ইসলাম মুসলিম নারীদের যে সম্মান দিয়েছে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ হল, মুসলিমদের অন্তরে তাদের মেয়েদের বিষয়ে অত্যধিক আত্মসম্মানবোধকে সুদৃঢ় করে দিয়েছেন। বলা বাহুল্য যে, এটি অবশ্যই একটি পছন্দনীয় ও মহান চরিত্র, যা আল্লাহ তা‘আলা নিজেই একজন মুসলিমের অন্তরে গেঁথে দিয়েছেন, যার ফলে একজন মুসলিম তাদের মেয়েদেরকে ঘর থেকে বের হতে ও একা একা সফর করতে ঘৃণার চোখে দেখে এবং তাদের পর্দা-হীনতাকে কোন ক্রমেই মেনে নেয় না। তারা তাদের নারীদের পুরুষদের সামনে যেতে ও তাদের সাথে অবাধ মেলা-মেশা করতে নিষেধ করে। নারীদের ইজ্জত সম্মান রক্ষায় তারা তাদের জীবনকে উৎসর্গ করতেও কোন প্রকার কুণ্ঠাবোধ করে না।
অপর দিকে যারা তাদের মা-বোনদের ইজ্জত সম্মান রক্ষার জন্য শত্রুর মোকাবেলা করে, তাদের জন্য রক্ত বা জীবন দেয়, ইসলাম তাদেরকে মুজাহিদ বলে আখ্যা দিয়েছে এবং যারা এ ধরনের কাজে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেবে তাকে শহীদের মর্যাদা দেয়া হবে বলে ইসলাম জানিয়ে দিয়েছে। কারণ সাঈদ ইবনে যায়েদ হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,
من قُتل دون ماله فهو شهيد، ومن قُتل دون دمه فهو شهيد، ومن قُتل دون دينه فهو شهيد، ومن قُتل دون أهله فهو شهيد
“যে ব্যক্তি তার সম্পদকে রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে অবশ্যই শহীদ, আর যে ব্যক্তি তার দ্বীনের জন্য মারা যায়, সেও শহীদ। আর যে ব্যক্তি তার পরিবারের হেফাযত করতে গিয়ে মারা যায় সেও শহীদ।” [আবু দাউদ; ৪৭৭২, তিরমিযি ১৪২০]
শুধু তাই নয় বরং ইসলাম আত্মসম্মানবোধকে ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বলে আখ্যায়িত করেছে। মুগিরা ইবনে শুবা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাঈদ ইবনে ওবাদা বলেন, যদি আমি আমার স্ত্রীর সাথে কোন অপরিচিত পুরুষ দেখি, তাহলে আমি কোন প্রকার কালক্ষেপণ না করে তাকে সাথে সাথে হত্যা করে ফেলব। তার কথাটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে পৌছলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
تعجبون من غيرة سعد؟ لأنا أغير منه، واللهُ أغير مني، ومن أجل غيرة الله حرّم الفواحش ما ظهر منها وما بطن متفق عليه
“তোমরা সা‘আদ রা. এর আত্মসম্মান দেখে আশ্চর্য হচ্ছ, মনে রাখবে আমি তার চেয়েও বেশি আত্মসম্মানের অধিকারী। আল্লাহ তা‘আলা আমার চেয়ে আরও বেশি আত্মসম্মানের অধিকারী। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা প্রকাশ্য ও গোপনীয় যাবতীয় সকল অশ্লীল কাজকে হারাম করেছেন।” [বুখারি; ২৮৪৬, মুসলিম;১৪৯৯]
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
إنَّ الله يغار، وإنَّ المؤمن. يغار، وإنَّ من غيرة الله أن يأتي المؤمن ما حرّم الله عليه متفق عليه
“আল্লাহ তা‘আলা আত্মসম্মানবোধের কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন এবং একজন ঈমানদারও প্রতিবাদী হয়ে থাকে। আল্লাহর বিক্ষুব্ধতা বা ঘৃণার কারণ হল, একজন মুমিন বান্দা আল্লাহ তা‘আলা যা হারাম করেছেন তাতে লিপ্ত হয়ে পড়া।” [বুখারি; ৫২২৩, মুসলিম;২৭৬১]
