হযরত আসমা ছিলেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর কন্যা। তার মাতা ফাতীলা ছিলেন কোরইশের প্রসিদ্ধ ও সন্মানিত সর্দার আবদুল উযযার কন্যা। আবদুল্লাহ ইবনে আবূ বকর ছিলেন তার আপন ভাই এবং হযরত আয়েশা ছিলেন তার সৎ বোন এবং বয়সে তার চেয়ে ছোট। তার লকব বা উপাধী ছিল যাতনুনেতাকাইন বা দুই-নেতাকওয়ালী। এ সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, মক্কার কাফেররা নবীজীকে সব রকম অত্যাচার-নির্যাতন এমন কি হত্যা করার জন্য উদ্যত হলে তিনি মক্কা ছেড়ে মদীনা হিজরত করার সংকল্প করেন। অবশেষে এক রাতে রাসূল (সা.) হযরত আবূ বকর (রা.) কে সঙ্গে নিয়ে মক্কা থেকে বেরিয়ে পড়েন এবং মক্কার অদূরে সাওর পর্বতের একটি গুহায় অবস্থান করেন। কাফেররা তাদের সন্ধানে চারিদিকে ছুটাছুটি করে, এমনকি সে গুহার মুখ পর্যন্ত বার বার হাযির হয়। কিন্তু যেহেতু নবুওয়াতের আলোকে দুনিয়াকে আলোকিত করা আল্লাহ্র ইচ্ছা ছিল, তাই কাফেররা তাঁর কাছে পৌঁছতে পারেনি। যারা গুহায় আটক অবস্থায় হযরতের সাহায্য সহযোগিতা করেন, হযরত আসমা ছিলেন তাদের একজন। তিনি রাত্রিতে তাঁদের জন্য খাবার নিয়ে যেতেন এবং রাত্রেই ফিরে আসতেন।
হযরত আসমার ভাই আবদুল্লাহ তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি সারাদিন কাফেরদের ইচ্ছা আর পরামর্শ সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতেন এবং রাত্রে নবীজীকে সব জানাতেন। হযরত আবূ বকর (রা.) এর মেষ পালক আগের রাতের বেলা মেষ নিয়ে গুহায় মুখে হাযির হতেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী দুধ দিয়ে ফিরে আসতেন। এমনিভাবে মেষের যাতাযাতের ফলে হযরত আসমা এবং তার ভাই আবদুল্লাহ পদচিহ্ন মুছে যেতো। এ কারণে কাফেররা গুহা খুঁজে বের করতে সক্ষম হতো না। নবীজীকে খুঁজে বের করার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হলে কাফেরা তার সন্ধানদাতাকে একশ উট পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। তৃতীয় রাতে হযরত আসমা খাবার নিয়ে গেলে নবীজী তাকে বলে, আলীকে বলবে তিনটি উট এবং রাস্তা সম্পর্কে ওয়াকেফহাল একজন লোক নিয়ে কাল রাতে গুহার সামনে উপস্থিত হতো। কথামতো হযরত আলী যথাসময়ে তিনটি উট এবং একজন রাহবর সঙ্গে নিয়ে হাযির হন। হযরত আসমাও দু’তিন দিনের খাবার নিয়ে হাযির হন। নাস্তা এবং পানির মশক বাঁধার জন্য রশি দরকার। কিন্তু এই মুহূর্তে হাতের কাছে কোন রশি নেই। হযরত আসমা নেতাক বা উড়না খুলে দু’টুকরো করে রশির কাজ সারেন। এক টুকরা দিয়ে নাস্তা আর অপর টুকরা দিয়ে মশকের মুখ বন্ধ করা হয় তখন দরবারে নবুওয়াত থেকে তাকে যাতুননেতাকাইন উপাধী দেওয়া হয়। চৌদ্দশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এ উপাধী তার নামের সাথে যুক্ত হয়ে আছে।
