১ম পর্ব
“নামের বড়াই করো না কেউ,
নাম দিয়ে কী হয়?
নামের মাঝে পাবে না তো
সবার পরিচয়।”
ছোটবেলা এই গানটি শুনতে খুব ভালো লাগতো। মনে হতো সত্যিই তো নাম দিয়ে কী হয়? রাজা বাদশা নবাব নামে অনেক ফকির মিসকিন দেখেছি। আবার ফকির আহমেদ, গরীবউল্লাহ, খয়রাত হোসেন নামে অনেক ধনী লোকও দেখেছি।
জামিলা (সুন্দরী) হাসিনা (অপরূপা) নামে অনেক কুৎসিত মেয়ে দেখেছি, আবার লাইলি, (রাত্রি)-কালী নামে অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখেছি। বোবা মেয়ের নাম সুভাষিণী আর কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন আমাদের সমাজে কম নেই।
নামের গুরুত্ব:- কিন্তু তারপরও নামের বিরাট একটা গুরুত্ব আছে। রাসূল (সা.) বলেছেন ‘তোমরা সন্তানদের ভালো নাম রাখো।’ রাসূল (সা.) অনেক সাহাবীর খারাপ নাম বদলে ভালো নাম রেখেছেন। যেমন বিখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রার নাম ছিল আব্দুস শামস, যার অর্থ অরুণ (সূর্য) দাস। কারো মতে আব্দুল ওজ্জা বা ওজ্জার দাস। রাসূল (সা.) তার নাম রাখেন আব্দুর রহমান। হযরত আবু বকর (রা.) এর পূর্বে একটি মুশরিকি নাম ছিল, তা বদলে দিয়ে রাসূল (সা.) তার নাম আব্দুল্লাহ রাখেন যদিও আবু বকর নামেই তিনি অধিক পরিচিত।
আর এক ব্যক্তির নাম ছিল হাজন, মানে দুঃখ, কষ্ট, অভাব, দুর্ভাগা ইত্যাদি। রাসূল (সা.) বললেন ‘তোমার নাম বদলে রাখো সাহল। সাহল মানে সহজ, সুখ, সচ্ছলতা, সৌভাগ্যবান। নামের একটা তাছির বা প্রভাব আছে। আল্লাহর নামের সাথে আব্দুন যোগ করে নাম রাখা রাসূল (সা.) পছন্দ করতেন। আর যে কোনো সুন্দর অর্থবোধক নাম তিনি পছন্দ করতেন।
আমরা বাংলাদেশী। বাংলা আমাদের ভাষা। আমরা বাচ্চাদের ডাকনাম বাংলায় রাখতে পারি তবে অবশ্যই একটি ইসলামী নাম থাকা উচিত যা শুনলে মুসলিম বলে চেনা যায়। আর বাংলা ভাষায় যে নামটি রাখবো তা যেন অবশ্যই অর্থবোধক এবং শির্কমুক্ত হয়। কোনো দেবদেবীর নাম, না হয়। ফুলের নাম, নদীর নাম, পাখির নাম কিংবা অন্য কোনো সুন্দর অর্থবোধক বাক্য হতে পারে।
আসলে নাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। রাসূল (সা.) হাজন নামে এক ব্যক্তির নাম বদলে সাহল রেখেছিলেন কিন্তু সেই দুর্ভাগা ব্যক্তি (হাজন শব্দের অর্থও দুর্ভাগা) বলেছিল,“ থাক, আমার বাবা মা যখন রেখেছে এই নামই থাক।” রাসূল (সা.) তাকে আর কিছু বলেননি। পরবর্তীতে তার নাতী বর্ণনা করেছে “ আমাদের জীবন থেকে দুঃখ দুর্দশা কখনও দূর হয়নি।
আমাদের জাতীয় কবীর নাম ছিল দুখু মিয়া। সারাটি জীবন তার দুঃখে-দুঃখেই পার হলো। কী দরকার এ সব বাজে নাম রাখার?
