Originally posted 2013-02-06 05:59:38.
ধর্মীয় শিক্ষা, আদর্শ, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা মানুষকে যেমন অধিকার সচেতন করে তোলে, তেমনি বিভিন্ন আর্থসামাজিক অবস্থা ও পারিবারিক সমস্যা মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করে। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও জীবনাচরণের মূল উৎসও ধর্মীয় অনুভূতিপ্রসূত। মানুষের সার্বিক কল্যাণে পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত পরিবার গঠনের জন্য ইসলাম পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ জীবন বিধানের সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। কিন্তু পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশের জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে আশানুরূপ সাফল্য না আসায় জনসংখ্যা দেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠেছে। নর-নারীর মধ্যে সুস্থ-স্বাভাবিক ও পরিকল্পিত পদ্ধতিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পথ বৈবাহিক ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের মাধ্যমে প্রশস্ত হয়। পারিবারিক জীবনে দাম্পত্য সম্পর্কের দ্বারাই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা গড়ে ওঠে। একে অন্যের সন্তুষ্টি ও স্বস্তির জন্যই নয়, বৈরী পরিস্থিতির মোকাবিলায় যুগল সম্পর্কজাত শক্তি অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। আর সংসারে নতুন অতিথি তথা নবজাত সন্তান-সন্ততির আবির্ভাবের ফলে দাম্পত্য সম্পর্ক সাংগঠনিক পরিপূর্ণতা লাভ করে। পরিকল্পিত পরিবারে সন্তান আগমনে নতুন দায়দায়িত্ব, চিন্তা-চেতনা ও কর্তব্যবোধ স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মানসিকতার পরিবর্তন সাধন করে দেয়। সুস্থ, সুন্দর ও পরিকল্পিত দাম্পত্য সম্পর্ক নির্মিত হওয়ার মাধ্যমেই পরিবারে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তিময় পরিবেশ বিরাজ করতে পারে। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে, যারা উদাসীন হবে, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সূরা আল-মুনাফিকুন, আয়াত-৯)
প্রজননস্বাস্থ্য বা পরিবার পরিকল্পনায় ইসলামের বিধান বা নির্দেশগুলো সুস্পষ্ট। পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্বামী-স্ত্রী পরস্পর আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে পরিকল্পিতভাবে তাদের পরিবার গঠন করবে। একটি আদর্শ দম্পতি নিজেদের আয়ের সঙ্গে ও পারিপার্শ্বিক আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কয়টি সন্তান গ্রহণ করবে বা তার পরিবারের আয়তন কী হবে, তা ঠিক করে নেওয়াই হলো পরিকল্পিতভাবে পরিবার গড়ে তোলা। প্রাপ্তবয়সে প্রথম সন্তান নেওয়ার আগেই একটি দম্পতিকে ঠিক করে নিতে হবে তার পরিবারের আয়তন কেমন হওয়া উচিত। পবিত্র কুরআনে সাবধান করা হয়েছে, ‘তারা যেন ভয় করে যে, অসহায় সন্তান পেছনে ছেড়ে গেলে তারাও তাদের সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন হতো।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত-৯) আরও বলা হয়েছে, ‘জেনে রাখো যে, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো এক পরীক্ষা।’ (সূরা আল-আনফাল, আয়াত-২৮)
ইসলামের দৃষ্টিতে ধন-সম্পদ ও সন্তানের আধিক্যহেতু বিপথগামিতা অনভিপ্রেত; আবার অভাব-অনটনও কাঙ্ক্ষিত নয়। দারিদ্র্য, অপরিকল্পিত পরিবার ও অভাব-অনটনের সংসারে সন্তানদের মানুষ করা সম্ভব হয় না। ইসলামে যে সহজ-সরল জীবনব্যবস্থার পথনির্দেশনা রয়েছে, তা পরিকল্পিত উপায়ে নিয়ন্ত্রিত পরিবার গঠন করার মাধ্যমেই লাভ করা যেতে পারে। তাই গ্রাম পর্যায়ে নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাতৃস্বাস্থ্যসেবা ও জন্মনিয়ন্ত্রণের আগ্রহ বৃদ্ধি এবং উপায়সমূহ সুলভ করে তোলার কার্যক্রম জোরদার করা বাঞ্ছনীয়।
ইসলামের আলোকে পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবার গঠনে সন্তানসংখ্যা সীমিত রাখতে বা দুটি সন্তানের মাঝে জন্মবিরতি দিতে পরিবার পরিকল্পনার কোনো না-কোনো পদ্ধতি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অবলম্বন করতে হবে। যেহেতু ইসলামের প্রাথমিক যুগে অন্য কোনো পদ্ধতি ছিল না, সে জন্য সাহাবায়ে কিরাম অসুবিধাজনক হলেও ‘আজল’ অবলম্বন করেছেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল গর্ভবিরতীকরণ, যাতে ঘন ঘন সন্তান না হয়। কিন্তু আধুনিক যুগে বর্তমান সমাজে অনেক সহজলভ্য ও নিরাপদ পদ্ধতি আছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনে একমত হয়ে সন্তান নিতে না চাইলে বা গর্ভবিরতি দিতে চাইলে পছন্দমতো ইসলামের আলোকে পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন শরিয়তসম্মত আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সমকালীন জন্মহার প্রতিরুদ্ধ বা হ্রাস করার অনুমোদিত গর্ভনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির নাম ‘আজল’ এবং আধুনিক পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন পদ্ধতি এরই উন্নত সংস্করণ। যেহেতু আজল অনুমোদিত, সেহেতু আধুনিক পদ্ধতিও অনুমোদিত। নবী করিম (সা.) আজলের বিষয়টি অবহিত ছিলেন এবং অনুমোদন করেছেন। সন্তান জন্মদান থেকে বিরত থাকার জন্য প্রাচীনকাল থেকে মানুষ এসব পদ্ধতি অবলম্বন করত। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কোনো কোনো বিশিষ্ট সাহাবিও সন্তান জন্মদান থেকে বিরত থাকার জন্য আজল পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন।
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, হজরত জাবের (রা.) বলেছেন, ‘আমরা রাসুলে করিম (সা.)-এর জীবদ্দশায় যখন আজল করতাম, এ সময় আল-কুরআন নাজিল হতো (কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো নিষেধ বাণী আসেনি)। আজল করার বিষয়টি নবী করিম (সা.) জানতেন, তবু তিনি আমাদের আজল করতে নিষেধ করেননি।’ (বুখারি ও মুসলিম)
অন্য হাদিসে আছে, হযরত ওমর (রা.) বলেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে আজল করতে নিষেধ করেছেন।’ (ইবনে মাজা)
সুতরাং স্ত্রীর অনুমতি থাকলে সন্তান না নেওয়ার জন্য স্বামী আজল বা বাইরে বীর্যপাত ঘটানো পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে। পরিকল্পিত পরিবার গঠনের লক্ষ্যে স্ত্রীর যৌন ও প্রজনন অধিকারও ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করেছে। সাহাবায়ে কিরাম গর্ভবিরতীকরণে যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন ধর্মপ্রাণ লোকেরা তা অনায়াসে গ্রহণের জন্য পরিবার পরিকল্পনার আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন।
দেশের তরুণ ও যুবসমাজকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদেরকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করবে এবং তাদেরকে উত্তম মূল্যবোধ শেখাবে।’ নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের শিক্ষা দাও। কারণ, তোমাদের জমানা থেকে ভিন্ন আরেক জমানার জন্য তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে।’ (মুসলিম)
ধর্মীয় নেতা বা ইমামগণ দেশের জাতীয় উন্নয়নে সীমিত জনসংখ্যা ও পরিবার পরিকল্পনার অপরিসীম ভূমিকা বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া প্রদান করে বিভিন্ন মসজিদে খুতবা, ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণকে পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত পরিবার গঠনে উদ্বুদ্ধ ও সচেতন করছেন। শিক্ষিত পরিবার ও উন্নত জাতির অগ্রযাত্রায় দেশের সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে ইসলামের আলোকে পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে জন্মহার বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সীমিত জনসংখ্যাকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করার জন্য পরিবার পরিকল্পনাকে সামাজিক আন্দোলনরূপে প্রতিষ্ঠা করে পারিবারিক শান্তি, ইহকালীন কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তি লাভে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।