উল্লেখ্য যে, কামীজ-এর উপরে যে রুমাল বা উড়না পরিধান করা হয়, আরবে তাকে নেতাক বলা হতো। হিজরতের ২৭ বৎসর আগে মক্কা শরীফে তার জন্ম হয়। তখন তার পিতার বয়স ২০ বছরের কিছু বেশি। নবীজীর ফুফাতো ভাই হযরত যুবায়ের ইবনুল আওয়াম এর সাথে তার বিয়ে হয়। হযরত আসমা ছিলেন বড় উঁচু স্তরের মহিলা সাহাবী। মক্কায় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি নবীজীর হাতে বায়রাতের গৌরব অর্জন করেন। প্রথমে যারা ইসলাম গ্রহণ করেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। ১৭ জনের পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
রাসূল (সা.) এবং হযরত আবূ বকর (রা.) মদীনা মুনাওওয়ারা পৌঁছার পর নিশ্চয়তা ফিরে এলে মহিলাদেরকে নেওয়ার প্রস্তাব হয়। নবীজী যায়েদ ইবনে হারেসা এবং গোলাম আবূ রাফেকে মক্কায় প্রেরণ করেন। হযরত আবূ বকরও একজন লোক প্রেরণ করেন। তার পুত্র আবদুল্লাহ, মাতা এবং দুবোন হযরত আসমা ও হযরত আয়েশাকে নিয়ে মক্কা রওয়ানা হন। হযরত আসমা কোবা নামক স্থানে পৌঁছলে আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবায়ের এর জন্ম হয়। হযরত আসমা প্রিয় পুত্রকে নবীজীর খেদমতে নিয়ে যান তিনি নবজাতককে কোলে নিয়ে খেজুর চিবিয়ে তার মুখে দেন এবং তার জন্য দোয়া করেন। হিজরতের পর ইসলামে এ হচ্ছে প্রথম সন্তানের জন্ম। হযরত আসমার গর্ভে হযরত যুবায়ের এর পাঁচ পুত্র-আবদুল্লাহ্, ওরওয়া, মুনযের, আছেম ও মুহাজের এবং তিন কন্যা খাদীজা, উম্মুল হাসান, ও আয়েশা জন্ম গ্রহণ করেন। হযরত আসমা ছিলেন অত্যন্ত বিনয় ও ন¤্র স্বভাবের মহিলা। কষ্ট-ক্লেশ করতে তিনি কোন লজ্জা বোধ করতেন না। স্বামীর অভাব-অনটন, গৃহের দায়িত্ব পালন ইত্যাদি কাহিনী তিনি নিজেই বর্ণনা করেন ঃ
যুবায়ের ইবনুল আওয়াম এর সাথে আমার যখন বিয়ে হয়, তখন তার ধন-দৌলত, খাদেম নৌকর কিছুই ছিল না। তখন তিনি ছিলেন একেবারেই নিঃস্ব। কেবল একটা ঘোড়া আর একটা উট ছিল। আমিই এর দেখাশুনা করতাম। রাসূল (সাঃ) যুবায়েরকে এক খণ্ড খেজুর বাগান দান করেন। এ খেজুর বাগান ছিল মদীনার অদূরে। আমি প্রতিদিন সেখানে থেকে মাথায় করে খেজুরের বীচি ঘরে আনতাম, নিজে তা কুটে ঘোড়াকে খাওয়াতাম। বালতি দিয়ে পানি তুলতাম। ঘরের সমস্ত কাজ-কর্ম নিজ হাতে করতাম। যেহেতু আমি ভালো রুটি তৈয়ার করতে পারতাম না, তাই আমি শুধু আটা মলে রাখতাম। আমার ঘরের কাছেই থাকতেন আনসারের স্ত্রীরা। নিষ্ঠা-ভালোবাসায় এ স্ত্রীরা পরের কাজ করে আনন্দ পেতেন। তারা আমাকে রুটি তৈয়ার করে দিতেন। প্রতিদিন আমাকে এসব কষ্ট সইতে হতো। একদিন আমি খেজুর বাগান থেকে খেজুরের বীচি মাথায় করে নিয়ে আসছিলাম। পথিমধ্যে নবীজীর সাথে সাক্ষাৎ হয়। তার সাথে অন্যান্য সাহাবীরাও ছিলেন। তিনি আমাকে উটের পিঠে তুলে নেয়ার জন্য তার উট বসান। কিন্তু লজ্জা আমায় অনুমতি দেয়নি। তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে, লজ্জার কারণে আমি তার সাথে উটের পিঠে বসছি না, তখন তিনি চলে যান। আমি ঘরে ফিরে স্বামী যুবায়ের-এর নিকট এ কাহিনী বলি। তিনি বললেন, আল্লাহ্ জানেন, তোমার মাথায় করে খেঁজুরের বীচি বয়ে আনা তার সাথে বসার চেয়ে আমার কাছে কঠিন। কিছুদিন পর আমার পিতা হযরত আবূ বকর (রা.) আমার জন্য একজন খাদেম পাঠান। এর ফলে ঘোড়ার সেবা থেকে আমি মুক্তি পাই। বিপদ থেকে অনেকাংশে অব্যাহতি লাভ করি।
ইসলাম গ্রহণ কালে হযরত আবূ বকর (রাঃ) এর নিকট প্রায় ১ লক্ষ দিরহাম ছিল। কিন্তু দ্বীনের খাতিরে তিনি সব সম্পাদই নবীজীর সাহায্যে ব্যয় করেন। হিজরতের সময় তার কাছে দেড়-দু’হাজার দিরহামের বেশি ছিল না এ নিয়েই তিনি মক্কা থেকে মদীনা গমন করেন আর সন্তানদেরকে আল্লাহ্র হাতে ছেড়ে যান। হযরত আসমা পিতাকে বিদায় দিয়ে ঘরে ফিরে আসেন। হযরত আবূ বকর-এর পিতা আবূ কোহাফা তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি। বয়সের ভারে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। দৃষ্টি শক্তিও রহিত। পিতা আবূ কোহাফা ভোরে হযরত আসমার ঘরে আসেন এবং অতি দুঃখের সাঙ্গে বলেন, আবূ বকর নিজেও চলে গেছে, টাকা-কড়িও সব নিয়ে গেছে। হযরত আসমা তার মনকে সান্ত¡না দেওয়ার জন্য একটি থলিতে পাথর ভরে তাকের মধ্যে সে স্থানে রাখেন, যেখানে আবূ বকর টাকা-কড়ি রাখতেন। তিনি আবূ কোহাফাকে বলেন, দাদাজান! আব্বা তো আমাদের জন্য অনেক টাকা কড়ি রেখে গেছেন-এই বলে তিনি তাঁর হাত তাকের মধ্যে রাখেন। আবূ কোহাফা হাতড়িয়ে দেখে মনে করেন, সত্যিই বুঝি টাকা-কড়ি আছে। এমনি করে তার মনে সান্ত¡না আছে। হযরত আসমা বলেন, আমি কেবল তার সান্ত¡নার জন্য এমনটি করেছি। আসলে ঘরে একটা দানা কড়িও ছিল না। হযরত আসমার মাথা ব্যথা দেখা দিলে তিনি মাথায় হাত রেখে বলতেন, হে আল্লাহ! যদিও আমি অনেক গুনাহগার, কিন্তু তুমি তার চেয়েও বড় ক্ষমাশীল। একবার তার ঘাড়ে ব্যথা দেখা দেয়। নবীজী ব্যথার স্থানে হাত রেখে বলেন, আল্লাহ তোমার এ কষ্ট দূর করুন। দুঃখ দৈন্যের কারণে হযরত আসমা পারিবারিক ব্যাপারে অত্যন্ত হিসেব করে চলতেন। সব কিছুই প্রয়োজন অনুপাতে মেপে-ঝেঁপে ব্যয় করতেন। নবীজী তাকে নিষেধ করে বলেন, মেপে-ঝেঁপে ব্যয় করবে না। এমনটি করলে আল্লাহ ও তোমাকে তাই দেবেন। নবীজীর কথায় তিনি