আমাদের প্রিয় নবী (সা.) রাসুলদের ভূমিকা, নবীদের উপসংহার ও ইমাম, কেয়ামত দিবসে আদম সন্তানের সরদার, সুপারিশকারী এবং সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। তিনি নিখিল বিশ্বের সব সৃষ্টির জন্য দয়া ও রহমতের আধার। মানবজাতির জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। আল্লাহপাক এরশাদ করেছেন, আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসুল মোহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যে সর্বোত্তম আদর্শ।’
রাসুল করিম (সা.)-এর আগমনে বিশ্ববাসী পেয়েছে সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও আলোর সন্ধান। তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে দিয়েছে মানবতার মুক্তি ও কল্যাণ। তাঁর দর্শনতন্ত্রের মূলমন্ত্র ছিল হককুল্লাহ (আল্লাহর হক আদায় করা) ও হককুল ইবাদ (আল্লাহপাকের সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য পালন করা)। নবীজি (সা.)-এর জীবনদর্শন কোনো স্বতঃস্ফূর্ত কর্মকাণ্ড নয়; বরং আল্লাহপাক প্রদত্ত ঐশীবাণীরই বাস্তব রূপায়ণ। কেবল মহানবী (সা.) তাঁর মহান কর্মের গুরুদায়িত্ব সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। তিনি একাধারে পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক মহাবিপ্লবের মাধ্যমে রাব্বুল আলামিনের নির্দেশিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছিলেন। এসব দায়িত্বের মূলে ছিল আল্লাহপাকের প্রতি আত্মসমর্পণ ও পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধানকে প্রতিষ্ঠিত করা।
আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির প্রথম দিনই আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করে তাঁর ডানপাশ থেকে পিঁপড়ার মতো বের করে এনেছিলেন পৃথিবীতে কেয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ আসবে, সবাইকে। সেদিন সবাইকে একত্র করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমি কি তোমাদের রব নই?’ সৃষ্টির সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার এটাই প্রথম কথা এবং প্রথম প্রশ্ন। সর্বপ্রথম যিনি এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন, তিনিই রাহমাতুল্লিল আলামিন হজরত মোহাম্মদ (সা.)। কেয়ামত দিবসেও তাঁর হাতেই থাকবে আল্লাহ তায়ালার হামদের পতাকা। আদম (আ.) ও তারপর কেয়ামত পর্যন্ত যত লোক দুনিয়াতে আসবে সবাই তাঁর পতাকাতলে আশ্রয় নেবে।
হজরত রাসুলে পাক (সা.)-এর জীবনের মূল উত্স ছিল মহান রাব্বুল আলামিন, কোরআনুল করিম এবং মানুষের কল্যাণ তথা ইসলামী জীবনবিধানকে প্রতিষ্ঠা করা। ন্যায়নীতি, সুবিচার, সাম্য, শ্রমের মর্যাদা, নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, বর্ণবৈষম্য লোপ, দাসত্ব বিলোপ—সব ক্ষেত্রে কুসংস্কার ও পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত মানুষকে চিরশান্তি ও নাজাতের পথ দেখিয়েছেন তিনি।
সব নবীর নবুয়ত শেষ হয়েছে তাঁদের ওফাতের মধ্য দিয়ে। কিন্তু রাসুলে করিম (সা.)-এর নবুয়ত তাঁর ওফাতের পরও শেষ হয়নি। তিনি নবী ছিলেন, আছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত নবী থাকবেন। আর কোনো নবী-রাসুল দুনিয়ায় আসবে না। তাই গোটা বিশ্বের আকাশে-বাতাসে মুহুর্মুহু উচ্চারিত হচ্ছে ‘আশহাদু আন্না মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’। তিনি আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়, অধিক মর্যাদাবান। মিরাজে সপ্ত আকাশ পাড়ি দিয়ে মহান রাব্বুল আলামিনের দিদারে ধন্য হয়েছেন তিনি। আল্লাহপাক আদম (আ.)