমি কি করবো?”
আমার নেতা জোরে জোরে আমার প্রশ্নটি পড়লেন তারপর এতো চমৎকার করে উত্তর দিলেন। হৃদয়ের পাতায় লেখা হয়ে গেলো সমাধানটি। মানষিক যে দ্বন্দ্বটি আমার মধ্যে ছিল তা একেবারে মিটে গ্যালো তিনি বললেন “যদি নিরাপত্তা ও নৈতিকতার কোনো সমস্যা না হয় তো আপনি যাবেন।”
আমি তখনও তাকে দেখিনি। একবার খন্দকার মাও. আবুল খায়ের সাহেবের মেয়ে হালিমা আপাকে নিয়ে নেতার বাসায় এলাম। প্রচন্ড ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সেদিন তাকে দেখতে পারি নি। তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন তখন। ক্ষুন্ন মনেই ফিরে এসেছিলাম সেদিন।
১৯৯২ এর এপ্রিল/মে মাসে জরুরী রুকন বৈঠকে জিলা নায়েবে আমীর একটি ছোট্ট বক্তৃতা দিলেন। তার মূলকথা আমীরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এই মামলা পরিচালনার জন্য সবাইকে সাধ্য অনুযায়ী আর্থিক কোরবানী দিতে হবে। পর্দার এ পাশে আমি ওপাশে ভাইয়েরা। আমি তখন বদলগাছী থানা সেক্রেটারী এবং আমিই একমাত্র মহিলা রুকন। ভাইয়েরা কেউ পাঁচ হাজার কেউ দুই হাজার যার যেমন সাধ্য দেওয়ার ওয়াদা করতে লাগলেন। সবার ওয়াদা হয়ে যাওয়ার পর নায়েবে আমীর ভাই বললেন ‘রুমী আপা আপনি কিছু বলেন। আমার যে এক হাজার দেওয়ারও সামর্থ নেই। আমার হাজবেন্ট ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু যে ইঞ্জিনিয়ার হালাল রুজি খেতে চায় তার সচ্ছলতা কতটুকু আমাদের দেশে? আমি বললাম “ ভাই আমি যা দেব নগদ দিয়ে দেব কেউ একজন পর্দার কাছে আসেন। এক রুকন ভাই পর্দার কাছে এলেন আমি আমার কানের দুল দুটো খুলে তার হাতে দিয়ে দিলাম। ভাই যেন একটু চমকে উঠলেন। বললেন “এ কি?”
নায়েবে আমির ভাই বললেন “আপা এই দুল দুটো দিতে হলে আপনার স্বামীর অনুমতির প্রয়োজন না?”
বললাম “কেন ভাই দুল দুটি কি আমার না?”
নায়েবে আমীর বললেন “ আপনার। কিন্তু আপনার স্বামী-ই তো এ দুটি আপনাকে দিয়েছে।”
“তা দিয়েছে। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই এটি আমাকে সত্ত্ব ত্যাগ করেই দিয়েছেন। তাহলে আপনারা আপনাদের স্ত্রীদের যে শাড়ী গহনা দেন তাকি একেবারে দিয়ে দেননা? সত্ত্ব রেখে দেন? আমি যদি টাকা দেওয়ার ওয়াদা করতাম তাও তো আমার স্বামীর কাছ থেকেই দিতে হতো অথচ তাতে তার উপর আরও চাপ বেশি পড়ত। আমি তো আপনাদের দেই নি আমি আমার নেতাকে দিয়েছি। আমি তাকে ভালোবাসি। এই দুল দুটি আমার কানে থাকলে আমি যে সুখ পাব আমার নেতার সামান্যতম কাজে লাগলে আমি তার চেয়ে অনেক বেশি সুখ পাব।” আবেগে আরো কি কি বলেছিলাম এতোদিন পরে সব মনে নেই। ভাইয়েরা আর কিছু বললেন না।
আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে অনুভব করি আমার সেই ভালবাসা সহস্রগুণ হয়ে ফিরে এসেছে আমার কাছে। দুনিয়ার এই সফর শেষ করে ফিরে যেতে হবে মহান মালিকের দরবারে। এই সুদীর্ঘ সফরে ভালোবাসাই তো একমাত্র মূলধন আমার। নওগাঁ জিলার ভাই বোনেরা যে কি পরিমাণ ভালোবাসেন আমাকে তা কি আমি কাউকে বলে বোঝাতে পারব? শুধু নওগাঁই বা বলি ক্যান? চাঁপাই নবাবগঞ্জ জিলার শিবগঞ্জে দু’বছর ছিলাম। তাদের ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়ার ক্ষমতা কি আমার আছে? আমি যদি সেই সব ভালোবাসার উদাহরণ দিতে চাই, হাজার পৃষ্ঠায়ও বই শেষ হবেনা। এই ঢাকা শহরের ভাই বোনেরা যে পরিমাণ ভলোবাসেন আমাকে তার কি তুলনা আছে? টাংগাইল ভূঞাপুরের ভাই বোনদের অসামান্য ভালোবাসায় অভিভূত হয়ে যাই। কোনো সম্পদই এমনি এমনি পাওয়া যায় না, তার জন্য চেষ্টা করতে হয় আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হয়। চাইতে হয়। এই ভালোবাসার সম্পদে যদি আমরা সমৃদ্ধ হতে চাই তাহলে তার জন্য আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। দোয়া করতে হবে। দুনিয়ার শান্তি আর আখেরাতের মুক্তি যে এর মধ্যেই নিহিত। ভালোবাসায় পূর্ণ থাকে যদি আমাদের মন আমাদের গৃহ আমাদের সমাজ। তাহলে জান্নাতী শিরিন শীতল বাতাস বয়ে যাবে আমাদের মনে আমাদের ঘরে আমাদের সমাজে। তা আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি।