Main Menu

ইসলামে জ্ঞান চর্চার গুরুত্ব ও জ্ঞানীর মর্যাদা

ইসলামে জ্ঞান চর্চার গুরুত্ব ও জ্ঞানীর মর্যাদা

ইসলামে জ্ঞান চর্চার গুরুত্ব ও জ্ঞানীর মর্যাদা

প্রিয় মুসলিম ভাই ও বন্ধুগণ! ইসলামে জ্ঞান চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। পড়া ও লেখা উভয় মাধ্যমই জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে অতীব জরুরী। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ. اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ. الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ. عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ

‘পড়ো তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পড়ো, আর তোমার রব মহামহিম, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না । (সূরা আলাক: ১-৫)

ইমাম বুখারী রহ. বলেন,কোনো বিষয়ে কিছু বলা এবং আমল করার পূর্বে সে বিষয়ে জ্ঞানার্জন করা প্রয়োজন। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন :

 فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ

‘আর জেনে নাও,আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই । (সূরা মুহাম্মাদ: ১৯)

এখানে ‘জেনে নাও’ বাক্য দ্বারা আল্লাহ তাআলা ‘ইলম শিক্ষা বা জ্ঞানার্জনের’ কথা দিয়ে শুরু করেছেন।

ইলম ও আলেমের মর্যাদা:

مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا، سَهَّلَ اللهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ، وَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ، وَإِنَّ طَالِبَ الْعِلْمِ يَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاءِ وَالأَرْضِ، حَتَّى الْحِيتَانِ فِي الْمَاءِ ، وَإِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ، كَفَضْلِ الْقَمَرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ، وإِنَّ الْعُلَمَاءَ هُمْ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ، إِنَّ الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا وَلاَ دِرْهَمًا، إِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ، فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ رواه الترمذي وغيره وصححه الألباني

যে ব্যক্তি ইলম হাছিলের জন্য কোন পথ অবলম্বন করে,আল্লাহ তার মাধ্যমে তাকে জান্নাতের পথসমূহের একটি পথে পৌঁছে দেন এবং ফেরেশতাগণ ইলম তলবকারীর সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের ডানাসমূহ বিছিয়ে দেন। নিশ্চয়ই যারা আলেম তাদের জন্য আসমান ও যমীনে  যারা আছে, তারা আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে,এমনকি মাছসমূহ পানির মধ্যে থেকেও। আলেমগণের মর্যাদা আবেদগণের উপরে ঐরূপ,পূর্ণিমার রাতে চাঁদের মর্যাদা অন্যান্য তারকাসমূহের উপরে যেরূপ। নিশ্চয়ই আলেমগণ হলেন নবীগণের উত্তরাধিকারী। আর নবীগণ কোন দীনার বা দিরহাম উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে যান না। বরং তাঁরা রেখে যান কেবল ইলম। অতএব যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করেছে, সে ব্যক্তি পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে’। (তিরমিযী)

ইলম ও জ্ঞানই মানুষকে আল্লাহ-ভীরু করে তোলে: ইরশাদ হয়েছে :

 إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ

আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল আল্লাহকে ভয় করে । (সূরা আল ফাতির:২৮)

আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা যেসব উদাহরণ পেশ করেছেন,দৃষ্টান্ত দিয়েছেন তা অনুধাবনের জন্যও জ্ঞানী হওয়া প্রয়োজন: ইরশাদ হয়েছে :

وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ وَمَا يَعْقِلُهَا إِلَّا الْعَالِمُونَ

‘আর এসব দৃষ্টান্ত আমি মানুষের জন্য পেশ করি আর জ্ঞানী লোকেরা ছাড়া কেউ তা বুঝে না’ (সূরা আল আনকাবূত:৪৩)।

যে জানে এবং যে জানেনা এ দুব্যক্তি সমান হতে পারে না: আল কুরআনে এ কথা স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে :

قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ

‘বল, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে ?’ (সূরা আয-যুমার:৯)।

আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন: রাসূলে কারীম (সা.) এরশাদ করেন:

 مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْراً يُفَقِّهْهُ فِي الدِّيْنِ

আল্লাহ তাআলা যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের সহীহ বুঝ দান করেন । (বুখারী ও মুসলিম )

প্রিয় মুসলিম ভাই ও বন্ধুগণ! ইলম অর্জন ও চর্চার প্রতি আমাদেরকে গুরুত্ব দিতে হবে। চর্চা ছড়া আপন ইচ্ছায় ইলম অর্জিত হয় না। আবুদ দারদা রাযি. বলেন :     إِنَّمَا الْعِلْمُ بِالتَّعَلُّمِ

ইলম তো শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমেই অর্জিত হয়।(তাবাকাতুশ শাফিইয়াহ আল কুবরা,হাসান )

যারা ইলম অর্জন করে আল্লাহ তাআলা তাদের মর্যাদা সমুন্নত করে দেন: ইরশাদ হয়েছে :
يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদা সমুন্নত করবেন। আর তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবহিত’ (সূরা আল মুজাদালাহ:১১)।

মুহতারাম হাযেরীন! জ্ঞান এমন একটি বিষয়, যে ব্যাপারে পরস্পরে ঈর্ষা করা জায়েয: ইবনে মাসঊদ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

لَا حَسَدَ إِلَّا فِيْ اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالاً فَسَلَّطَهُ عَلَى هَلَكَتِهِ فِي الْحَقِّ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ حِكْمَةً فَهُوَ يَقْضِيْ بِهَا وَيُعَلِّمُهَا

দুই ব্যক্তির ওপর ঈর্ষা করা যেতে পারে: একজন হলো,যাকে আল্লাহ তাআলা মাল দিয়েছেন এবং তাকে সত্যের পথে খরচ করার তাওফীকও দিয়েছেন। আর অপরজন হলো,যাকে আল্লাহ হেকমত দিয়েছেন অতঃপর সে ঐ হেকমত দ্বারা ফয়সালা করে এবং মানুষকে তা শিক্ষা দেয় (বুখারী)।

ইলম অনুসন্ধানকারী জন্য সকলেই ক্ষমা প্রার্থনা করে:

ইলম অন্বেষণ করা এতই মর্যাদাপূর্ণ যে তালেবে ইলমের জন্য আসমান ও যমীনের সকল কিছুই ইস্তেগফার করে,আল্লাহর কাছে ইলম অন্বেষণকারীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। হাদীসে এসেছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

وَإِنَّ طَالِبَ الْعِلْمِ يَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ حَتَّى الْحِيْتَانُ فِي الْمَاءِ

তালেবে ইলমের জন্য জগতের সবকিছুই (আল্লাহ তাআলার দরবারে) ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি পানির মাছও । (আবু দাউদ, তিরমিযী)

ইলমের ফযীলত আমলের ফযীলত থেকেও অধিক: মুতাররিফ ইবনে শিখ্খীর বলেন :

فَضْلُ الْعِلْمِ خَيْرٌ مِنْ فَضْلِ الْعَمَلِ، وَخَيْرُ دِيْنِكُمْ الْوَرَعُ

ইলমের ফযীলত আমলের ফযীলতের চেয়ে বেশি। আর তোমাদের সর্বোত্তম দ্বীন হলো তাকওয়া পরহেযগারী।(তাবারানী)।

প্রিয় মুসল্লিয়ানে কেরাম! ইলম অর্জন করা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ বিষয়। তবে এক্ষেত্রেও আমাদের ইখলাস ও ঐকান্তিকতার পরিচয় দিতে হবে। নিয়ত পরিশুদ্ধ করতে হবে। গুরুত্বের বিবেচনায় যা আগে শেখা প্রয়োজন তা আগে শিখতে হবে। এরপর ধীরে-ধীরে এগুতে হবে। মনে রাখবেন, ইখলাসশূন্য কোনো নেক আমলই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। ইরশাদ হয়েছে :

وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ

‘আর তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন একনিষ্ঠ হয়ে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে’ (সূরা আল-বায়্যিনাহ:৫)।

হাদীসেও ইলম অর্জন করার ক্ষেত্রে ইখলাসের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে:  একটি হদীসে এভাবে এসেছে :

مَنْ تَعَلَّمَ عِلْماً مِمَّا يُبْتَغَيْ بِهِ وَجْهُ اللهِ – عَزَّ وَجَلَّ لا يَتَعَلُّمُهُ إِلَّا لِيُصِيْبَ بِهِ عَرَضاً مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ

‘যে ব্যক্তি এমন ইলম অর্জন করল যা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই অর্জন করা হয় অথচ সে তাকে দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যেই অর্জন করল, কিয়ামতের দিন সে বেহেশতের ঘ্রাণও পাবে না’। (আবু দাউদ, ইমাম নববী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।)

আলেমগণ হৃদয়ের প্রাণ আর তাদের ভিতরে যে ইলম রয়েছে, তা হলো ‘আলো’ যদ্বারা পথের দিশা পায় জলে ও স্থলে বসবাসকারী। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করছেন:

﴿أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ﴾ [سورة النساء: الآية 59]

  আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রাসূলের আর সেই সব লোকের যারা তোমাদের মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী৷

উক্ত আয়াতে উলিল আমর শব্দের অর্থ রাইসুল মুফাসসিরীন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস এর নিকট উলামায়ে কেরাম। আর শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রহ.) বলেন উলিল আমর-এর এক অর্থ ইসলামী নেতা। আরেক অর্থ উলামায়ে কেরাম।

ইলম শেখার পর আলেমের জন্য দায়িত্ব হলো অন্যের নিকট তা পৌঁছানো:

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! ইলম অর্জনকারীর কিছু দায়দায়িত্ব রয়েছে। তন্মধ্যে প্রধান হলো, ইলম অর্জনে আমানতদারী রক্ষা করা। অর্জিত ইলম মানুষের মধ্যে প্রচার করা। ইলম অনুযায়ী মানুষকে নসীহত করা এবং মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথে আহ্বান করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

مَنْ دَعَا إِلَى الْهُدَى كَانَ لَهُ مِنْ الْأَجْرِ مِثْلُ أُجُوْرٍ مَنْ تَبِعَهُ، إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيْءٌ

‘কোনো লোক যদি কোনো ভালো কাজের দিকে আহ্বান করে তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত যত লোক তার অনুসরণ করবে সে সকলের সমপরিমাণ ছাওয়াব লাভ করবে। কিন্তু তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে যারা ঐ ভালো কাজটি সম্পাদন করল তাদের ছাওয়াব থেকে সামান্য পরিমাণ ছাওয়াবও হ্রাস করা হবে না’ (মুসলিম) ।

প্রয়োজনীয় দুনিয়াবী ইলমও ইসলাম শিক্ষা করতে উৎসাহ প্রদান করেছে:

প্রিয় ভাইয়েরা! ইসলাম দীনী ইলম ও অভিজ্ঞতালব্ধ পার্থিব ইলম উভয় প্রকার ইলমের প্রতিই গুরুত্বারোপ করেছে। কেননা আমাদেরকে এ পৃথিবীতে থেকেই ঈমান ও আমলের পরীক্ষা দিতে হবে। তাই প্রয়োজনীয় দুনিয়াবী ইলমও আমাদেরকে অর্জন করতে হবে। ইসলাম দুনিয়াবী জ্ঞানার্জনকে নাকচ করে দেয়নি, বরং স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশেষ করে প্রায়োগিক ইলম বা জ্ঞান যা না হলে যথার্থরূপে পৃথিবীকে কর্ষণ করা সম্ভব হয় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় হিজরতের পর দেখতে পেলেন যে, সাহাবায়ে কিরাম খেজুর উৎপাদনে কৃত্রিম প্রজনন প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেন। তিনি প্রথমে তা নিষেধ করলেন। সাহাবায়ে কিরাম কৃত্রিম প্রজনন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিলেন। ফলে দেখা গেল যে খেজুরের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে গিয়েছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুনরায় অনুমতি দিয়ে বললেন:  أَنْتُمْ أَعْلَمُ بِشُؤُونِ دُنْيَاكُمْ ‘তোমাদের পার্থিব বিষয়ে তোমরাই বেশি অবগত’ (মুসলিম)।

