সবরের আভিধানিক অর্থ-বাধা দেওয়া বা বিরত রাখা। শরীয়তের ভাষায় সবর বলা হয় অন্তরকে অস্থির হওয়া থেকে, জিহ্বাকে অভিযোগ করা থেকে বিরত রাখা। কারো কারো মতে, এটি হলো মানুষের ভেতরগত একটি উত্তম স্বভাব, যার মাধ্যমে সে অসুন্দর ও অনুত্তম কাজ থেকে বিরত থাকে। এটি মানুষের এক আত্মিক শক্তি যা দিয়ে সে নিজেকে সুস্থ ও সুরক্ষিত রাখতে পারে। কারও মতে, সবর হলো সুন্দরভাবে বিপদের মোকাবিলা করা। আবার কারও মতে, বিপদকালে অভিযোগ-অনুযোগ না করে অমুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করাই সবর।
আল্লাহ তাআলা সবরকে এমন এক যন্ত্র দিয়েছেন যা কখনো ব্যর্থ হয় না, এমন তীর বানিয়েছেন যা লক্ষ ভ্রষ্ট হয় না, এমন বিজয়ী সৈনিক বানিয়েছেন যে কখনো পরাজিত হয় না, এমন সুরক্ষিত দূর্গ বানিয়েছেন যা কখনো ধ্বংস হয়না। এই সবর আর বিজয় দুই সহোদরের মতো। মানুষ তার দুনিয়া ও আখিরাতের বিষয়ে সবরের মতো এমন কোনো অস্ত্রে সজ্জিত হয়না, যা তার নফস ও শয়তানকে নিশ্চিত ভাবে হারিয়ে দেয়।সেই বান্দার কোনো শক্তিই নেই, যার গুণাবলির মধ্যে সবর তথা ধৈর্য নেই। মনে রাখতে হবে যে, ঐ বান্দা বিজয় ছিনয়ে আনতে পারে না যে সবরকারী নয়। তাইতো আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন- হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ধর এবং তাতে অটল থাক এবং পাহারায় নিয়োজিত থাক। আর আল্লাহকে ভয়কর, যাতে তোমরা সফল হও। (সূরা আল ইমরান: ২০০)
এমন সবরকারী যে, আল্লাহর ইবাদত করে দ্বিধা ও সংশয়ের সঙ্গে। এদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা সুন্দর বলেছেন, মানুষের মধ্যে কতক এমন রয়েছে, যারা দ্বিধার সাথে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি তার কোনো কল্যাণ হয় তবে সে তাতে প্র্রশান্ত হয়। আর যদি তার কোনো বিপর্যয় ঘটে, তাহলে সে তার আসল চেহারায় ফিরে যায়। সে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতি গ্রস্থ হয়। এটি হল সুস্পষ্ট ক্ষতি। এ ধরনের ব্যক্তি আসলে সবর হারিয়ে শুধু তার দুর্ভাগ্যই কামাই করে যাবে। পক্ষান্তরে যে সবর করে বিপদে ধৈর্য ধারণ করে সে ভাগ্যবান। পৃথিবীতে যারা সৌভাগ্যবান তারা কিন্তু সবর ও ধৈর্য গুণেই ভাগ্যবান। এরা দুঃসময় এলে ধৈর্য ধরে আর সুসময় এলে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করে। এভাবে তারা জান্নাতের নেয়ামতের অধিকারী হয়। সত্যিই এরা সৌভাগ্যবান। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে প্র্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হও, যার প্র্রশস্ততা আসমান ও যমীনের প্র্রশস্ততার মত। তা প্র্রস্তুত করা হয়েছে ঐ সব লোকদের জন্যে যারা আল্লাহ ও রাসূলদের প্র্রতি ঈমান আনে। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ। তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল। (সূরা হাদীদ: ২১)
