Main Menu

আসসালামু আলাইকুম

আসসালামু আলা্কুম

আসসালামু আলা্কুম

পূর্বে প্রকাশিতের পর

সালাম আদর্শ ব্যক্তিত্ব ও সুন্দর সমাজ গঠনের হাতিয়ার:
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সামাজিক বন্ধন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। তাই প্রয়োজন সামাজিক রীতিনীতি জানা। একে অপরের সম্ভাষণ ও অভিবাদন কিভাবে করতে হবে তা মানব জাতিকে শিখিয়েছে ইসলাম; যার ভাষা আকর্ষণীয়-যার পদ্ধতি হৃদয়ে সাড়া জাগানোর মত। ইসলামের এই চমৎকার অভিবাদন পদ্ধতি অপরিচিত মানুষের সাথে সম্পর্ক জুড়েদেয়। পরিচিত ব্যক্তিকে আরো নিকটবর্তী করে দেয়। নিকটবর্তী ব্যক্তিকে আরো প্রিয় মানুষে পরিণত করে। শুধু তাই নয়, সালাম পরস্পরের মাঝে মনোমালিন্য দূর করে সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরী করতঃ শত্রুতার পরিবর্তে বন্ধুত্বের পরিবেশ সৃষ্টি করে। সামাজিকভাবে মানুষকে ভালবাসা ও আন্তরিকতায় এমন মালায় ফুলের মত গেঁথে নেয়, যার মাধ্যমে সমাজের মানুষগুলো একে অপরের নিকট থেকে ভালবাসার সৌরভ খুঁজে পায়। অনুভব করে সুন্দর সম্পর্কের হিমেল বাতাস। যে বাতাসে শত্রুতার গন্ধ নেই, আছে বন্ধুত্বের আবে-হায়াত। হিংসার লেশ নেই, আছে পরোপকারের ভিত। ক্ষতির আশঙ্কা নেই, আছে সমূহ কল্যাণ। অহংকারের ভাব নেই, আছে বিনয়ের সমারোহ। সমাজের মানুষের কথোপকথনের ইারে ভেসে আসা শব্দগুলোতে গীবত-পরনিন্দা ও পরচর্চার কথা নেই, আছে ভালবাসার কথা, আন্তরিকতার কথা। মনে কষ্ট দেওয়ার কথা নেই, আছে মন জুড়ানোর কথা। মনে আঘাত দেওয়ার কথা নেই, আছে মনে আনন্দ দেওয়ার কথা। অজানা আশঙ্কার কথা নেই, আছে নিরাপত্তার কথা। ইসলামের অভিবাদন পদ্ধতি কেবল বাহ্যিকভাবেই নয়, বরং আত্মিক ও আভ্যন্তরীণ দিক থেকেও সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও সুন্দর সমাজ গঠনে কার্জকর ভূমিকা পালন করে। কি সেই অভিবাদন? তা হচ্ছে, ‘আস্সালামু আলাইকুম’। অর্থাৎ আপনার উপর শান্তি ও রহমাত বর্ষিত হোক। এই হচ্ছে ইসলামের অভিবাদন নামক সেই জিয়ন কাঠি, যা দিয়ে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ সুন্দর হতে পারে, শান্তি পেতে পারে। সমাজের সকল ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব কত খানি তা নিয়ে আমরা আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশা আল্লাহ।
সালামের সংজ্ঞাঃ
সালামুন শব্দটি তাসলীমুন শব্দ থেকে উৎপত্তি। যার অর্থ- নিজেকে দোষ-ত্রুটি মুক্ত রাখা। এটা আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নামসমূহের একটি। কেননা আল্লাহ তাআলা যাবতীয় দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্র। কোন ব্যক্তিকে ‘আস্সালামু আলাইকুম’ অভিবাদন জানানোর অর্থ হলো, আল্লাহ তোমার সকল অবস্থা সম্পর্কে অবগত। সুতরাং তুমি অমনোযোগী হবেনা; অথবা এর অর্থ হবে, আল্লাহ তোমাকে হিফাজাত করুন, সংরক্ষণ করুন।
