Main Menu

আসসালামু আলাইকুম

আসসালামু আলাইকুম

আসসালামু আলাইকুম

পূর্বে প্রকাশিতের পর

সালামের গুরুত্ব, তাৎপর্য, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করার পর সালামের বহুমুখী ব্যবহারের উপর সামান্য আলোচনা করতে চাই। প্রথমে আমার প্রশ্ন আমার কাছে এবং পাঠকের কাছে- সালামের বহুমুখী যে ব্যবহার হচ্ছে তা-কি সঠিক হচ্ছে? বহুমুখী ব্যবহারের নমুনা:
১) মুদি দোকানদার তার দোকানের এক কর্মচারীকে দিয়ে মহল্লার এক বাসার গৃহকর্তার নিকট সালাম পাঠায়।
২) এক ভদ্রলোক তার পড়শিকে নিজের ছেলেকে পাঠায়ে সালাম জানালেন।
৩) দু’জনের মধ্যে কোন এক ব্যাপারে প্রচন্ড বিতর্ক চলছে, বিতর্কের শেষ পর্যায়ে একজন অপরজনকে বললেন, খুব হয়েছে ভাই, এবার সালাম।
৪) মাওলানা ভাসানী পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানিয়ে ছিলেন।
৫) আপনি একটা দোকান নিবেন ভাড়ায়, আপনাকে বড় অংকের একটা সেলামী দিতে হবে মালিককে। সেলামী না দিলে দোকান নিতে পারবেন না।
৬) ঈদের দিন শিশুরা চেনা ও পরিচিত বাসায় যায়, মুরব্বিদের সালাম করে, তারা সেলামী পায়। কে কত পেল তা হিসাব করেও দেখে।
৭) থানা পুলিশকে ঘুষ দেওয়ার নাম আগে ছিল ‘সেলামী দেওয়া’ এখন আর তা বলা হয়না, বলা হয় থানা পুলিশ খরচা।
৮) পীরের দরবারে মুরিদ-ভক্তরা যান সালাম ও নজর নেওয়াজ দিতে।
৯) কোন কোন রোগী তাওবা করে এই পৃথিবীকে আখেরী সালাম জানায়।
১০) অফিসে এসে বড় সাহেবকে সালাম দেওয়ার অভ্যেস আছে অনেকের। কোন না কোন ওছিলায় তারা দেখা করবেনই এবং একটা সালাম দেবেনই।
১১) অফিসারের অফিস হেল্পার (অফিস বয়) কে কোন একজন ভিক্ষুক এসে বলছে- সম্ভব হলে তোমার সাহেবকে আমার সালামটা বল।
আরো অনেক প্রকার সালাম আছে, যাদের প্রত্যেকটির ব্যবহারিক অর্থ আলাদা অর্থাৎ একটির সঙ্গে অন্যটির অর্থের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে আমি যে এগারটি সালামের উল্লেখ করলাম, এই এগারটি সালামের এগারটি অর্থ।
আল্লাহ পাক যে সালাম আদম (আ.) কে শিখিয়েছিলেন এবং আদম (আ.) থেকে যে সালামের সিলসিলা যে অর্থে এখন পর্যন্ত চলছে এবং রোজ কিয়ামতের আগ পর্যন্ত তা চলবে আর আল্লাহর হাবিব আমাদের প্রিয় নবী (সা.) যে সালামের প্রতিষ্ঠা করে একে দোয়া, সম্ভাষণ, সংস্কৃতি হিসেবে চালু করে দিয়েছেন, সেই সালামের ভাব-ব্যঞ্জনার স্পিরিট-এর অণু কনাও এই এগারটি সালামে আছে? সাফ কথা এর, একটিতেও নেই। যদি তা আমরা স্বীকার করেই থাকি, তা হলে বলতে হবে ইসলামে সালামের অপব্যবহার মুসলমানরাই করছে, এর অপব্যবহার অমুসলিমরা করছে না। আমি মনে করি যে সালামে দোয়া নেই সে সালাম কিন্তু সালাম নয়। যেভাবে এবং যে হারে সালাম নিতান্ত বৈষয়িক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, অপব্যবহার হচ্ছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে বিকৃত করে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে আমার আশঙ্কা হয়, ভেস্ত, হদিস, রেহমান ওসব শব্দের মত সালাম ইসলাম বিদ্বেষীদের অভিধানে ব্যাপকভাবে স্থান পায় কি না! এখনই কলিকাতার ‘সংসদ বাঙ্গলা অভিধানে সালামকে বিকৃত করে ফেলেছে। তারা সালাম-এর শুদ্ধ বাংলা লিখেছে ‘সেলাম’। সালাম-এর বানান ব্যাখ্যায় লিখেছে ‘সালাম হচ্ছে সেলাম-এর রুপভেদ’। তাদের মতে ‘আসসালামু আলাইকুম’-এর শুদ্ধ বানান হচ্ছে ‘সেলাম আলায়কুম’ যার অর্থ লেখা হয়েছে ‘নমস্কার’। অর্থাৎ বিকৃতই প্রকৃত হয়ে যাচ্ছে। গলধ মশহুর হয়ে যাচ্ছে। সবে মাত্র শুরু, আগামীতে এই ‘সালাম’ আরও কত বিকৃত হয় তা দেখার অপেক্ষায় কি আমাদের থাকতে হবে? এজন্য কি আমরা দায়ী নই? বিকৃত আর অপব্যবহার যে আমরাই করছি, তাতে কি কোন সন্দেহ আছে? অপব্যহারের কথা কিছুটা আলোচনা করেছি আগে, এখন আরো কিছু আলোচনার পর বিকৃতির আলোচনা করব।