মানুষ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ট। অন্যান্য প্রাণীও মানুষের মতো খায়, ঘুমায়, পরিশ্রম করে, বিশ্রাম নেয়, বংশ বৃদ্ধি করে, সন্তান বাৎসল্যও তাদের আছে। তারপরও মানুষের জীবন পদ্ধতির সাথে তাদের জীবন পদ্ধতি আকাশ পাতাল পার্থক্য। এই পার্থক্যের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো, মানুষ তার সন্তানের জন্য সুন্দর একটা নাম রাখে। নাম শুধু পরিচিতি চিহ্ন নয়। নামকরণের বেলায় অর্থপূর্ণ এবং শ্র“তি মধুর নাম রাখা প্রত্যেক মুসলিম মা বাবার কর্তব্য। একটি সুন্দর নাম বাবা মায়ের নিকট সন্তানের প্রাপ্য অধিকার। বাবা মা যদি এ অধিকার থেকে সন্তানকে বঞ্চিত করে তাহলে তাদেরকে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। রাসূল (সা.) বলেছেন, “হাশরের মাঠে প্রত্যেককে নাম ধরেই ডাকা হবে। তাই কারো নাম যদি ইসলামী রীতি বহির্ভূত, নিরর্থক, অথবা দাম্ভিকতাপূর্ণ হয় সে জন্য পিতা-মাতাকেই জবাবদিহি করতে হবে।
নামের বিকৃতি:- নাম মানুষের অত্যন্ত প্রিয় একটি জিনিস। আমার মনে হয় প্রত্যেকটি মানুষ তার নামকে ভালোবাসে তাই কারো নামের বিকৃতি করা উচিত না। অন্তর্যামী আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা তিনি বান্দার ভালো লাগা মন্দ লাগা জানেন তাই বলছেনÑ “তোমরা কাউকে খারাপ নামে ডেকো না।” (সূরাহ হুজুরাত: ১১)
আল্লাহ যে কাজ করার আদেশ দেন তা পালন করা, ফরজ। আর যা তিনি নিষেধ করেন তা করা, হারাম। তা করলে কবীরা গুনাহ হবে। কবীরা গুনাহের গুরুত্ব বুঝতে হবে। বিভিন্ন ভালো কাজের মাধ্যমে সাগীরা (ছোট) গুনাহ মাফ হয় কিন্তু কবীরা গুনাহ মাফ হয় না। কবীরা গুনাহ থেকে মাফ পেতে হলে সেই গুনাহ থেকে বিশেষভাবে আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে, তওবা করে, আর কখোনো করবো না বলে কান্নাকাটি করতে হবে। অতএব কাউকে বিকৃতি নামে ডাকাকে আমরা যতোই তুচ্ছ মনে করি না কেন আসলে বিষয়টি কিন্তু তুচ্ছ না।
নাম বিকৃতিকারীগণ নামকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, সেই বিকৃত শব্দ থেকে আসল নাম খুঁজে পাওয়াই মুসকিল। আমাদের বাসার পাশে বাস করত ঘ্যাণা শেখের মেয়ে কুনু। শুনলে অবাক হবেন কুনুর সঠিক নাম কুলসুম, আর ঘ্যানা শেখের নাম আনোয়ার শেখ। কী করে যে আনোয়ার শেখ ঘ্যাণা শেখ হলো তা আবিস্কার করতে বোধহয় প্রতœতত্ত্ববীদ লাগবে। নাম বিকৃতি করা যেন একটা স্বভাবে পরিণত হয়েছে এক শ্রেণী মানুষের। মতী কে মইত্যা, খলীল কে খইল্যা, জলিলকে জইল্যা ইত্যাদি বলে ।
যা হোক আমাদের অনেকের মধ্যেই কম-বেশি করে নাম বিকৃতি করার অপতৎপরতা আছে। আমরা যেন এই অপতৎপরতা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারি। আল্লাহ আমাদের সাইকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন ॥
না বুঝে নাম রাখা:- বৈঠকে নতুন মুখ দেখে জিজ্ঞেস করলাম। “আপা আপনার নাম কী?” সেই আপা খুব গম্ভির স্বরে উত্তর দিলেন। “আমার নাম কা’য়াস ফিম্ মা’কুল” সূরাহ ফীলের শেষ আয়াত”। আর একবার এক ভদ্র মহিলা গর্বের সাথে বলে ছিলেন তার নাম ‘আল ক্বারিয়া’। আর একজন তার ছেলের নাম রেখেছে খিঞ্জির আহমেদ, কেউ রাখে ‘নার’ জাহেলা। আবার অহংকারের সাথে বলে এইসব শব্দ আল কুরআন থেকে নেওয়া।
কায়াস্ ফিম্ মা’কুল অর্থ- পশুর চিবানো ভূসি। আল ক্বারিয়া অর্থ- চরম দুর্ঘটনা। খিঞ্জির মানে শুকর। নার-আগুন। জাহান্নাম বুঝাতে ‘নার’ ব্যবহার করা হয়েছে আল কুরআনে। জাহেলা মানে চরম মূর্খ। এমনি আরও অনেক শব্দ আল কুরআনে আছে যার কোনো মানে না বুঝেই বাচ্চাদের নাম রাখে আর মনে মনে খুশি হয় এই ভেবে, যে নামটি কুরআন থেকে রেখেছি।
বাবার নামের সাথে মিলিয়ে নাম:-আব্দুল আলীম মানে আলীমের বান্দা- গোলাম বা দাস। আলীম আল্লাহ পাকের একটি নাম। তাহলে আসগর আলীমের অর্থ কী হতে পারে? আসগর অর্থ ছোট। আবার বাবার নাম আব্দুর রহমান, ছেলের নাম দুলাল রহমান। কি হলো এইবার?