অধিকাংশ ওলামায়ে কিরামের মতে, সালাম শব্দের শাব্দিক অর্থ-শান্তি ও নিরাপত্তা। তাই ‘আস্সালামু আলাইকুম’ এর অর্থ হলো, আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আমার পক্ষ থেকে আপনার নিরাপত্তা দেওয়া হলো। আপনিও আমাকে নিরাপত্তা দিন। আর ইসলামী শারিয়াতের পরিভাষায় একজন মুসলমান আর একজন মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের সময় যে বাক্য দ্বারা একে অপরের ভালবাসা, বন্ধুত্ব, শান্তি, নিরাপত্তা, কল্যাণ ও দু’আ কামনা করে তারই নাম সালাম তথা ‘আস্সালামু আলাইকুম’।
সালাম প্রচলনের ইতিকথাঃ
মানব সভ্যতার শুরু থেকেই একে অপরের সাথে দেখা-সাক্ষাতের সময় পরস্পরের ভাব বিনিময়ের ও সাদর সম্ভাষণের বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন জাতি নিজেদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, আদর্শ ও রুচি অনুযায়ী বিভিন্ন শব্দ ও বাক্য বেছে নিয়েছে। যেমন, ভারতীয় উপমাহদেশে হিন্দু সম্প্রদায় পরস্পরের দেখা-সাক্ষাতে আদাব, নমস্কার, নমঃ নমঃ ইত্যাদি বলে আসছে। পশ্চিমা দেশ ইউরোপ ও আমেরিকায় খ্রিস্টান সম্প্রদায় গুড মর্নিং, (Good morning) গুড আফটার নুন, (Good afternoon) গুড ইভিনিং, (Good evening) এবং গুড নাইট ( Good night)
বলে একে অপরকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে থাকে। এ ছাড়াও গুড বাই, (Good bye) টাটা, (ta ta) হাই (hi) শব্দেরও প্রচলন দেখা যায়।
প্রাক ইসলামী যুগে আরব সমাজের মধ্যে ‘আনআমাল্লাহু বিকা আইনান’ আপনার বদৌলতে আল্লাহ আপনার প্রিয়জনদের চক্ষু শীতল করুক। এবং ‘আয়েম সাবহান’ আপনার প্রত্যুষ সমৃদ্ধ হোক, অর্থাৎ সুপ্রভাব ইত্যাদি শব্দ প্রচলন ছিল। ইসলামের আর্ভিবাবের পর বিশ্বনবী (সা.) প্রাক ইসলামী যুগের ব্যবহৃত শব্দগুলো পরিহার করে পরস্পরকে ‘আস্সালামু আলাইকুম’ বলে অভিবাদন করতে নির্দেশ দিলেন, যা সকল সময়, সব বয়স ও স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সব খানে প্রযোজ্য; যা সার্বজনীন অভিবাদন পদ্ধতি তার নামই সালাম তথা ‘আস্সালামু আলাইকুম’। ‘হযরত ইমরান ইবনে হোসাইন হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা জাহিলিয়াতের যুগে একে অপরকে ‘আনআমাল্লাহু বিকা আইনান’ (আল্লাহ আপনার বদৌলতে আপনার প্রিয়জনদের চক্ষু শীতল করুন)। এবং ‘আয়েম সাবহান’ (আপনার প্রত্যুষ কল্যাণময় হোক), বলে সম্ভাষণ জানাতাম। ইসলামের আবির্ভাবের পর আমাদেরকে এ জাতীয় শব্দ দ্বারা অভিবাদন জানাতে নিষেধ করা হয়। (আবু দাউদ; মেশকাত-৪৪২৯/২৮)
সালামের প্রকারভেদঃ
কুরআন হাদীসের আলোকে সালাম কয়েক প্রকারে হতে পারে। যেমন:
