সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বোৎকৃষ্ট মাস মাহে রমযান, হাজার মাসের সেরা। শান্তির বার্তা নিয়ে উদ্বেলিত উচ্ছ্বসিত করে তুলেছে মুমিনের হৃদয়। আমলী মুসলিম জাতির খুশির আর অন্ত নেই। রমযানের প্রথমে মাহে রমযানকে স্বাগত ও মোবারক জানাতে তারা বিভিন্নভাবে রমযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলেছিল ‘খোশ আমদেদ মাহে রমযান’ স্লোগানে। আর মুমিন খুশি না হয়ে কি পারে?
আমলের বসন্তকাল হলো মাহে রমযান। আমল ও ইবাদতের এক লোভনীয় ও জমজমাট অফার নিয়ে প্রতিবছর মুমিনের দুয়ারে হাজির হয় এই পবিত্র মাস। এ মাসে আমলের সওয়াব আল্লাহ অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে থাকেন। এজন্য রমযান মাসে মসজিদগুলো কানায় কানায় ভরে ওঠে, লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। সারা দিন রোযা পালনের পর ক্লান্ত শান্ত শরীর নিয়ে তারা ঈশার নামাযসহ তারাবীর নামায পড়ার মতো বিশাল কষ্ট স্বীকার করে থাকেন অনায়াসেই। এ জন্য আল্লাহ্ এর প্রতিদান স্বহস্তে দান করবেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে বনি আদমের প্রতিটি আমলের প্রতিদান বহুগুণে বৃদ্ধি হতে থাকে-১০গুণ থেকে ৭০০ গুণ এমনকি আল্লাহ্ চাইলে তার চেয়ে বেশি দিবেন। আর রোযার ক্ষেত্রে কুরআনে এরশাদ হয়েছে, রোযা আমার জন্য আমি তার প্রতিদান দেবো। হাদীস শরীফে আছে রোযাদারদের জন্য দু’টি আনন্দঘন মুহূর্ত রয়েছে একটি হচ্ছে ইফতারের সময়। আর অপরটি হচ্ছে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময়। (মুসলিম শরীফ)
এই অর্জনের মহা সুযোগটি ক্রমান্বয়ে বিদায় নিতে চলেছে। রহমত, মাগফিরাত, নাজাতের ঘোষক পবিত্র মাহে রমজান। লোভনীয় অফার কখন স্থায়ী হয় না। আর হলে মূল্যায়ন থাকে না। আমলের বসন্তকাল চলে যাচ্ছে। আর এটি বিদায় নেওয়ার আগে সুন্দর মহোৎসবটি আমাদের অবশ্যই উপহার দিয়ে যাবে। পবিত্র মাহে রমযান একমাস সিয়াম সাধনা মানব জীবনের শুদ্ধতা লাভের এক সুযোগ এনে দেয়।
সাওম মানে বিরত থাকা। কুকর্ম, কুচিন্তা ও ইন্দ্রিয় পরির্চচা পরিহার করে সংযমী হওয়াই রোযার শিক্ষা। রামযান এর শাব্দিক অর্থ দগ্ধ করা। সিয়াম সাধনার উত্তাপে, ধৈর্যের অগ্নিদহনে মুসলমান মাত্রই এ মাসে কু-প্রবৃত্তিকে দগ্ধ করে শুদ্ধ-পরিশোধিত মানুষে পরিণত হয়। তাই রমযানুল মুবারক দৈহিক, আত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধির প্রশিক্ষণের মাস। দিনের বেলায় রোযা আর রাত্রে আমলের মাধ্যমে দেহমনকে পরিশুদ্ধ করতে পারে এ রমযান মাসে। পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতা জন্য সিয়াম পালিত হয়ে থাকে।
রোযা রাখা হয়: ১। চিত্ত শুদ্ধির জন্য ২। পরিচ্ছন্নতার জন্য ৩। সত্যবোধকে জাগ্রত রাখার জন্য ৪। পার্থিব আকাঙ্খাকে নিবৃত্ত রাখার জন্য ৫। বিনয় ও নম্রতা প্রতিষ্ঠার জন্য, সহমর্মিতা ও সোহান্দ্যরে চেতনায় উজ্জীবনের জন্য এবং ৬। সর্বোপরি মহান প্রভু আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য।
আত্মিক পরিশুদ্ধি: সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক পবিত্রতা অর্জন করে থাকে। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম আল-জাওযি (রহঃ) বলেন, মানুষের আত্মিক ও দৈহিক শক্তি সংরক্ষণে রোযা অত্যন্ত কার্যকর। একদিকে মানুষের পাশবিক চাহিদার প্রাবল্য থেকে মুক্ত করে তার দৈহিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিশ্চয়তা বিধান করে। অপরদিকে নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে আত্মিক সুস্থতা সাধন করে। মাসব্যাপী রোযার মাধ্যমে মানুষের জৈবিক চাহিদা ও পাশব প্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে যায়। মনুষ্যত্ব ও রুহানিয়ত সজীব জাগ্রত হয়। রিপূর তাড়নামুক্ত হয়ে মানুষ আল্লাহ্ প্রদত্ত বিবেক ও প্রজ্ঞার সদ্ব্যবহার করে সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী হতে পারে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ সতকর্মের প্রতি ধাবিত হওয়ার প্রণোদনা লাভ করে এবং অসদুপায়ে সম্পদ পুঞ্জীভূত করার মানুসিকতা লোপ পায়।