যাদের মধ্যে আত্মসম্মান ও আত্ম-মর্যাদাবোধ বলতে কিছু নেই, তাদেরকে হাদিসের ভাষায় দাইয়ূস বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ যে তার পরিবারকে পরপুরুষের সাথে অন্যায় করতে দেখে তা স্বীকৃতি দেয়, কোন প্রকার প্রতিবাদ করে না। এ ধরনের লোকদের বিষয়ে হাদিসে কঠিন হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। যেমন- আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত, রসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
ثلاثةٌ لا ينظرالله عزّ وجلَّ إليهم يوم القيامة: العاقُّ لوالديه، والمرأة المترجّلة، والديوث رواه أحمد وغيره
“আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির দিক কোন প্রকার ভ্রক্ষেপ করবেন না, এক- যে মাতা-পিতার নাফরমানি করে, দুই-পর্দাহীন মহিলা, তিন-যে পুরুষ তার স্ত্রীর অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়।” [মুসনাদে আহমদ; ১২৭]
ইতিহাসে অনেক ঘটনা পাওয়া যায়, যাতে একজন মুসলিম তার মা বোনদের ইজ্জত রক্ষায় কি ধরনের আত্মসম্মানের পরিচয় দিয়েছে তার প্রমাণ মিলে। তাদের বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কি ধরনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হত, তার অনেক দৃষ্টান্ত ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এ বিষয়ে একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা আল্লামা ইবনুল জাওযী রহ. তার আল-মুন্তাযাম কিতাবে মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-কাযী থেকে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, দুইশত ছিয়াশি হিজরিতে আমি রাঈ নগরে মুসা ইবনে ইসহাকের মজলিসে উপস্থিত হই। তখন তার মজলিশে একজন মহিলা তার অভিভাবকদের নিয়ে উপস্থিত হল এবং অভিভাবকরা মহিলাটির স্বামীর নিকট মোহরানা হিসেবে পাঁচশত দিনার পাবে বলে দাবি করে। কিন্তু মহিলার স্বামী তা অস্বীকার করল। বিচারক মহিলার অভিভাবকদের বলল, তোমরা তোমাদের দাবির পক্ষে সাক্ষীদের উপস্থিত কর। তখন তারা বলল, হা আমরা সাক্ষী নিয়ে আসছি। সাক্ষীদের মধ্য হতে একজন সাক্ষী দাবি করল, সে মহিলাটিকে দেখবে, যাতে সাক্ষ্য দেয়ার সময় মহিলার দিকে ইশারা করে কথা বলতে পারে। ফলে একজন সাক্ষী দাড়িয়ে মহিলাকে সম্বোধন করে বলল, তুমি দাড়াও এবং সবার সামনে এসে যাও। এ কথা শোনে মহিলাটির স্বামী দাড়িয়ে বলল, তোমরা কি বলছ? সে বলল, তারা তোমার স্ত্রীকে দেখবে, যাতে তারা যার পক্ষে সাক্ষী দিচ্ছে, তাকে ভালোভাবে চিনতে পারে। তখন স্বামী বলল, হে কাজী সাহেব আমি সাক্ষী দিচ্ছি যে, আমার স্ত্রী আমার নিকট যে মোহর দাবি করছে, সত্যি সত্যি সে আমার নিকট তা পাবে। আমি তার দাবি অনুযায়ী অল্পদিনের মধ্যে তার দেনা দিয়ে দেব। তবে সে তার চেহারা খুলবে না এবং লোক সম্মুখে সে উপস্থিত হবে না। তারপর মহিলাটি তার স্বামীর বিষয়ে সত্য কথাটি বলল, এবং জানিয়ে দিয়ে বলল যে, আমি কাজীকে সাক্ষ্য রেখে বলছি, আমি আমার পাওনা মোহরানা আমার স্বামীকে দান করে দিলাম এবং দুনিয়াও আখেরাতে আমি তাকে দায়মুক্ত বলে ঘোষণা করলাম। এ দৃশ্য দেখে কাজী-বিচারক বলল, এ ঘটনাকে ইতিহাসে উন্নত চরিত্রের অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হবে।
মূলত ঘটনাটি উন্নত চরিত্রের অন্যতম একটি দৃষ্টান্ত, উন্নত শিষ্টাচার ও মূল্যবান উপদেশমূলক। আমরা বলব তারা কোথায় আজ যারা তাদের মা বোনদের ইজ্জত রক্ষায় এগিয়ে আসছে না এবং তাদের পরিবারের লোকেরা যখন অন্যায় অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়, তখন তারা তার কোন প্রতিবাদ করে না।