রমযান মাসকে সামনে রেখে পাঠক সমিপে কিছু পরামর্শ ও পরিকল্পনা তুলে ধরলাম। এর সাথে আপনারাও নিজ থেকে আরো কিছু করণীয় বিষয় যোগ করে নিতে পারেন। আল্লাহ আমাদের হিম্মত বাড়িয়ে দিন ও বেশি বেশি আমল করার তৌফিক দিন। রমযানের প্রতিটা মুহূর্ত যেনো সঠিকভাবে ব্যয় করা সম্ভব হয়। সেই দোয়া করছি মহান আল্লাহর নিকট।
প্রিয় পাঠক! আমারাও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করি যেন মহিমান্বিত এই মাসটি কুরআন তেলাওয়াত, কুরআনের দারস, ইসলামী সাহিত্যসহ মাসায়েল শিক্ষা ও দান খয়রাত এবং ইবাদত বন্দেগীতে কাটাতে পারি। এখন থেকে সেভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। সালাফে সালেহীনদের অভ্যাস ছিলো, তারা রমযান মাস আসার ছয় মাস পূর্ব হতেই রমযান মাসের পরিকল্পনা করতেন, কোন দিন কিভাবে কাটবে, কি কি আমল করবে, এসব বিষয় নিয়ে। একজন সচেতন ব্যবসায়ী যেভাবে ব্যবসা আরম্ভ করার পূর্বে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, ঠিক তেমনিভাবে একজন সচেতন আল্লাহ প্রেমিকের উচিত আল্লাহর এই বিশেষ মাসে কিভাবে কাটাবেন, তার পরিকল্পনা করা। নিম্নে কিছু পরামর্শ তুলে ধরা হলো-
১। কুরআন পুরোটা অর্থসহ পড়া: যারা খতম তারাবীতে যাবেন তাদের জন্য, দিনের বেলায় সেই রাতের তারাবীতে পড়াবে এমন অংশটুকুর অর্থসহ বুঝে পড়া, প্রয়োজনে তাফসীরসহ পড়ে নেওয়া। এখানে তেলাওয়াতকৃত আয়াতগুলো হতে বিষয় ভিত্তিক আয়াতগুলো, দারস তৈরি করার চেষ্টা করা। যারা আগ্রহী তারা মার্কার পেন বা কলম দিয়ে দাগিয়ে পড়তে পারেন অথবা ডায়েরীতে লিখে নিতে পারেন কোন কোন আয়াত বিষয় ভিত্তিক।
এখানে আরেকটু করা যায়, এই সময়ে সমগ্র কুরআনের আল্লাহর শেখানো দোয়াগুলো আমরা ডায়েরীতে তুলে রেখে ধীরে ধীরে সেগুলো মুখস্ত করার চেষ্টা করতে পারি।
প্রতি সূরা শেষ করে পরিবারের সবাইকে কিংবা নিজের শাখা বা অঞ্চলের দ্বীনি ভাইদের নিয়ে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো আলোচনা করা। সম্ভব হলে নিজ এলাকায় এসব আয়াত মুখস্ত করার প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করা।
২। সহীহ হাদীসগুলো ধীরে ধীরে জানা: তেমনিভাবে আমরা সহীহ বুখারী-মুসলিম ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থের সহীহ হাদীসগুলো থেকে উক্ত দিন গুলোতে আমরা নামায, রোযা, যাকাত বা দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কিত প্রতিদিন কমপক্ষে একটি হাদীস পড়া।
৩। জীবনী থেকে উদাহরণ: রাসূলের জীবনী-মহিলা সাহাবী অথবা সাহাবা চরিত ভালো করে জানার সঙ্গে সঙ্গে সালফে সালেহীনদের জীবনী আমাল করার পদ্ধতি জানার চেষ্টা করা।
৪। নামায: প্রতি পাঁচ ওয়াক্তের সাথে রাতে তারাবীহ, তাহাজ্জুদ ও দিনের বিভিন্ন নফল নামায পড়ার চেষ্টা করা। এই সময়ে আমরা সবাই সেহরীতে উঠি, একটু আগে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ে এর উপকারিতা লাভ করতে পারি। প্রতিদিনই তারাবীহ যেন আদায় করি। আল্লাহ তা’আলা বলেন: তাদের পার্শ্বদেহ বিছানা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের প্রভুকে ডাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।’ (সূরা সাজদা : ১৬)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত রাত্রে জাগতেন ও নামায আদায় করতেন। এ প্রসঙ্গে আয়শা রা. বলেছেন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের বেলায় নামাযে (এত দীর্ঘ সময়) দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তার পা দু’টো যেন ফেটে যেত। আমি তাকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এমনটি করছেন কেন? অথচ আপনার পূর্ব ও পরের সব গুনাহ মাফ হয়ে গিয়েছে। তিনি বললেন, ‘আমি কি (আল্লাহর) কৃতজ্ঞ বান্দাহ হবো না?’ (বুখারী ও মুসলিম)
৫। যিকর: এ ছাড়া বাকী সময়গুলো সব সময় আল্লাহর যিকিরে নিজের জিহ্বাকে সিক্ত রাখা, যেমন রান্না বা অন্য কাজের সময় দোয়া এস্তেগফার দরুদ পড়া। বিশেষ করে মহিলাগণ রমযানের ইফতারের পূর্বক্ষণে রান্না বা ইফতার তৈরির কাজে অনেক সময় ব্যয় করে থাকেন। রমযান মাসকে ত্যাগের মাস হিসেবে গ্রহণ করে খাবারের বাহারী প্রকার আয়োজন না করে রোযার মূল শিক্ষার দিকে লক্ষ্য রাখা। এ মাসের প্রতিটা মুহূর্তের অনেক মূল্য। আল্লাহ নারী-পুরুষ সকলকে বুঝার তাওফীক দান করুন। আমীন
৬। দান: এ সময় নিকটাত্মীয় গরীব, মিসকীন, ফকীর এদের মাঝে সাহায্য বাড়ানো। নিজের ঘরের কাজের জন্য যে অধিনস্ত লোক থাকে তাকে সাহায্য করা।
৭। ইফতার কারানো: প্রতিদিনই কাউকে ইফতার করানো একটি খেজুর কিংবা একটি লেবেন বা জুস দিয়ে হলেও। গরীব আত্মীয়দের বাসায় উপহার হিসাবে ইফতারের কিছু কাঁচা মাল (খেজুর, ছোলা, মুড়ি) আগেই পাঠিয়ে দেয়া। আর ধনীদের মাঝে ইসলামের শিক্ষার জন্য বই উপহার দেয়া বা কিনতে উৎসাহিত করা। পরিবারের সবাই মিলে ইফতারের আয়োজন করা, হালকা করে ইফতারের আগের সময়টুকু কুরআন ও দোয়ায় নিজেকে ব্যস্ত রাখা এবং পরিবারের সবাইকে নিয়ে ইফতার সামনে রেখে একসাথে আল্লাহর কাছে দোয়া করা।
৮। রোযাতে অধীনস্ত কাজের লোকদের কাজ হালকা করে দেয়া: এবং তাদেরকেও ইসলামের প্রাথমিক জ্ঞান দান করা। এবং নিজে যা খাবে চাকর-বাকরকেও তাই খেতে দিবে।
৯। রমযানের রোযার প্রস্তুতিস্বরূপ শাবান মাসে কিছু রোযা রাখা।
১০। কোন ওয়াজিব বা কাজা রোযা বাকী থাকলে, তা রমযান আসার পূর্বে আদায় করে নেওয়া।
১১। এই মহান মাসের আসন্ন আগমনে খুশি হওয়া: রমযান মাস পাওয়াটা একজন মুসলিমের প্রতি আল্লাহ তাআলার বিশেষ নেয়ামত। যেহেতু রমযান কল্যাণের মৌসুম। যে সময় জান্নাতের দরজাগুলো উন্মুক্ত রাখা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ রাখা হয়।
১২। নাবালক অর্থাৎ ছোটদেরকে মাঝে মধ্যে রোযা রাখার অভ্যাস করা।
১৩। সংশোধন: নিজের মাঝের দোষগুলো নির্দিষ্ট করে সেগুলো থেকে সরে আসা এবং তওবা করে আল্লাহর বিধান পালনে যত্নশীল হওয়া।
১৪। রমযান মাসের প্রতি দিন ও রাতে আল্লাহ দোয়া কবুল করেন, তাই আমাদের রমযানের পূর্বে প্রত্যেক দিনে নির্দিষ্ট করে দোয়া করা।
১৫। শবে-ক্বদরের রাতগুলো (শেষ দশদিনের বেজোড় রাত) বিশেষ ভাবে রাত জেগে এবাদত করা।
১৬। শেষ দশদিনে ই’তেকাফে বসার সুযোগ করা ।
১৭। ফিতরা সঠিক সময়ে আদায় করা।
১৮। যাকাত সঠিক হিসাবে ও সঠিক পদ্ধতিতে আদায় করা।
পরিশেষে বলবো, আসুন আমরা রমযান মাসের মর্যাদা রক্ষা করি এবং রাসূল (সা.)-এর বলে দেওয়া নিয়মে এই মাসে ইবাদত বন্দেগী করি। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সকলকে সেই তাওফীক ও শক্তি দান কর। আমীন।