আমরা সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে চিত্ত শুদ্ধির কথা বলেছি। চিত্তশুদ্ধি কাকে বলে? মানুষের চিত্ত সর্বদাই চঞ্চল। আমাদের চিত্তে নানা ধরনের ইচ্ছা জাগে এবং সে সব ইচ্ছার দু’টোই আছে। কিন্তু চিত্তকে শাসনে রেখে অপরাধের আগ্রহ থেকে মুক্ত রাখা অত্যন্ত কঠিন। এখন এ কাজটি কিভাবে সাধন করতে হবে? তার একটি প্রথাগত দিক-নির্দেশনা আমরা সিয়াম সাধনার মধ্যে পেয়ে থাকি। রমযানে ব্যবহারিক নিয়ম-কানুনগুলো আমরা যদি পরিপূর্ণভাবে পালন করি, তাহলে তার মধ্যদিয়ে চিত্তশাসন সহজেই কার্যকর হয়। একজন মানুষ যদি সারা দিন আহার্য ও পানীয় গ্রহণ না করে এবং সে সময়টুকুতে যদি সে যদি মহান প্রভু আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সর্ববিধ কার্যক্রম গ্রহণ করে, তাহলে তার চিত্তে পার্থিব আকাঙ্খা জাগবে না এবং অশুদ্ধ ও বিকল চিন্তায় চিত্ত ভারাক্রান্ত হবে না।
নৈতিক পরিশুদ্ধি: ‘যখন রমযান শুরু হয়, মহান আল্লাহ্ জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত করে দেন। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেন এবং শয়তানকে শৃঙ্খলিত করে রাখেন।’ যার কারণে ইবাদত, জিকির, তেলাওয়াত, আমল আখলাকে ও আল্লাহর একনিষ্ঠ আনুগত্যের স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কেবল পানাহার পাপাচার ত্যাগ করলে রোযা পালন হয় না। সেই সঙ্গে সব ধরনের অন্যায় পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অন্তরকে করতে হবে পরিচ্ছন্ন। তবে রোযা মুমিনের জীবনে নিয়ে আসবে অফুরন্ত রহমত ও বরকত। এ প্রসঙ্গে নবী করিম (সা.) বলেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রোযা রাখে সে যেন কোনরকম অশ্লীলতা ও হৈ-হুল্লোড় না করে। কেউ যদি তাকে গালাগালি করে তার সাথে ঝগড়া করে সে যেন বলে- আমি একজন রোযাদার’। (বুখারী ও মুসলিম)।
রমযান আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার দ্বার প্রান্তে উপনীত হয়েছে। চলে যাবে এগারো মাসের জন্য। আমাদের বাকী দিনগুলো, ধৈর্য ও সহনশীতার সাথে রোযা পালন করতে হবে। রমযান শেষে যেমন প্রত্যেক সামর্থবান ব্যক্তিকে সাদকাতুল ফিতর দিতে হয়, তেমনিভাবে অনেকে এই রমযানে যাকাতের ফরয আমলও আদায় করতে চেষ্টা করেন। সুতরাং সকলের উচিত সামর্থ অনুযায়ী গরীব-দুঃখীদেরকে দান খয়রাত করা। মহানবী (সাঃ) বলেন, হে আয়েশা! অভাবগ্রস্ত মানুষকে ফেরত দিও না। একটি খেজুরকে টুকরো টুকরো করে হলে ও দান কর। দরিদ্র মানুষকে ভালোবাসো এবং কাছে টানো। কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ্ তোমাকে কাছে টানবেন।’ সমাজের প্রতিটি সদস্য সিয়াম সাধনার ফলে অর্জিত সহমর্মিতার শিক্ষা বছরের এগার মাস অনুশীলন করতে পারে তাহলে ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়া সম্ভব।
রমযান চলে গেলে কি আমরা সব ইবাদত বন্দেগী ছেড়ে দেবো?: সত্যিকার মুমিন বান্দা সর্বদাই আল্লাহর এবাদত করবে। কোন নির্দিষ্ট মাস, জায়গা অথবা জাতির সাথে মিলে আমল করবে না। মুমিন বান্দা মনে করবে যিনি রমযানের প্রভু তিনি অন্যান্য সকল মাসেরও প্রভু। তিনি সকল কাল ও স্থানের প্রভু। রমযান শেষ হয়ে গেলেও শাওয়ালের ছয় রোযা, আশুরা, আরাফা, সোমবার, বৃহস্পতিবার আইয়ামে বীযের রোযা (চন্দ্র মাসের তের চৌদ্দ ও পরেন তারিখ) ইত্যাদি নফল রোযা রয়েছে। তারাবীহের নামায শেষ হয়ে গেলেও তাহাজ্জুদ নামায বাকি আছে সারা বছর। অতএব নেক আমল সব সময় সব জায়গাতেই করা যায়। হে ভাই সকল! আসুন আমরা নেক আমলে অলসতা না করে চেষ্টা চালিয়ে যাই।
যদি নফল আদায় করতে মন না চায়, তাহলে কমপক্ষে ফরয ওয়াজিব যেন ছেড়ে না দেই। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতের সাথে আদায় করা এবং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে দ্বীনের উপর অটল থাকার তাওফীক দান করুন। আমিন ॥