বিয়ে একটি সামাজিক বন্ধন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যেক ধর্মেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কোন ধর্মেই বিয়ে বিহীন সহবস্থান গ্রহণ করে না, সভ্য সমাজে বিয়ে বিহীন জোটিকে অন্য নজরে দেখা হয়। ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে বিয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। বক্ষমান প্রবন্ধে আমরা বিয়ে সংক্রান্ত খুটি-নাটি বিষয় যেমন বিয়ের প্রয়োজনীয়তা, পাত্র-পাত্র নির্বাচন করা, বিয়ে প্রচলিত কুপ্রথা ও তা হতে বাঁচার উপায়, যৌতুক, আদর্শ বিয়ের কিছু উদাহরণ,বিয়ের প্রস্তাব করণীয় ও বর্জনীয়, সৌভাগ্যময় জীবনের পূর্ণাঙ্গ উপায়, সদ্যবিবাহিত ছেলে-মেয়েদের জন্য অমূল্য উপদেশ ইত্যাদি বিষয় আলোকপাত করা হবে, ইনশা আল্লাহ। আশা করি এ ধারাবাহিকটি ধৈর্যসহাকারে পাঠকগণ পড়বেন। আল্লাহ সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন
মানুষ সমাজে একে অন্যের সাহচর্য নিয়ে বসবাস করে থাকে। পরিবার ও সমাজ ছাডা নিজে একাকী বসবাস কষ্টকর ও বলতে গেলে অসম্ভব। ছোট থেকে যুব ও পরিণত বয়সে সুখ-দুঃখ, মায়া-মমতা, সেবা-শুশ্রূষাসহ সব কার্যক্রম পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের মধ্য দিয়ে হয়ে থাকে। সুশৃঙ্খল ও স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহের জন্য প্রয়োজন পবিত্র ও সুসভ্য সামাজিক ব্যবসস্থা। যে ব্যবসস্থার মধ্যে থাকা চাই পরিপূর্ণ ও সব পর্যায়ে মঙ্গলকর নির্দেশনা। আর এ নির্দেশনা পাওয়া যায় ইসলাম ধর্মে। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবসস্থা।
ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে সুন্দর ও পবিত্র জীবনযাপনের জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওযার ব্যবসস্থা করেছে। বল্গাহীন স্বেচ্ছাচারী জীবনের উচ্ছৃঙ্খলতামুক্ত ও নোংরামিপনার অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির মায়া-মমতার বন্ধনে আবদ্ধিত জীবনের সন্ধান দিয়েছে। নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিবাহ হচ্ছে একমাত্র বৈধ উপায় এবং মানুষের চরিত্র ও সতীত্বকে রক্ষার হাতিয়ার। বিয়ের মাধ্যমে পারিবারিক জীবনে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং পরস্পরের মধ্যে অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের অপরিহার্যতা আরোপিত হয়।
বিভিন্ন ধর্মে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে কিছু ধারণা দেওয়া হল :
হিন্দু ধর্মে বিয়ে :
পাত্র-পাত্রী পছন্দ এবং উভয় পরিবারের সমঝোতার পর শুভ দিন এবং শুভ তিথি বা লগ্ন নির্ধারণ করা হয়। ওই তারিখ এবং সময়ে উভয়পক্ষের ২ জন ব্রাহ্মণ এবং অভিভাবকদের উপস্থিতিতে বিবাহ কার্য সম্পাদন করা হয়। বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার আগে উভয়পক্ষের ব্রাহ্মণরা পাত্র এবং পাত্রী দু’জনকে কিছু প্রতিজ্ঞা, প্রতিশ্রুতি এবং শর্ত জুড়ে দেন। পাত্র-পাত্রী উভয়েই ওই শর্ত মেনে নিয়ে সম্মতি প্রকাশ করলেই বিবাহ কার্য শুরু হয়। একটি ব্যাপার এখানে লক্ষণীয়, বিবাহের বেঁধে দেয়া লগ্ন বা সময় পেরিয়ে গেলে বিবাহ কার্য সম্পাদন করা যাবে না। পরবর্তী চন্দ্র মাসের তারিখ অনুযায়ী পুনরায় লগ্ন নির্ধারণ করা হয় এবং তারপরই কেবল বিবাহ কার্য সম্পাদন করা যাবে। বিবাহের আগের দিন বর-কনে উভয়কেই সংযম পালন করতে হয়। অর্থাৎ শুধু উপবাস করে থাকতে হয় এবং বিবাহের দিনও উভয়েই উপোস থাকে। বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পরই কেবল পাত্র-পাত্রী খাবার গ্রহণ করতে পারে।
খ্রীষ্টান ধর্মে বিয়ে :
পাত্র-পাত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর উভয় পরিবারের সম্মতি নিয়ে গির্জায় একজন ফাদার বা পাদ্রিকে জানাতে হয়। জানানোর পর ফাদার গির্জায় আগত সবার সামনে ঘোষণা করেন, এ পাত্রীর সঙ্গে অমুক পাত্রের বিবাহ সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে উপস্থিত আপনাদের কারও কোনও মন্তব্য বা বক্তব্য থাকলে বলতে পারেন। এ ঘোষণার পর থেকে পাত্রী তিন সপ্তাহ ধরে ওই গির্জায় প্রার্থনার জন্য যাতায়াত করেন। ওই তিন সপ্তাহ চলাকালীন সময়ে কারও কোনও প্রকার অভিযোগ না থাকলে ৪র্থ সপ্তাহে বিবাহের দিন ধার্য করা হবে। অর্থাৎ সবার স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পাওয়ার পর দুই পরিবার বিয়ের আয়োজন শুরু করে থাকে। নির্ধারিত তারিখে নির্ধারিত কোনও গির্জায় ফাদার কর্তৃক পবিত্র বাইবেল পাঠের মাধ্যমে বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়।