আব্দুর রহমান মানে রহমানের দাস, আর দুলাল রহমান মানে রহমানের পূত্র। আসতাগফিরুল্লাহ। (আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন)
আসল কথা হচ্ছে আমরা যে নাম-ই রাখি না কেন, যেন অর্থ জেনে-বুঝে রাখি।
নাম নিয়ে কতো কথাঃ- মুহাম্মাদ আব্দুল মান্নান নামের অতি পণ্ডিত এক লোক বিজ্ঞের মতো মাথা দুলিয়ে বললো “বাংলাদেশের যতো ইসলামী আন্দোলনের নেতা আছেন, তাদের কারো নামই তো ইসলামী না!!
বুঝতে না পেরে বললাম “তার মানে?”
ভদ্রলোক বলতে লাগলো “অধ্যাপক গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, দেলোয়ার হোসেন সাইদী, মহিউদ্দিন খান আহমদ শফি প্রমুখ এদের একজনের নামের আগেও কী মুহাম্মাদ শব্দটি আছে?”
বললাম “তাহলে রাসূল (সা.) এর সাহাবীরাও তো ইসলামী নাম রাখেন নাই, কী বলেন? আবু বকর (রা.) ওমর (রা.) আলী (রা.) এঁদের কারো নামের আগেও তো মুহাম্মাদ নেই।” ভদ্রলোক এইবার চুপ হয়ে গেলেন।
মুহাম্মাদ যদি কারো নাম রাখা হয় তবে মুহাম্মাদই রাখতে হবে। নামের অংশ হিসাবে প্রথম কিংবা শেষে রাখার কোনো যুক্তি নেই।
আবার মেয়েদের নামের আগে মোসাম্মাত লাগায়। মোসাম্মাত শব্দের অর্থ নামীয় বা নাম বিশিষ্ট। যেমন- মোসাম্মাত আমেনা বেগম। এর অর্থ হলো আমেনা বেগম নাম বিশিষ্ট। এর কোনো দরকার আছে? অনেকের ধারণা নামের আগে ছেলেদের জন্য মুহাম্মাদ এবং মেয়েদের জন্য মোসাম্মাত লাগানো বোধ হয় জরুরী। মোটেও না।
হিন্দুরা তাদের নামের আগে শ্রীমাণ শ্রীমতী। ইংরেজরা মিষ্টার, মিস্ , মিসেস লেখে। দীর্ঘদিন হিন্দু এবং ইংরেজদের অধীনে থেকে আমাদেরও সখ হয়েছে নামের আগে-পিছে কিছু লাগানো। এছাড়া আর কিছু নয়।
এক বয়স্ক ভদ্র মহিলাকে সীরাত মাহফিলের দাওয়াত দিতে যেয়ে কার্ড হাতে নিয়ে বিনয়ের সাথে বললাম “ খালাম্মা আপনার নামটা যদি বলেন—–।”
ভদ্র মহিলা বললেন “ লেখো মিসেস্ চৌধুরী।” হায় আল্লাহ বাবা-মা কী কোনো নাম রাখেননি? কী আর করা মিসেস্ চৌধুরী লিখেই কার্ডটা তার হাতে দিয়ে এলাম।
কী আশ্চর্য নারী স্বাধীনতা নিয়ে এত হৈ চৈ। পুরুষের সমান অধিকার আদায়ের জন্য কত আন্দোলন, অথচ পরিচয় দেওয়ার সময় পুরুষের লেজুর হওয়া। এটা কেমন মানষিকতা?
বিয়ের পর বরের নামের অর্ধেক নিজের নামের সাথে যোগ করা ফ্যাশন না সভ্যতা বুঝি না। গুটি কয়েক বাদে সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন পর্যন্ত প্রায় একই রকম।
ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, হাসিনা ওয়াজেদ, আইভি রহমান, খালেদা জিয়া, রওশন এরশাদ- উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত প্রায় সবাই নিজেদের নামের মাথায় বরের নাম জুড়ে নামের শ্রীবৃদ্ধি করেন।
অনেকে অবশ্য বলেন একই নামের একাধিক ব্যক্তি হওয়ার কারণে তারা বরের নাম ব্যবহার করেন চেনার জন্য। কথা হলো একই নামের একাধিক ব্যক্তি কী শুধু মহিলাদের মধ্যেই হয় পুরুষের মধ্যে হয় না? তারা তো কেউ স্ত্রীর নাম ব্যবহার করেন না। পরিচিতির জন্য যদি বরের নাম লিখতে হয় কিংবা বলতে হয়, তা না হয় বললাম- কিন্তু নামের মাথায় টুপি পড়াতে হবে কেন?
একবার কোনো এক ফরমে স্থায়ী আর অস্থায়ী ঠিকানা লিখতে বলায়, আমি লিখেছিলাম-
অস্থায়ী ঠিকানা-
মাসুদা সুলতানা রুমী
w/o জনাব নূর মুহাম্মাদ (ইঞ্জিনিয়ার)
কলেজপাড়া। বদলগাছী। নওগাঁ
স্থায়ী ঠিকানা
মাসুদা সুলতানা রুমী
পিতা- মুহাম্মাদ ফখরুল ইসলাম মোল্লা
বারান্দি মোল্লাপাড়া। যশোর। (চলবে…)