আসুন, উল্লেখিত এগার প্রকার সালাম-এর মর্মার্থ জানার চেষ্টা করি।
মুদি দোকানদার সালাম পাঠিয়েছে এক বাসার কর্তার কাছে পাওনা তাগাদা দেওয়ার জন্যে। এ সালাম পাওনা তাগাদার সালাম। ইসলামের সালাম নয়।
এক পড়শি অপর পড়শির কাছে সালাম পাঠিয়েছেন টাকা হাওলাতের জন্য। আগেই কথা বার্তা হয়েছে। ছেলেকে দিয়ে মুদি দোকানদার তার দোকানের এক কর্মচারীকে দিয়ে মহল্লার এক বাসার গৃহকর্তার নিকট সালাম পাঠায়। সালাম পাঠানো মানে স্বরণ করিয়ে দেওয়া মাত্র। সালাম পেয়েই তিনি পড়শির ছেলের হাতে কিছু টাকা তুলে দিলেন।
মাওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ দিয়েছিলেন। তাতে ছিল সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা। তা কখনো সুন্নত সালাম ছিলনা।
দোকান ভাড়া নিতে বা দোকানের পজিশন নিতে যে সালামী, তা হতে পারে আগাম ভাড়ার এ্যডভান্স বা দোকান পজিশন নেওয়ার অফেরতযোগ্য নজরানা বিশেষ, যাতে দোকানের মূল মালিকের ভোগের এক চেটিয়া অধিকার রয়েছে। এ সালামী সুন্নত সালামের ধারে কাছেও নেই।
ঈদের দিনে শিশুরা সালাম দিয়ে সালামী কুড়াতে আসে। এর মানে টাকা কুড়াতে আসে। মূল উদ্দেশ্য সালাম দিতে আসা নয়। একে আমি বিনোদনী আদুরে ভিক্ষা বলি। থানা পুলিশকে কেউ সালাম দিতে যায় না। ‘সালামী দেওয়া’ মানে ঘুষ দেওয়া। এই ঘুষের নাম যাই দেওয়া হোক বা যে নামই রাখা হোক। পীরের দরবারে সালাম দিতে আসা, সাথে নিয়ে আসা নজর নেওয়াজ, এই সালাম আর নজর নেওয়াজের সঙ্গে ইসলামের কতটুকু সম্পর্ক আছে তা বিশেষজ্ঞরাই জানেন। তবে সাধারণভাবে বুঝা যায় এই সালাম আর নজর নেওয়াজ পীরকে খুশী করার আর এসবের মাধ্যমে মুরীদদের মতলব হাসিলের প্রচ্ছন্ন কামনা থাকে।
তাওবা করে পৃথিবীকে আখেরী সালাম জানানো মানে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি। এই সালামও ইসলামের সালাম নয়। পৃথিবীকে সালাম জানানোর কোন বিধান ইসলামে নেই। অফিসে বড় সাহেবকে সালাম দেওয়া মানে বড় সাহেবের নজরে আসা, আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শণ করা। অফিস হেল্পার এর মাধ্যমে-সাহেবকে আমার সালামটা বল মানে ভিক্ষা চাওয়া। লক্ষ্যনীয় যে সালামের এত ছড়াছড়ি, কিন্তু আসল সালামের খবর নেই। ইসলামের এই ‘সালাম’ নিয়ে এসব অপব্যবহার মেনে নেয়া যায় না, তবুও যেন এসব অপব্যবহার আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। আমরা এ অপব্যবহারকে মেনে নিয়েছি। এর বহুমুখী ব্যবহার সর্বদা যে অপব্যবহারের ভাইরাস জন্ম দিচ্ছে, সে দিকে আমাদের কোন খেয়ালই নেই।
অপব্যবহার আর উচ্চারণ বিকৃতি সমানে চলছে। মুসলমানরাই তাদের সালামের বিকৃতি ঘটাচ্ছে, তা একটু লক্ষ্য করলেই বুঝা যাবে। আমরাই এ জন্য দায়ী। বাংলাদেশের সরহদ্দের মধ্যে যারা বাস করেন, তাদের শতকরা নিরানব্বই ভাগ মানুষ শুদ্ধ জবানে ‘আস্সালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেন না বা করতে পারেন না। ‘আস্সালামু আলাইকুম’ শুদ্ধ উচ্চারণের চেষ্টাও নেই। বিকৃত উচ্চারণের বহু সালাম আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। যেমনঃ