সবরের গুরুত্ব: সবর বা ধৈর্য আল্লাহর পরিপূর্ণ মুমিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা যাকে এই গুণ দেন, সেই এই গুণে সুসজ্জিত হয়। আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলদেরকে এই বিরল গুণে ভূষিত করেছিলেন। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.) বলেন, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা নব্বই যায়গায় সবরের কথা বলেছেন। অতএব ভেবে দেখুন সবর কত গুরুত্বপূর্ণ! আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন ভাবে সবরের গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন। তার কিছু প্র্রমাণ কুরআন থেকে তুলে ধরা হল : আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র গ্রন্থে সবরকারীদের প্র্রশংসা করেছেন এবং তাদেরকে হিসাব পূর্ণরূপে দেবেন বলে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, বল হে আমার মুমিন বান্দারা! যারা ঈমান এনেছ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয়কর। যারা এ দুনিয়া ভালো কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ। আর আল্লাহর যমীন প্র্রশস্ত, কেবল ধৈর্যশীলদেরকেই তাদের প্র্রতিদান পূর্ণরূপে দেয়া হবে কোনো হিসাব ছাড়াই। (সূরা যুমার: ১০)
আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: তিনি ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন, তাদের জন্য হেদায়েত ও সুস্পষ্ট বিজয়। ইরশাদ হয়েছে, আর তোমরা ধৈর্য ধর, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। (সূরা আনফাল ৪৬) আল্লাহ তাআলা সবর ও ইয়াকিন তথা ধৈর্য ও ঈমানের বদৌলতে মানুষকে নেতৃত্ব দেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, আর আমি তাদের মধ্য থেকে বহু নেতা করেছিলাম, তারা আমার আদেশানুযায়ী সৎপথ প্র্রদর্শন করত, যখন তারা ধৈর্যধারণ করেছিলো। আর তারা আমার আয়াতসমূহের প্র্রতি দৃঢ়বিশ্বাস রাখত। (সূরা সেজদা: ২৪) আল্লাহ সুবহানাহু ও তাআলা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন সবরই মানুষের জন্য কল্যাণকর। ইরশাদ হয়েছে, আর যদি তোমরা সবর কর, তবে তাই সবরকারীদের জন্য উত্তম। (সূরা নাহল ১২৬) আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিয়েছেন যে, কারও সাথে যদি সবর থাকে তাহলে যত বড়ই শত্রু হোক তাকে পরাস্ত করতে পারবে না। ইরশাদ হয়েছে, আর যদি তোমরা ধৈর্য ধর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই ক্ষতি করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ তারা যা করে, তা পরিবেষ্টনকারী। (সূরা আলে ইমরান ১২০)
আল্লাহ তাআলা বিজয় ও সফলতার জন্য সবর ও তাকওয়া অবলম্বনের শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। ইরশাদ করেছেন, হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ধর ও তাতে অটল থাক এবং পাহারায় নিয়োজিত থাক। আর আল্লাহকে ভয়কর, যাতে তোমরা সফল হও। (সূরা আলে ইমরান ২০০) আল্লাহ তাআলা ধৈর্যশীলকে ভালোবাসেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আর একজন মুমিনের জন্য এর চেয়ে বড় পওয়া আর কী হতে পারে?