এ অভ্যাস ত্যাগ করেন। হযরত আসমা ছিলেন পাকা ঈমানের মুসলিম মহিলা। এ কারণে মুশরেকরা ছিল তার কঠোর শত্রু। একবার তার মাতা কিছু হাদিয়া-তোহফা নিয়ে তাকে দেখতে আসেন। যেহেতু তখনও তিনি ছিলেন মুশরেক, তাই তিনি মাতার হাদিয়া গ্রহণ করেননি, তাকে ঘরে উঠতেও দেননি। হযরত আয়েশার কাছে খবর পাঠান যে, আপনি নবীজীকে জিজ্ঞেস করে নিন, এ ক্ষেত্রে আমি কি করবো আর তার হুকুম কি? নবীজী জানান যে, হাদিয়া গ্রহণ কর এবং তাকে ঘরে মেহমান হিসেবে থাকতে দাও। আল্লাহ্র নির্দেশও তাই। কালামুল্লাহয় বলা হয়েছে: যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেনি আর তোমাদের গৃহ থেকে বিতাড়িতও করেনি, তাদের সাথে সদাচারণ এবং ইনসাফের আচরণ করতে আল্লাহ্ বারণ করেন না, কারণ যারা ইনসাফের আচরণ করে, আল্লাহ্ তাদেরকে ভালোবাসেন। আল্লাহতো তোমাদেরকে বারণ করেন এমন লোকদের সাথে বন্ধুত্ব রাখতে, যারা দ্বীেেনর ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে এবং তোমাদেরকে গৃহ থেকে বিতাড়িত করেছে এবং তোমাদেরকে বিতাড়িত করার ব্যাপারে সাহায্য করেছে। আর যারা এদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তারাই যালেম। (সূরা মুমতাহিনা: ৮-৯)
এরপর তিনি হাদিয়া গ্রহণ করেন এবং মাতাকে আপন গৃহে অবস্থানের অনুমতি দেন। পরবর্তীকালে অনেক ধন-সম্পদের মালিক হলেও ইসলামের সরল ও অনাড়ম্বর জীবন-যাপনের ধারা তিনি ত্যাগ করেননি। তিনি সব সময় মোটা কাপড় পরতেন, শুকনা রুটি খেতেন, ফকীরের ন্যায় জীবন যাপন করতেন। তার সরল-অনাড়ম্ব জীবন যাপনের প্রমাণ হিসেবে একটা ঘটনা উল্লেখ করা যায়।
তার পুত্র মুনযের ইরাক যুদ্ধে বিজয় লাভ করে গৃহে ফেরার সময় নারীদের জন্য নক্সা করা কিছু চিকন কাপড়’ নিয়ে আসেন। কাপড় নিয়ে মায়ের খেদমতে হাযির হন। মা তখন বার্ধক্যের কারণে দৃষ্টি শক্তি হারা। তিনি হাত দিয়ে স্পর্শ করে কাপড় সম্পর্কে জানতে পেরে রাগান্বিত হন। এ মিহিন কাপড় পরতে তিনি অস্বীকার করেন। পুত্র মুনযের পরে মোটা কাপড় এনে দিলে খুশি হয়ে তা গ্রহণ করেন এবং বলেন, পুত্র ! আমাকে এমন কাপড় পরাবে।
উদারতা-দানশীলতা
তার মধ্যে উদারতা-দানশীলতা ছিল অনেক বেশি। ছেলেদেরকে সর্বদা উপদেশ দিয়ে বলতেন, অন্যের কল্যাণ বিধান, তাদের সাহায্যের জন্যই তোমাদের টাকা-কড়ি, ধন-দৌলত, জমা করে রাখার জন্য নয়। তোমরা যদি টাকা-পয়সা আল্লাহ্র সৃষ্টিকুলের জন্য ব্যয় না করে কার্পণ্য কর, তবে আল্লাহ্ও তোমাদেরকে তার দান-অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত করবেন। তোমরা যা কিছু ইচ্ছা করবে বা ব্যয় করবে, আসলে তা-ই হবে তোমাদের জন্য উত্তম সম্বল। এ এমন এক সঞ্চয়, যা