-কে আদম সফিউল্লাহ। নুহ (আ.)-কে নুহ নবীউল্লাহ ইবরাহিম (আ.)-কে ইবরাহিম খলিলুল্লাহ, ইসমাইল (আ.)-কে ইসমাইল জবিউল্লাহ, মুসা (আ.)-কে মুসা কলিমুল্লাহ, ঈসা (আ.)-কে ঈসা রহুলুল্লাহ উপাধি দিয়েছেন। কিন্তু রাসুল (সা.)-কে উপাধি দিয়েছেন হাবিবুল্লাহ। কেবল আমাদের নবীজিকে বলা হয়েছে রাসুলুল্লাহ এবং হাবিবুল্লাহ। আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠতম অনুগ্রহ পিয়ারা নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)। তিনি মানব ইতিহাসে গুণ ও শ্রেষ্ঠত্বে এক আলোকোজ্জ্বল প্রতিভা। তাঁর নাম আহমাদ (সর্বাধিক প্রশংসাকারী) আর মোহাম্মদ (সর্বাধিক প্রশংসিত)। নামাজে, রুকুতে, সেজদায় যাওয়া ও বসার মধ্য দিয়ে আলিফ, হা, মিম এবং দাল অক্ষরের প্রকৃতি যেন সেই আহমাদ নামের সার্থকতা। আহমাদের মিমের পর্দা উঠালেই বোঝা যায়, আহাদের (এক, অদ্বিতীয়) অস্তিত্ব। মানবতার মুক্তির দূত, অবিসংবাদিত প্রাণপুরুষ বিশ্বনবী এক চলমান ও চিরন্তন আদর্শ। সব নবী ও রাসুলের গুণের সমাহার ছিল তাঁর মধ্যে।
তিনি আদম (আ.)-এর সহনশীলতা, মুসা (আ.)-এর পৌরুষ, হারুন (আ.)-এর কোমলতা, ইয়াকুব (আ.)-এর ধৈর্য, দাউদ (আ.)-এর সাহসিকতা, সোলায়মান (আ.)-এর ঐশ্বর্য, জাকারিয়া (আ.)-এর নমনীয়তা, নুহ (আ.)-এর নির্ভরতা, হুদ (আ.)-এর দৃঢ়তা, শিশ (আ.)-এর বিচক্ষণতা, ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রজ্ঞা, ইসমাইল (আ.)-এর ত্যাগ, ঈসা (আ.)-এর অমায়িকতাসহ আরও বহু গুণে গুণান্বিত। সর্বোত্তম চারিত্রিক গুণেও তিনি গুণান্বিত। ‘নিশ্চয়ই আপনি সর্বোত্তম চারিত্রিক গুণে গুণান্বিত।’ (সুরা কালাম-৪)।
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘তাঁর জীবনাদর্শ হলো কোরআন।’ মহানবী (সা.)-এর ২৩ বছর নবুয়তের জীবনে যেসব ওহি নাজিল হয়েছিল, এর সমষ্টিই হলো আল কোরআন। আল কোরআনে রাসুল (সা.)-এর মোহাম্মদ নামটি চারবার, আহমাদ নামটি একবার, ২৯টি গুণবাচক নাম ২২৪ বার সম্মানসূচক অভিধায় ব্যবহৃত হয়েছে। পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থে, সব কালের সব মহামানবের কণ্ঠে প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রশংসা ও প্রশান্তির বর্ণনা শোনা যায়। সৃষ্টি জগতের কল্যাণ ও আল্লাহপাকের আনুগত্যের পূর্ণময়তায় তাঁর পদযাত্রা ছিল নির্ভীক ও অম্লান। সৃষ্টির সেবা ও সংরক্ষণ প্রিয় নবীর অন্যতম দর্শন এবং মানবিক সাম্য ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
আমাদের উচিত আল্লাহর কিতাব আল কোরআন ও রাসুলের সুন্নাহ অনুসরণ করা; রাসুল যা আদেশ করেছেন, তা পালন করা এবং যা নিষেধ করেছেন, তা বর্জন করা। (সুরা হাসর-৭) সর্বোপরি তাঁর দরুদ পাঠ করা। মহান আল্লাহ তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করেন, ফেরেশতারা দরুদ পাঠ করেন, মুমিনদেরও আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতারা নবীর প্রতি দরুদ পাঠ করেন। হে মুমিনরা! তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করো এবং তাঁকে যথাযথভাবে সম্মান করো (সুরা-আল আহজাব-৫৬)। রাসুল (সা.) স্বয়ং বলেছেন, বেহেশতের সর্বোচ্চ সম্মান ও প্রশংসিত স্থান, তা কেবল এক ব্যক্তিই লাভ করবে। আশা করি আমিই হব সেই ব্যক্তি।’ (তিরমিজি)
সব শেষে বলতে হয়, রাসুলে আকরাম (সা.)-এর সিরাতই সারাদুনিয়ায় আগত-অনাগত সব মানবগোষ্ঠীর জন্য ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তির একমাত্র সোপান। আসুন আমরা তাঁর পূর্ণাঙ্গ আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে তাঁর সম্মান ও মর্যাদাকে যথাযথ স্থান দেই।