প্রিয় ভাইয়েরা! আধুনিক শিক্ষা ইসলামে নিষিদ্ধ নয়:  তবে তা হতে হবে একজন সুনাগরিক তৈরির হাতিয়ার। আল্লাহর প্রতি বলিষ্ঠ বিশ্বাসী তৈরির হাতিয়ার। যথার্থরূপে পৃথিবীকে কর্ষণ করতে পারে এমন মানুষ তৈরির হাতিয়ার। তবে দুঃখের বিষয় হলো, মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ এলাকায় শিক্ষার নামে এমন কিছু শেখানো হয়,যা কোনো অর্থেই উপকারী জ্ঞানের আওতায় পড়ে না যা সত্যিকার অর্থে একজন জ্ঞানী তৈরি করতে ব্যর্থ।

হযরত আলী (রা.) ইলমের গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন এভাবে: হে কুমাইল ইবনে যিয়াত! ইলম তথা জ্ঞান সম্পদ অপেক্ষা উত্তম। ইলম তোমায় প্রহরির কাজ করতে। আর তোমাকে সম্পদের প্রহরির দায়িত্ব পালন করতে হয়। আর ইলম হাকেম বা বিচরাক। আর সম্পদ মাহকূম আলাইহি বা যাকে নিয়ে সর্বদা বিচার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। আর মাল খরচ করলে কমে, কিন্তু ইলম যত খরচ করা হয় তত বৃদ্ধি পায়। একজন আলেম রোযাদার কিয়াম আদায়কারী ও মুজাহিদ অপেক্ষা বেশি সম্মানের অধিকারী।

সম্মানিত উপস্থিতি! উলামায়ে কেরামগণ হেদায়াতের আলোক বর্তিকা। আকাশের নক্ষত্রের ন্যায়, তাদের দেখে পথের দিশা পাবে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন:  وَبِالنَّجْمِ هُمْ يَهْتَدُونَ وَعَلامَاتٍ

এবং তিনি পথ নির্ণয়ক বহু চিহ্ন সৃষ্টি করেছেন,এবং তারকা দ্বারা ও মানুষ পথের নির্দেশ পায়।

হযরত আলী (রা.) বলেন:

رَضِيْنَا قِسْمَةَ الْجَبَّارِ فِيْنَا * لَنَا عِلْمٌ ولِلْجُهَّالِ مَالُ *  فَإِنَّ الْمَالَ يَفْنَى عَنْ قَرِيْبٍ * وَإنَّ الْعِلْمَ يَبْقَى لَا يَزَالُ

فَإِنَّ فَقِيْهًا وَاحِدًا مُتَوَرِّعًا * أَشَدُّ عَلَى الشَّيْطَانِ مِنْ أَلْفِ عَابِدٍ*  

فَفُزْ بِعِلْمٍ تَعِشْ حَيًّا بِهِ أَبَدًا  * النَّاسُ مَوْتَى وَأَهْلُ الْعِلْمِ  أَحْيَاءُ