আল্লাহ তাআলা ধৈর্যশীলদের তিনটি বিষয়ে সুসংবাদ দিয়েছেন, যার প্রতি পাওয়ার জন্য দুনিয়াবাসী একে অপরের সঙ্গে ঈর্ষা করেন। ইরশাদ হয়েছে, -আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা, তাদেরকে যখন বিপদ আক্রান্ত করে তখন বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকে প্র্রত্যাবর্তনকারী। তাদের ওপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হিদায়াতপ্র্রাপ্ত। ধৈর্যশীলদের জন্য রেখেছেন জান্নাত লাভের কামিয়াবী আর জাহান্নাম থেকে মুক্তির সাফল্য। (সূরা বাকারা: ১৫৫, ১৫৬, ১৫৭) ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয় আমি তাদের ধৈর্যের কারণে আজ তাদেরকে পুরস্কৃত করলাম, নিশ্চয় তারাই হল সফলকাম। (সূরা আল মুমিনূন ১১১) আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের চারটি স্থানে উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর নিদর্শনাবলি থেকে ধৈর্যশীল ও শুকরগুযার বান্দারাই উপকৃত হয় এবং এরাই সৌভাগ্যবান বটে। যেমন ইরশাদ করেছেন, তুমি কি দেখনি যে, নৌযানগুলো আল্লাহর অনুগ্রহে সমুদ্রে চলাচল করে, যাতে তিনি তাঁর কিছু নিদর্শন তোমাদের দেখাতে পারেন। নিশ্চয় এতে প্র্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে। (সূরা লোকমান: ৩১) আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, আর আমি মূসাকে আমার আয়াতসমূহ দিয়ে পাঠিয়েছি যে, তুমি তোমার কওমকে অন্ধকার হতে আলোর দিকে বের করে আন এবং আল্লাহর দিবসসমূহ তাদের স্মরণ করিয়ে দাও। নিশ্চয় এতে প্র্রতিটি ধৈর্যশীল, কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য রয়েছে অসংখ্য নিদর্শন। (সূরা ইব্রাহীম ৫) আরও ইরশাদ করেছেন, কিন্তু তারা বলল, হে আমাদের রব, আমাদের সফরের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দিন। আর তারা নিজদের প্র্রতি যুলম করল। ফলে আমি তাদেরকে কাহিনী বানালাম এবং তাদেরকে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিলাম। নিশ্চয় এতে প্র্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য নিদর্শন রয়েছে। (সূরা সাবা ১৯) অন্যত্র ইরশাদ করেন, তিনি যদি চান বাতাসকে থামিয়ে দিতে পারেন। ফলে জাহাজগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠে গতিহীন হয়ে পড়বে। নিশ্চয় এতে পরম ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে। (সূরা আস শূরা: ৩৩)
সবরের প্রকার:
প্রথম: আল্লাহ তাআলার আদেশ-নির্দেশ পালন ও ইবাদত-বন্দেগী সম্পাদন করতে গিয়ে ধৈর্য ধারণ করা।
দ্বিতীয়: আল্লাহ তাআলার নিষেধ এবং তার বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে অটুট ধৈর্য রাখা। এবং
তৃতীয়: তাকদীর ও ভাগ্যের ভালো-মন্দে অসন্তুষ্ট না হয়ে ধৈর্য ধরা। একজন বান্দাকে অবশ্যই তিনটি বিষয়ে ধৈর্য ও সংযমের পরিচয় দিতে হবে। কিছুু আদেশ পালনে, কিছুু নিষেধ থেকে বিরত থাকায় এবং তাকদীরের ওপর। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত লুকমান আলাইহিস সালামের বিখ্যাত উপদেশেও এ তিনটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, হে আমার প্রিয় বৎস! সালাত কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও, অসৎকাজে নিষেধ কর এবং তোমার ওপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধর। নিশ্চয় এগুলো অন্যতম দৃঢ়সংকল্পের কাজ। (সূরা লুকমান ১৭) লুকমান আলাইহিস সালাম যে সৎকাজের আদেশ দাও বলেছেন, তার মধ্যে নিজে সৎ কাজ করা এবং অপরকে সৎ কাজের উপদেশ দেয়া উভয়টি অন্তর্ভুক্ত। তেমনি অসৎ কাজে নিষেধ করার মধ্যেও উভয়টি রয়েছে। এখানে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ শব্দই আমাদের এমন ধারণা দেয়। তা ছাড়া শরীয়তের দৃষ্টিতেও সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ বাস্তবায়িত হয়না, যতক্ষণ না