২৬ শে মার্চের রাত, বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক ভয়াল ও বিভীষিকাময় রাত ছিল। যে রাতে হানাদার পাকবাহিনী নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের উপর মরণাস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। আর এ স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয় লাভ হয় ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হল, তার ভূখন্ড, মাতৃভূমিকে ভালবাসা। এটাই প্রিয় নবীজীর সা. এর উত্তম আদর্শ। মহানবী সা. যখন স্বীয় মাতৃভূমি মক্কা শরীফ ত্যাগ করে পাড়ি জমাচ্ছিলেন ইয়াছরিবের (মদীনার পূর্বনাম) প্রতি, তখন তাঁর চোখ থেকে অশ্রুর বন্যা বয়ে যাচ্ছিল এবং মনে মনে বলে ছিলেন, হে মক্কা! আমি তোমাকে ভালবাসি। কাফেররা নির্যাতন করে যদি আমাকে বের করে না দিত, কখনো আমি তোমাকে ত্যাগ করতাম না। [ইবনে কাসীর ৩/৪০৪]
হাদীসের বর্ণনায় আছে, নবীজী (সা.) মদীনা শরীফকে খুব ভালবাসতেন। কোন সফর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মদীনার সীমান্তে ওহুদ পাহাড় চোখে পড়লে নবীজীর চেহারাতে আনন্দের আভা ফুটে উঠত এবং তিনি বলতেন, এই ওহুদ পাহাড় আমাদেরকে ভালবাসে, আমরাও ওহুদ পাহাড়কে ভালবাসি। [বুখারি শরিফ ২/৫৩৯,৩/১০২৮, মুসলিম শরিফ ২/৯৯৩]
সুতরাং দেশপ্রেম, রাষ্ট্রের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা হচ্ছে মুসলমানদের চরিত্র। রাষ্ট্রের সাথে কোন সত্যিকার ঈমানদার গাদ্দারি করতে পারে না। সুতরাং এদেশের বিজয় দিবস আমাদের গৌরব, অহংকার। এখন জানার বিষয় হলো, বছরের চাকা ঘুরে যখন ১৬ই ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ আসবে, তখন সে দিনগুলোতে ইসলামের দৃষ্টিতে আমাদের করণীয় কী?
স্বাধীনতা দিবস সুন্নাহর দৃষ্টিতে
বিজয় দিবসের করণীয় সম্পর্কে আল্লাহর নবীর আদর্শ কী ছিল? যে মক্কা নগরী থেকে আল্লাহর নবী বিতাড়িত হলেন, ১০ বছর পর শত-সহস্র সাহাবায়ে কেরামের বিশাল বহর নিয়ে যখন পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করলেন, তখন তিনি বিজয় মিছিল-শোভাযাত্রা কিছুই করেননি। গর্ব-অহংকার করেননি, বাদ্য-বাজনা বাজাননি। নবীজীর অবস্থা কি ছিল? আল্লামা ইবনুল কাইয়িম জাওযী রহ. (মৃত ৫৯৭) তার কালজয়ী-অনবদ্য গ্রন্থ “যাদুল মাআদে” উল্লেখ করেন, আল্লাহর নবী একটি উষ্ট্রীর উপর আরোহণাবস্থায় ছিলেন, তাঁর চেহারা ছিল নিম্নগামী। (অর্থাৎ, আল্লাহর দরবারে বিনয়ের সাথে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন) সর্বপ্রথম তিনি উম্মে হানীর ঘরে প্রবেশ করেন। সেখানে আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। এই নামাজকে বলা হয় বিজয়ের নামাজ। এরপর নবীজী সা. হারাম শরিফে এসে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন, হে মক্কার কাফের সম্প্রদায়! তের বছর ধরে আমার উপর, আমার পরিবারের উপর, আমার সাহাবাদের উপর নির্যাতনের যে স্টিম রোলার চালিয়েছ, এর বিপরীতে আজকে তোমাদের কি মনে হয়, তোমাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করব? তারা বলল, হ্যাঁ, আমরা কঠিন অপরাধী। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, আপনি আমাদের উদার ভাই, উদার সন্তান, আমাদের সাথে উদারতা, মহানুভবতা প্রদর্শন করবেন। এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
আল্লাহর নবী (সা.) বললেন- হ্যাঁ, আমি আজ তোমাদের সকলের জন্য হযরত ইউসুফ (আ.) এর মত সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলাম। যাও তোমাদের থেকে কোন প্রতিশোধ নেওয়া হবেনা। [সুনানে বাইহাকী: ৯/১১৮]
এখানেই ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব, অনবদ্যতা, অনন্যতা। শান্তিপূর্ণভাবে মক্কা বিজয় করে মহানবী (সা.) পুরো বিশ্বকে এই ম্যাসেজ দিলেন যে, আমরা শান্তির পক্ষে, বোমাবাজি, খুনাখুনি, ত্রাস এবং লুন্ঠনের বিপক্ষে।
আমরা বুঝতে পারলাম যে, বিজয় দিবসে আমাদের করণীয় হল, বিজয়ের আট রাকাত নামাজ আদায় করা, শত্রুর প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন করা ইত্যাদি। কিন্তু বিজয়ের দিন যখন আসে, আমরা ফুলের তোড়া নিয়ে শহিদ মিনারে দৌড় দেই। প্রশ্ন জাগে, এটা কি কুরআনের আদর্শ? না নবীজীর চরিত্র? না কবরস্থানে ফুল দেওয়া, পুস্পস্তবক অর্পণ, নীরবতা পালন এগুলো পাশ্চাত্য সভ্যতার নিদর্শন। খ্রীস্টানরা কবর জিয়ারত করেনা, বরং ফুলের তোড়া দেয়। আমাদের এত সোনালী অতীত থাকা সত্ত্বেও কোন দুঃখে আমরা তাদের অন্ধ অনুকরণে মেতে উঠেছি ? আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।
আসুন একটু ভাবি!
স্বাধীনতার ৪৩ বছরে আমাদের সফলতা এবং প্রাপ্তির হিসাবটা একটু কষি। দুর্নীতি, অন্যায় ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই স্বাধীনতার দিনে দল-মত নির্বেশেষে আসুন শপথ গ্রহণ করি, আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা করি, চোরদের বিরুদ্ধে, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে, লুঠেরাদের বিরুদ্ধে। যদি সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদেরকে ঘৃণা করি, তাহলে এটা হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বড় মুক্তিযুদ্ধ। দেশকে দুর্নীতির আগ্রাসন থেকে, সন্ত্রাসের করাল গ্রাস থেকে, শকুনের শ্যোনদৃষ্টি থেকে মুক্ত করে সারা পৃথিবীতে মুসসলমানদের এই দেশকে উজ্জ্বল করাই হোক স্বাধীনতা দিবসের দৃপ্ত শপথ।