কখনো কমবে না, তা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও নেই। তিনি কোন সময় অসুখে পড়লে দাস-দাসীকে মুক্ত করে দিতেন। হযরত আয়েশা ইন্তিকালের সময় একখণ্ড ভূমি রেখে যান, তা হযরত আসমার ভাগে পড়ে। তিনি তা এক লক্ষ দিরহামে বিক্রি করে সবই আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। হযরত যুবায়ের-এর মেজায ছিল খুব কড়া। তাই তিনি নবীজীকে জিজ্ঞেস করে নেন যে, স্বামীর অনুমতি না নিয়ে আমি তার মাল ফকীর-মিসকীনকে দিতে পারি কি-না? নবীজী বললেন, হ্যাঁ , দিতে পার। একবার তার মাতা মদীনা মুনাওয়ারা এসে তার কাছে কিছু টাকা দিতে বলেন। তিনি নবীজীকে জিজ্ঞেস করেন, আমার মাতা মুশরেকা। তিনি আমার কাছে টাকা চান। এমতাবস্থায় আমি তাকে সাহায্য করতে পারি কি? নবীজী বললেন, হ্যাঁ, তিনিতো তোমার মা। অর্থাৎ তুমি তার সাহায্য করতে পার।
সাহস ও চরিত্র
হযরত আসমা ছিলেন সুন্দর চরিত্রের মূর্ত প্রতীক। নিষ্ঠা-আন্তরিকতা ছিল তার স্বভাব ধর্ম। আপনজদের কল্যাণ চিন্তায় তিনি সদা মগ্ন থাকতেন। একবার হযরত (সা.) সূর্য গ্রহণের নামায পড়াচ্ছিলেন। তিনি নামায অনেক দীর্ঘায়িত করেন। হযরত আসমা ঘাবড়ে যান। তিনি ক্লান্ত হয়ে এদিক-ওদিক দেখেন। তার পাশে আরও দু’জন মহিলা ছিলেন। একজন মোটা-সোটা, অপরজন হেংলা-পাতলা ও দুর্বল। এরা দাঁড়িয়ে আছে দেখে তিনি সাহস পান। তিনি মত পরিবর্তন করে বলেন, আমারতো এদের চেয়ে বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকা উচিৎ। নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। নামায কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়। শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। বেহুঁশ হয়ে গেলে মাথায় পানি দিতে হয়।
গুণ-বৈশিষ্ট্য
অনেকেই হযরত আসমার ভক্ত ছিলেন এবং একান্ত ভক্তি সহকারে তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে আসতেন। তাঁর পবিত্রতা ও মহত্বের ব্যাপক খ্যাতি ছিল। অনেকেই তাঁর কাছে দোয়ার জন্য আসতেন। বিপদের সময় খাছভাবে দোয়ার জন্য আসতেন। কোন নারীর জ্বর হলেও তার কাছে দোয়ার জন্য আসতো। তিনি মহিলার বুকে পানি ছিটিয়ে দিয়ে বলতেন, নবীজী বলেছেন, জ্বর হচ্ছে জাহান্নামের আগুনের তাপ। পানি দিয়ে তা ঠাণ্ডা করবে। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে তিনি নবীজীর জুব্বা-যা হযরত আয়েশা ইন্তিকালের সময় হযরত আসমাকে দিয়ে যান-ধুয়ে পানি পান করাতেন। তিনি কয়েকবার হজ্ব করেন। প্রথমবার নবীজীর সঙ্গে হজ্ব করেন নবীজী থেকে তিনি প্রায় ৫৬টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। এসব হাদীস বুখারী-মুসলিমে সন্নিবিষ্ট হয়েছে। যে সব রাবী তার কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলো,