আগে নিজে তা পালন করা হয়। এ দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, বুদ্ধিমানরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে। আর তাদের কর্মপদ্ধতি এমন হয় যে, তারা আল্লাহকে দেওয়া নিজেদের অঙ্গীকার পালন করে এবং তাকে মজতুব করে বাঁধার পর ভেঙ্গে ফেলে না। তাদের নীতি হয়, আল্লাহ যেসব সম্পর্ক ও বন্ধন অক্ষণ্ন রাখার হুকুম দিয়েছেন। সেগুলো তারা অক্ষুণ্ন রাখে, নিজেদের রবকে ভয় করে এবং তাদের থেকে কড়া হিসেব না নেয়া হয়, এই ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে। তাদের অবস্থা হয় এই যে তারা তাদের রবের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সবর করে, সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদের যে রিযক প্র্রদান করেছি, তা থেকে গোপনে ও প্র্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং ভালো কাজের মাধ্যমে মন্দকে দূর করে, তাদের জন্যই রয়েছে আখিরাতের শুভ পরিণাম। (সূরা রা‘দ ১৯-২২)
বিপদে ধৈর্য ধরার ফযীলত অনেক। তাই বলে শরীয়তে বিপদ কামনা করার অনুমতি দেয়া হয়নি। কারণ, মুমিন সচেতন ও বুদ্ধিমান। সে কখনো বিপদ প্রত্যাশা করতে পারেনা। তবে বিপদ এসে পড়লে তাতে সে বিচলিতও হয়না; বরং ধৈর্য ধরে। বিপদের সময় দৃঢ়তাও সহনশীলতার পরিচয় দেয়। যেমন বুখারী শরীফে আব্দুল্লাহ বিন আবূ আওফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, যুদ্ধের দিন গুলোতে একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপেক্ষায় থাকলেন। যখন সূর্য ডুবে গেল তখন তিনি তাঁদের মাঝে দাঁড়িয়ে বললেন, হে লোক সকল! তোমরা শত্রুদের সঙ্গে মুখোমুখি হবার প্র্রত্যাশা করো না এবং আল্লাহ তাআলার কাছে শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা করো। তবে যখন তোমরা তাদের মুখোমুখি হও, তখন ধৈর্য ধর এবং সবর করো। আর জেনে রেখো, জান্নাত তরবারির ছায়া তলে। (সহীহ মুসলিম ৩২৮২) একজন প্র্রকৃত মুমিন কিন্তু সর্বাবস্থায় দৃঢ়ভাবে এ কথা বিশ্বাস করে যে, সে যে অবস্থায় আছে, তাতে কোনো কল্যাণ নিহিত রয়েছে। যেমন মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, মুমিনের অবস্থা কতইনা চমৎকার! তার সব অবস্থায়তেই কল্যাণ থাকে। এটি শুধু মুমিনেরই বৈশিষ্ট্য যে, যখন সে আনন্দের উপলক্ষ পায়, তখন সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। ফলে তা হয় তার জন্য কল্যাণবাহী। আর যখন সে কষ্টের সম্মুখীন হয়, তখন সবর করে এবং ধৈর্যে অটল থাকে। ফলে এটিও তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।
বিপদ মুমিনের নিত্যসঙ্গী আমাদের মনে রাখতে হবে, মুমিনের পুরো জীবনই পরীক্ষায় ভরা। আল্লাহ তাআলা যেমন ইরশাদ করেন, আর ভালো ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাকে প্র্রতি মুহূর্তে পরীক্ষা করেন। তিনি দেখতে চান কে ধৈর্যশীল, কে মুজাহিদ আর কে সত্যবাদী। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যতক্ষণ না আমি প্র্রকাশ করে দেই তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদকারী ও ধৈর্যশীল এবং আমি তোমাদের কথা কাজ পরীক্ষা করে নেব। (সূরা মুহাম্মাদ: ৩১) অন্যত্র ইরশাদ করেন, যদি তোমাদেরকে কোনো আঘাত স্পর্শ করে থাকে তবে তার অনুরূপ আঘাত উক্ত কওমকেও স্পর্শ করেছে। আর এইসব দিন আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন করি এবং যাতে আল্লাহ ঈমানদারদেরকে জেনে নেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে শহীদদেরকে গ্রহণ করেন। আর আল্লাহ যালিমদেরকে ভালোবাসেন না। (সূরা আলে ইমরান: ১৪০) ‘আল্লাহ তাআলা আরও সুনির্দষ্ট করে বলেন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীক্ষা বিশেষ। আর আল্লাহর নিকটই মহান প্র্রতিদান। (সূরা তাগাবুন: ১৫)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সাহাবীদের সবর শিক্ষা দিয়েছেন। এটি বেশি করা হয়েছে মক্কী জীবনে। যেমন খুবাইব বিন আরাত রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীসে আমরা এর চিত্র দেখতে পাই। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন কাবার ছায়ায় বালিশে হেলান দিয়ে আরাম করছিলেন। আমরা তাঁর কাছে অভিযোগ করলাম, কেন আপনি আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য সাহায্য চাইছেন না, আমাদের জন্য তাঁর কাছে দুআ করছেন না। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের পুর্ববর্তীদের মধ্যে এমন বিপদও এসেছে যে কাউকে ধরা হতো। তারপর গর্ত খনন করে তাকে সেই গর্তে ফেলা হতো। এরপর করাত এনে তার মাথার ওপর রাখা হতো। অতঃপর তাকে দুই টুকরো করে লোহার চিরুনী দিয়ে তার শিরা-অস্থিসহ আচড়ানো হতো। তদুপরি তারা তাকে দ্বীন থেকে ফেরাতে পারতো না। আল্লাহর শপথ! এখন আমাদের পরীক্ষা চলছে আল্লাহ এ দ্বীনকে পূর্ণতা দেবেন। একদিন এমন আসবে যখন আরোহীরা সানআ থেকে হাযারামাউত পর্যন্ত যাবে। চিতাবাঘ আর ছাগল নিরাপদে থাকবে। এক আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করতে হবে না। কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়া করছো। অর্থাৎ মক্কার মুশরিকদের আযাব অচিরেই দূর হয়ে যাবে। সুতরাং অতীতের উম্মতের মতো তোমরাও দ্বীনের বিপদে একটু ধৈর্য ধরো। সহীহ বুখারী ৩৬১২ এবং সুনানে আবু দাউদ ২৬৪৯)
সবরের ফযীলত-মর্যাদা: সবরের কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহর বান্দা মাত্রই সবর করতে হবে। কেননা কখনো আল্লাহর আদেশ মানতে হবে, তাঁর নির্দেশিত কাজ করতে হবে। আবার কখনো তাঁর নিষেধ মেনে চলতে হবে, বিরত থাকতে তা করা থেকে। আবার কখনো অকস্মাৎ তাকদীরের কোনো ফয়সালা এসে পড়বে। নেয়ামত দেয়া হবে, তখন শুকরিয়া আদায় করতে হবে। এভাবে নানা অবস্থার মধ্য দিয়ে মুমিনের জীবন অতিবাহিত হয়। সুতরাং মৃত্যু পর্যন্ত এই সবরকে সাথে নিয়েই চলতে হবে। এজন্যই সবরের অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।
উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি কোনো বিপদে পড়ে আল্লাহ যা নির্দেশ দিয়েছেন অর্থাৎ إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ পড়বে এবং বলবে, হে আল্লাহ, আমাকে আমার বিপদের প্র্রতিদান দিন এবং আমাকে এর চেয়ে উত্তম কিছুুদান করুন। আল্লাহ তাকে তার চেয়ে উত্তম কিছুুদান করবেন।’ উম্মে সালামা বলেন, আবূ সালামা মারা গেল। আমি ভাবলাম, আবূ সালামার চেয়েউত্তম মুসলমান আর কে হতে পারে? তাঁর ঘরেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্ব প্রথম হিজরত করেছেন। আমি মনে মনে এ কথা ভাবলাম আর আল্লাহ তাআলা আমাকে স্বয়ং রাসূলুল্লাহকেই স্বামী হিসেবে দান করলেন। (সহীহ মুসলিম হাদীস ১৫৩২)
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ যার ভালো চান, তাকে বিপদ দেন। সহীহ বুখারী: ১৩২)
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মুমিনকে যে কোনো বিপদই স্পর্শ করুক না কেন আল্লাহ তার বিনিময়ে তার গুনাহ মাফ করে দেন। এমনকি চলতি পথে পায়ে যে কাঁটা বিঁধে তার বিনিময়ে ও গুনাহ মাফ করা হয়। বুখারী: ৫৬৪০ মুসলিম: ২৫৭২।
আবূ মুসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন কোনো ব্যক্তি অসুস্থ হয় অথবা সফর করে, তার জন্য সে সুস্থ্য ও ঘরে থাকতে যেরূপ নেকি কামাই করতো অনুরূপ নেকি লেখা হয়। সহীহ বোখারী ৪৭৪৯ সুনানে আবু দাউদ ৩০৯১
উরওয়া ইবনে যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধে আহত হবার পর যখন সাহাবীরা তার পাও কাটতে উদ্যত হলেন, তারা বললেন,-আমরা কি আপনাকে কিছু খাইয়ে দেবো যাতে আপনি কষ্ট অনুভব না করেন? তিনি বললেন, আল্লাহ আমাকে আমার ধৈর্য দেখার জন্যই এ বিপদে ফেলেছেন। আমি কি তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারি?