(১) অনুমতির জন্যে সালাম: যে কোন অনুষ্ঠানে, কারো ঘরে, কামরায়, অফিসে, অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করা ভদ্রতা ও সৌজন্যের পরিচায়ক। এমনকি নিজের ঘরে আপন স্ত্রীর ঘরে প্রবেশ করতেও অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করার মধ্যে অনেক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে অনুমতি সূচক সালাম দিতে ইসলামের বিধান রয়েছে। এতে অনেক উপকার ও নিগূঢ় তত্ত্ব নিহিত রয়েছে। এ ব্যাপারে কুরআন বলছে: হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের ঘর ছাড়া অন্য কারো ঘরে প্রবেশ করোনা, যতক্ষণ পর্যন্তনা ঐ ঘরের অধিবাসীদের অনুমতি গ্রহণ করবে এবং তাদের সালাম করবে। এটিই তোমাদের জন্য উত্তম পদ্ধতি। এ সব বলা হলো যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো। (সূরা নূর: ২৭) হাদীসে বর্নীত হয়েছে:
* রাসূল (সা:) এরশাদ করেছেন: হে বৎস (আনাস রা.)! যখন তুমি ঘরের ভেতর প্রবেশ করবে তখন সালাম করবে। এতে তোমার ও তোমার পরিবারের সকলের জন্য বরকত নিহিত রয়েছে। (তিরমিযী, মেশকাত-৪৪২৭/২৬)
* তোমাদের মধ্য থেকে কেউ কোন মজলিসে উপস্থিত হলে, সে যেন অবশ্যই সালাম করে। (আনাস (রা): আবু হুরায়রা (রা); মেশকাত-৪৪৩৫/৩৪)
(২) সাক্ষাতের সময় প্রীতি সম্ভাষণে সালাম: একজন মুসলমানের সাথে আর একজন মুসলিম ভাইয়ের সাক্ষাৎ হলে, প্রথমেই তাকে সালাম দেওয়ার মাধ্যমে অভিবাদন ও সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে গ্রহণ করে নিবে, এটাই ইসলামের বিধান। এতে করে পরস্পরের মাঝে বন্ধুত্ব ভালবাসা সৃষ্টি হয়। ইসলাম এর উপর এতখানি গুরুত্ব আরো করেছে যে, কারো সাথে একবার সাক্ষাতের পর কোন বৃক্ষ, প্রাচীর কিংবা পাথরের আড়ালে চলে গেলে যদি পুনরায় সাক্ষাৎ হয় তাহলে আবারও তাকে সালাম দেওয়ার ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। * যখন তোমাদের কেউ কোন মুসলমান ভাইয়ের সম্মুখীন হবে; তখন সে যেন তাকে সালাম করে। এর পর তাদের মাঝে বৃক্ষ, প্রাচীর কিংবা পাথরের আড়াল পড়ে যাওয়ার পর পুনরায় সাক্ষাৎ হয় তখনও যেন আবার সালাম দেয়। (আবু হুরায়রা (রা): আবু দাউদ, মেশকাত-৪৪২৫/২৪) * কথোপকথনের আগেই সালাম করো। (আনাস (রা): আবু দাউদ; মেশকাত-৪৪২৮/২৭)
(৩) বিদায়ী সালামঃ কোন মুসলমান ভাইয়ের বিদায় বেলায় মন উজার করা প্রীতি, ভালবাসা ও দু’আ নিয়ে বিদায় জানানোর এক অপূর্ব রীনিনীতি শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। সাক্ষাতকালে সালাম দেওয়া যেমন জরুরী তেমনি বিদায় বেলায় সালাম দেওয়াও জরুরী। * রাসূল (সা:) বলেছেন; তোমাদের কেউ যখন কোন মজলিসে প্রবেশ করে সে যেন সালাম করে। যদি বসার প্রয়োজন হয় বসে পড়বে। আর যখন চলে যাবার উদ্দেশ্যে দাঁড়াবে, তখন যেন (দ্বিতীয়বার ) সালাম করে। কেননা প্রথম বারের সালাম দ্বিতীয়বারের সালামের চেয়ে উত্তম নয়। অর্থাৎ’ উভয় সালামই সুন্নত এবং সমান গুরুত্বের দাবীদার। (আবু হুরায়রা (রা): তিরমিযী, আবু দাউদ, মেশকাত-৪৪৩৫/৩৪)