আবদুল্লাহ, ওরওয়া, ফাতিমা ইবনেতে মুনযের, ইবনে যুবায়ের, ইবনে আব্বাস, ইবনে আবী মুলাইকা, ওয়াহাব ইবনে কায়সান, মুসলিম মুয়াররি প্রমুখ। তিনি ছিলেন সূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারীণী। তার বিশ্বাস ছিল দৃঢ়, অন্তর ছিল বলিষ্ট, ধৈর্য ছিল অটুট আর ছবর ছিল অঢেল।
তালাক
হযরত যুবায়ের কর্তৃক হযরত আসমাকে তালাক দেয়ার ব্যাপারটি সব গ্রন্থকারই সংক্ষেপে আলোচনা করেছেন। তালাকের কারণ কেউই উল্লেখ করেননি। ইবনুল আসীর বলেন, তালাকের দুটি কারণ ছিল। এক হযরত আসমা খুব বয়স্কা ছিলেন, বয়সের কারণে তিনি দৃষ্টি শক্তিও হারান। এ কারণে হযরত যুবায়ের তাকে বিচ্ছিন্ন করতে বাধ্য হন। দুই, উভয়ের সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টি হওয়ার ফলে তালাক হয়েছে। আমাদের মতে প্রথম কারণটি গ্রহণযোগ্য নয় এজন্য যে, তখন পর্যন্ত ইসলামের নৈতিক শিক্ষার ভিত এতটা দুর্বল হয়নি যে, হযরত যুবায়ের-এর মতো একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এ অপরাধে স্ত্রীকে তালাক দেবেন যে, সে বৃদ্ধা হয়ে গেছে। অন্য কারণ আছে বিধায় আন্দাজ-অনুমানও এটা মেনে নিতে অক্ষম। অবশ্য দ্বিতীয় কারণটি বুঝে ধরে এবং এটা হওয়া সম্ভবও। কারণ, হযরত যুবায়ের এর মেযাজ ছিল কঠোর এবং তিনি বাড়াবাড়ি করতেন এটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। পারস্পরিক বিরোধের ফলে তিক্ততা দেখা দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত যা তালাকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রেওয়ায়াতে এবং দেরয়াত উভয় অবস্থায়ই প্রথম কারণেই তুলনায় দ্বিতীয় কারণ অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হয়। উপরন্তু ইবনুল আসীর-এর আর একটি বর্ণনা থেকেও আমাদের মতের সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলেন, একবার কোন এক ব্যাপারে হযরত যুবায়ের হযরত আসমার উপর ক্রুদ্ধ হন। এমনকি মারপিট পর্যন্ত গড়ায়। হযরত আসমা পুত্র আবদুল্লাহ্র সাহায্য চান হযরত যুবায়ের পুত্র আবদুল্লাহকে আসতে দেখে বলেন, তুমি এখানে এলে তোমার মাকে তালাক দেব। হযরত আব্দুল্লাহ্ বলেন, আপনি আমার মাকে কসমের লক্ষ্যবন্তু করেছেন। এই বলে তিনি যান এবং পিতার হাত থেকে মাতাকে উদ্ধার করেন। যাই হোক, তালাকের পর তিনি পুত্র আবদুল্লাহ্র কাছে চলে আসেন এবং সেখানেই থাকেন। আবদুল্লাহ্র মতো অনুগত পুত্র পাওয়াও কষ্টকর। তিনি বৃদ্ধা মাতার আনুগত্য করতেন এবং তার সন্তুষ্টিকে সমস্ত লক্ষ্যের চাবিকাঠি মনে করতেন। চলবে…