উমর বিন আবদুল আজীজ রহ.বলেন, যাকে আল্লাহ তাআলা কোনো নেয়ামত দিয়ে তা ছিনিয়ে নিয়েছেন এবং তার স্থলে তাকে সবর দান করেছেন, তো এই ব্যক্তি থেকে যা ছিনিয়ে নিয়ে নেওয়া হয়েছে তার চেয়ে সেটাই উত্তম যা তাকে দান করা হয়েছে। (বাইহাকী: ৯৫৬৫)
মূল কথা হলো: জীবনের প্র্রতিটি অঙ্গনে আমাদেরকে সবর ও ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। ধৈর্য ধরতে হবে প্র্রতি বেশির আচরণে। তার দেয়া কষ্ট আল্লাহর নেকির প্র্রত্যাশায় সহ্য করতে হবে। থাকতে হবে তার কল্যাণে সদা সচেষ্ট। আত্মীয়দের কথা যদি বলেন, তারাও কষ্ট দেবে আপনাকে। এতে সবর করুন আর নেকির প্র্রত্যাশায় থাকুন। আপনার অধীনস্ত যারা আছে তারাও আপনাকে ত্যক্ত-বিরক্ত করবে। তাদের আচরণেও আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে। মনে রাখবেন, পৃথিবীটা কিন্তু আপনার-আমার নিয়ম মাফিক চলবে না। জগতের সবাই নিয়ম রক্ষাও করতে পারবে না। স্বামী হলে স্ত্রীর ব্যবহারে আপনাকে সহিষ্ণুতা ও সবরের স্বাক্ষর রাখতে হবে। তার মন্দ দিকগুলো যখন ফুটে উঠতে থাকে, তখন আপনি তার ভালোও প্রশংসনীয় গুণগুলো সামনে আনবেন। একইভাবে আপনি যদি স্ত্রী হন, তবে আপনাকেও ওই সবরের দ্বারস্থ হতে হবে। স্বামীর সব কিছুতেই অভিযোগ আনলে চলবে না। তার ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করুন। ঘরের বাইরে তিনি যে কষ্ট-যাতনা সহ্য করেন তার দিকে তাকিয়ে আপনি ঘরের ভেতরে তার অপছন্দনীয় জিনিসগুলো সহনীয় হিসেবে গণ্য করুন।
মানুষের আচরণে সবর করতেই হবে। সবাই তার দায়িত্ব সুন্দরভাবে সম্পাদন করতে পারে না। সব মানুষের আখলাক-চরিত্রও এক রকম নয়। একেকজনের স্বভাব একেকরকম। অতএব সবরের কোনো বিকল্প নেই। সবর করুন আর এর সুফলের কথা মাথায় রাখুন। কারণ, সবরকারী তার সবরের বদৌলতে অনেক কল্যাণ অর্জন করেন। যার সবর নেই, সবখানেই তিনি কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সবরের মতো মহৎ গুণের অধিকারী বানান। আমাদেরকে ধৈর্যশীল বান্দা হবার তাওফীক দিন। আমীন