(৪) বাহকের মাধ্যমে সালামঃ সালামের অপর নাম শান্তির বাহক। বাহক ও প্রেরক মারফত আমরা অনেক সময় খোঁজ-খবর নিয়ে থাকি, লেন-দেন আদান প্রদান করে থাকি। দৈহিক দিক থেকে দূরে থাকলেও মনের দিক থেকে যেন একজন মুসলমান অপর জনের নিকট থেকে দূরে না থাকে সে জন্য অত্যন্ত যতœসহকারে আবহমানকাল ধরে অপরের কল্যাণ কামনায় বাহকের মাধমে সালাম দেওয়ার সিষ্টেম লালন করে আসছে ইসলাম। হাদীসে রাসূলে (সা:) অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। * হযরত গালিব (রা) বলেন, একদা আমরা হযরত হাসান বসরী (রা) এর দরজায় বসেছিলাম। এমন সময় একজন লোক এসে বললেন, আমার পিতা আমার দাদা হতে বর্ণনা করেন, একদিন আমার পিতা আমাকে (ঐ লোকটির দাদাকে) রাসূলে কারীম (সা.) এর নিকট পাঠালেন এবং বললেন, ওনাকে আমার সালাম জানাবে। আমার দাদা বলেন, আমি রাসূল (সা.) এর খেদমতে এসে বললাম, আমার পিতা আপনাকে সালাম জানিয়েছেন। তখন তিনি বললেন, “ওয়াআ’লাইকা ওয়াআলা’ইহিস্সালাম” তোমার উপর এবং তোমার পিতার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। (আবু দাউদ, মেশকাত-৪৪৩০/২৯)
(৫) চিঠি-পত্রের মাধ্যমে সালামঃ চিঠি-পত্রের মাধ্যমে কুশলাদি বিনিময় ও প্রয়োজনীয় খবরাখবর প্রেরণ করার এই রীতি অতি প্রাচীন। দূরে ও প্রবাসে থাকার কারণে পরিবার-পরিজন, মাতা-পিতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, ও বন্ধু-বান্ধবদের খোঁজ-খবর নেওয়ার প্রক্রিয়া চিঠি-পত্রের মাধ্যমেই সম্পাদন করতে হয়। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনেও চিঠি-পত্র লিখতে হয়। দাওয়াতী কাজেও চিঠি পত্রের ব্যবহার অনেক পুরনো। ইসলাম যেহেতো পারস্পরিক কল্যাণ কামনা করার নাম, সে হেতো চিঠি-পত্র লিখার মাধ্যমেও যাতে একে অন্যের কল্যাণ কামনরা করতে পারে, ইসলাম সেই বিধান প্রবর্তন করেছে নবী (সা.) এর যুগ থেকেই। নবী কারীম (সা.) রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নিকট ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত সম্বলিত চিঠিতে সালাম দিয়েছিলেন- “সালামুন আ’লা মানিত্তাবায়াল হুদা” যে ব্যক্তি হেদায়েতের অনুসরণ করবে তার প্রতি সালাম-শান্তি বর্ষিত হোক। * হযরত মুয়াবিয়া (রা.) একবার উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রা.)-এর নিকট কিছু উপদেশ কামনা করলেন, তবে তা যেন দীর্ঘ না সে জন্যেও অনুরোধ করলেন। হযরত আয়েশা (রা) উপদেশ নামা লিখে পাঠালেন: “আপনাকে সালাম। অতপর উপদেশ এই যে, আমি রাসূলে কারীম (সা.) কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি মানুষকে ক্রুদ্ধ করেও আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে, মানুষের দেওয়া দুঃখ কষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহই তার পক্ষে যথেষ্ট হয়ে যান। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ক্রুদ্ধ করে মানুষের সন্তুষ্টি কামনা করে, আল্লাহ্ তাকে মানুষের দায়িত্বে ছেড়ে দেন। আপনাকে আবারও সালাম। (তিরমিযী)
এ ছাড়া টেলিফোনে আলাপ কালে, fax, e-mail, face book, Viber- imo-সহ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও সালামের আদান-প্রদান করা যেতে পারে। (চলবে…)

Related Post