আল্লাহর বণ্টনে আমরা সন্তুষ্ট। আমাদের জন্য আল্লাহ ইলম বা জ্ঞান নির্ধারণ করেছেন, আর জাহেলদের জন্য সম্পদ। জেনে রাখুন মাল দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাবে, আর জ্ঞান চিরকাল বাকী থাকবে। একজন আল্লাহভিরু ফকীহ বা জ্ঞানী শয়তানের মুকাবালায় হাজার আবেদ অপেক্ষা শক্তিশালী। জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে সফলতা লাভ করুন এবং আজীবন বেঁচে থাকুন। কেননা পৃথিবীর সকল মানুষই মৃত, আর জ্ঞানের ধারক বাহকগণ জীবীত।

সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো ইলম। আর অর্জন করার জন্য অবশ্যই চেষ্টা ও কষ্ট করতে হবে- ইমাম শাফেঈ (রহ.) বলেন:

وَلَيْسَ اكْتِسَابُ الْمَالِ دُونَ مَشَقَّةٍ  **تَكَبَّدْتَهَا، فَالعِلْمُ كَيْفَ يَكُونُ؟

 بِقَدْرِ الكَدِّ تُكْتَسَبُ المَعَالِي ** وَمَنْ طَلَبَ العُلَا سَهِرَ اللَّيَالِي

وَمَنْ رَامَ العُلَا مِنْ غَيْرِ كَـدٍّ ** أَضَاعَ العُمَرَ فِيْ طَلَبِ المُحَالِ

 تَرُوْمُ الْعِزَّ ثُمَّ تَنَامُ لَيْلاً ** يَغُوْصُ الْبَحْرَ مَنْ طَلَبَ الَّـلآلِيْ

عُلُوُّ الْقَدْرِ بِالْهِمَمِ العَـوَالِي ** وَعِزُّ الْمَرْءِ فِيْ سَهَرِ اللَّيَـالِــيْ

যখন দুনিয়াবী মাল-সম্পদ কষ্ট ছাড়া অর্জিত হয় না, তাহলে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ইলম কষ্ট ছাড়া কিভাবে অর্জন হবে? কষ্ট ও চেষ্টা করে মানুষ উচ্চপদ লাভ করে, আর যে পদ লাভ করতে চায়, তাকে অবশ্যই রাত্রি জাগরণ করতে হয়। আর যে , বিনা প্রচেষ্টায় পদ লাভ করতে চায়, সে যেন অসম্ভব বস্তু অর্জনের পেছনে তার জীবন শেষ করে দিলো। তুমি সম্মান লাভ করতে যাও, আর রাত ভরে ঘুমিয়ে থাক! শোন ডুবুরী মুক্তা অনুসন্ধানে সমুদ্রে গভীরে ডুব দিতে হয়। উচ্চ মর্যাদ উচ্চ সাহসের মাধ্যমে লাভ করা যায়, আর মানুষের সম্মান রাত্রি জাগরণে নিহিত।

আলেমের মর্যাদা

 আলেমরাই বিশ্বস্ত :  পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

﴿شَهِدَ اللهُ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ ۚ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ﴾

আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই, আর ফেরেশতা ও জ্ঞানীগণও। তিনি ন্যায় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’। {সূরা আলে-ইমরান, আয়াত : ১৮}

এ থেকে জানা গেল, আলেমরা হলেন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য। যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা সবচে বড় সমাবেশে (হাশরের মাঠে) সাক্ষ্য বানাবেন।

স্বয়ং আল্লাহ আলেমদের প্রশংসা করেছেন: 

আল্লাহ তা‘আলা আহলে ইলম তথা আলেমদের প্রশংসা ও গুণ গেয়েছেন। তাঁর কিতাবকে তিনি তাঁদের বক্ষে সুস্পষ্ট নিদর্শন হিসেবে স্থান দিয়েছেন। এর মাধ্যমে অন্তর পুলকিত হয়,আমোদিত ও সৌভাগ্যমণ্ডিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿بَلْ هُوَ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ فِي صُدُورِ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ ۚ وَمَا يَجْحَدُ بِآيَاتِنَا إِلَّا الظَّالِمُونَ﴾