আস্সালামু আলাইকুম

আচ্ছালামু আলাইকুম

১. সালামালিকুম
২. সামালিকুম
৩. সেলামাইলেকুম
৪. শ্লামালিকুম
৫. ‘আস্সালামালিকুম
৬. আস্লামালিকুম
৭. সালাম
সালামের বিকৃতরূপ উচ্চারণ ও বানানের সাত প্রকার প্রচলন আমাদের সমাজে প্রচলিত। শুদ্ধ উচ্চারণের শুদ্ধ অরিজিন্যাল সালামও প্রচলিত আছে, তবে নগন্য সংখ্যকের মধ্যে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ‘আহমাদ’ নামটাও বিকৃতি থেকে রেহাই পায়নি। সেই আহমাদ নাম যারা নিজের নামের সাথে যুক্ত করেছেন, তারাই আহমাদ নামের বিকৃতি ঘটাচ্ছেন। কেউ লিখছেন আমমেদ, কেউ লিখছেন আহম্মেদ,। আবার কেউ লিখছেন আহাম্মেদ বা আহমদ। অথচ তাদের কেউ কেউ বিদ্যার যেন এক একটা টাইটানিক জাহাজ। তারা অনেক কিছুই জানেন, শুধু জানেন না নিজ নামের এই অংশটির বানান, অর্থ এবং ইতিহাস। আমাদের জবান দ্বারা উচ্চারিত এবং কলম দ্বারা লিখিত বহু শব্দের ব্যাপারে আমাদের উদাসিনতা, অজ্ঞতা, মুর্খতা, এবং অসচেতনতা প্রকাশ পায়। অপব্যাবহারের এই প্রবনতা আর বিকৃত করার মানসিকতা যা আমাদের পেয়ে বসেছে, এ সবের অনুশীলণ ইসলামের দুশমনদের হাতে আমরা আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের অস্ত্র যেন তুলে দিচ্ছি। আমরা মুসলমান হয়েও ‘মুহাম্মেদান’ অভিধায় ভূষিত হলে বেশ পুলকিত হয়। আহমাদকে আমরাই বানানে, উচ্চারণে ও লিখায় অবাধে বিকৃত করছি। ইংরেজদের উচ্চারণে বাপের নাম পর্যন্ত যদি বিকৃতির জালে আটকা পড়ে, তাহলে ‘ব্রাভো’ নূর উদ্দীন যখন বিলাতে গিয়ে নূরেডীন হলো, সেই নূরেডীন আর কখনো নূর উদ্দীন হতে পারেনি। ভ্রান্ত আর বিকৃতির বেড়াজাল সৃষ্টি করে খৃষ্টান জগত আমাদের অনেক মনীষীকে শত শত বছর আটকে রেখে মুসলমানদের পরিচিতির সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন রাখে।
মুসলমানদের প্রাচীনতম সম্ভাষণ আর দোয়া, যা আল্লাহ পাক সৃষ্টির প্রথম মানুষকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, আজকাল তা আদম (আ.)-এর বংশধরদের দ্বারা শুধু অপব্যাবহারই হচ্ছে না, বিকৃতিও হচ্ছে। শুদ্ধ উচ্চারণে সালাম দেওয়া বা নেওয়া খুব কঠিন কাজ নয়, কিছুক্ষণ প্রাকটিস করলেই উচ্চারণে শুদ্ধতা আনা যায়। যে সালামের শিক্ষক ছিলেন আল্লাহ তাআলা আর শিক্ষার্থী ছিলেন দুনিয়ার প্রথম নবী প্রথম মানুষ আদম (আ.), তাঁদের কথা স্বরণ করেও অপব্যবহার ও বিকৃতি থেকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ কে হিফাজত করা আমাদের নৈতিক কর্তব্য।

Related Post