‘বরং যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে,তাদের অন্তরে তা সুস্পষ্ট নিদর্শন। আর যালিমরা ছাড়া আমার আয়াতসমূহকে কেউ অস্বীকার করে না।  {সূরা আল-আ‘নকাবূত, আয়াত : ৪৯}

আলেমরা নবীগণের ওয়ারিশ:

প্রত্যেক উম্মত সমকালীন নবীদের নির্দেশ অনুযায়ী চলতেন। আর শেষ নবীর উম্মতগণের মধ্যে আলেমগণই পূর্বেকার নবীদের ভূমিকা পালন করবে।  তাঁরাই হলেন ‘আহলে যিকর’ তথা কুরআনের ধারক-বাহক। আল্লাহ তা‘আলা কোন বিষয় জানা না থাকলে আলেমদের কাছে জিজ্ঞেস করতে বলেছেন। তিনি ইরশাদ করেন,

﴿وَمَا أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ إِلَّا رِجَالًا نُّوحِي إِلَيْهِمْ ۖ فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ﴾

সুতরাং তোমরা জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর যদি তোমরা না জান। সূরা আল-আম্বিয়া,আয়াত: ০৭

আল্লাহ আলেমদের মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন:

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

 يَرْفَعِ اللهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ﴾

‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় সমুন্নত করবেন’। {সূরা আল-মুজাদালাহ, আয়াত : ১১}

মারা গেলেও আলেমের আমল বন্ধ হয় না:

মানুষ বেঁচে থাকে এবং তারপর মারা যায়। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার আমলও বন্ধ হয়ে যায়। ব্যতিক্রম শুধু আলেমরা। যে আল্লাহ ওয়ালা আলেম উপকারী ইলম প্রচার করে মৃত্যুবরণ করেন, তিনি মারা গেলে পরবর্তী লোকেরা তাঁর ইলম থেকে উপকৃত হয় আর তিনি নেকী পেতে থাকেন। ইখলাসের সঙ্গে কাজ করলে তাই তাঁদের নেকী বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

  عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: اِذَا مَاتَ الاِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ اِلَا مِنْ ثَلَاثَةٍ اِلَا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، اَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، اَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُوْ لَهُ -(مسلم 4310 )

 মানুষ যখন মারা যায়,তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি উৎস থেকে তা অব্যাহত থাকে: সাদাকায়ে জারিয়া,উপকারী ইলম অথবা নেক সন্তান যে তার জন্য দু‘আ কর। [মুসলিম]

আলেম ও তালেবে ইলমের প্রতি আল্লাহর অবিরাম রহমত বর্ষণ:

পৃথিবীর সব কিছুই ধ্বংসে নিপতিত,সবই বিলয়ের পথে ধাবমান। সব কিছুর ওপরই লানতের বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। সব কিছুর মধ্যে কেবল মানুষের দুইটি শ্রেণী ব্যতিক্রম যাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হতে থাকে : ইলমসম্পন্ন ব্যক্তি ও ইলম অন্বেষণকারী এবং অধিক হারে আল্লাহর জিকিরকারী আবেদ। যেমন আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ، سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «أَلَا إِنَّ الدُّنْيَا مَلْعُونَةٌ وَ مَلْعُونٌ مَا فِيهَا إِلَّا ذِكْرُ اللَّهِ وَمَا وَالَاهُ وَعَالِمٌ أَوْ مُتَعَلِّمٌ»   «هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ

    ‘মনে রেখ, নিশ্চয় দুনিয়া অভিশপ্ত। অভিশপ্ত এতে যা আছে তা-ও। শুধু আল্লাহ তা‘আলার জিকির ও জিকিরের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো এবং আলেম ও তালেবে এলেম ছাড়া।’     [তিরমিযী : ২৩২২; ইবন মাজা : ৪১০২]

 

Related Post