বৌদ্ধ ধর্মে বিয়ে :
প্রথমেই ছেলের পক্ষ থেকে পাত্রী নির্বাচন করা হয়। পরে উভয়পক্ষের অভিভাবকদের সমঝোতার ভিত্তিতে এনগেজমেন্টের তারিখ নির্ধারণ করে সেই তারিখেই এনগেজমেন্টের আনুষ্ঠানিকতা পালন করার পর বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়।
বিয়ের তারিখের আগের দিন পাত্র এবং পাত্রী উভয়েই তাদের নিজ নিজ মন্দিরে বাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করার পর পাত্র এবং পাত্রী উভয়ে তাদের নিকট আত্মীয়-স্বজন নিয়ে বৌদ্ধ মন্দিরে একজন পুরোহিতের কাছে উপস্থিত হন। সেখানেই মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে বিয়ে পড়ানো হয়। একে বলা হয় মঙ্গলাচরণ। বিয়ের দিন কমিউনিটি সেন্টার বা পাত্রীর বাড়িতে বিয়ের সামাজিকতা বা আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়। অর্থাৎ সেখানে পাত্র-পাত্রী উভয়কে কিছু মন্ত্র পাঠের পর সদুপদেশ দেয়া হয় তাদের ভবিষ্যৎ সুখী-সমৃদ্ধ দাম্পত্য জীবনের জন্য। তবে এখানে কাবিন জাতীয় কোন প্রকার শর্তারোপ থাকে না।
ইসলাম ধর্মে বিয়ে:
মুসলিম আইন উৎসগত দিক থেকে কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াস নির্ভর। শরীয়া আইন থেকেই বিয়ে সংক্রান্ত বিধানসমূহ অনুসৃত হয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মে বিয়ে একটি আইনগত, সামাজিক ও ধর্মীয় মর্যাদা রয়েছে। ছেলে ও মেয়ের একসাথে জীবন-যাপন ও সংসার ধর্ম পালনকে আইনগত, ধর্মীয় ও সামাজিক সুরক্ষা দিতেই বিবাহ প্রথার জন্ম। মুসলিম আইন অনুযায়ী বিয়ে হলো দেওয়ানী চুক্তি। এখানে খুব বেশি আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয় না। অন্যান্য চুক্তির মতই এতে দুটি পক্ষ থাকে। সাক্ষীদের উপস্থিতিতে একপক্ষ বিয়ের প্রস্তাব করলে এবং অন্যপক্ষ তা গ্রহণ করলে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়। মুসলিম বিয়েতে মহর বাধ্যতামূলক, আর বিয়ের পর ছেলের বাড়িতে অলিমা (বৌভাতের আয়োজন) করা সুন্নত।
মানুষ যখন বৈধ সম্পর্ক তথা বিয়েতে আবদ্য না হয়ে সাধারণভাবে যৌন চাহিদা পূরণ করে থাকে। এমন যৌনাচারকে ব্যভিচার বলা হয়। ব্যভিচার এমন এক ধ্বংসাত্মক কলুষতা যা মানুষকে সবদিক দিয়ে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি যে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন ছিলো তা বিবেকবান ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করবেন। শুধু প্রতিরোধ করাই যথেষ্ট নয়, যেমন খ্রীষ্টান ও অন্য জাতিসমূহ তার পরিণামফল ভোগ করছে-বরং তার জন্য প্রয়োজন ছিলো এক স্বতন্ত্র আইন-কানুন ও বিধি-বিধান। ইসলাম তাই করেছে। সে মানুষের প্রকৃতি পরখ করেছে এবং সেই মুতাবিক চিকিৎসা ও সতর্কতার তাকীদ দিয়েছে। ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মতো বাড়াবাড়ির পথ অবলম্বন করেনি, বরং মানব-প্রকৃতির প্রতি লক্ষ্য করে ভারসাম্যের পন্থা পছন্দ করেছে।
বিবাহের নির্দেশ ঃ
ব্যভিচারের অপকারিতা বর্ণনা করার পর আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, পুরুষ ও নারী যারই বিয়ের প্রয়োজন দেখা দেবে, সে-ই অবশ্যম্ভাবীরূপে বিয়ে করবে। কেননা, বিয়েই হচ্ছে যৌন পবিত্রতা সংরক্ষণ ও যৌন ক্ষুধা নিবারণের সবচেয়ে বড় উপায় ও মাধ্যম। তাই আল্লাহ রব্বুল ইযযত বিয়ের নির্দেশ দিতে গিয়ে বলেছেন ঃ ‘তোমাদের মধ্যে যারা জুড়িহীন, তাদের বিয়ে করিয়ে দাও এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা উপযুক্ত তাদেরও।’ (সূরা নূর ঃ ৩২)
আল্লাহ তা‘আলা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের তাকীদ দান করেছেন এবং যে-সব নারী-পুরুষের বিয়ে করা প্রয়োজন, তাদের সবাইকে বিয়ে করানোর নির্দেশ দিয়েছেন। আর এ দায়িত্ব আল্লাহ অর্পণ করেছেন গোটা জাতির ওপর, যাতে তারা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে। এ ব্যবস্থার দ্বারা আল্লাহ পাক এটাই বুঝাতে চান যে, বিয়ে-শাদীর দরুন যে উপকার লাভ হয়, গোটা জাতি তার দ্বারা উপকৃত হয়। আর বিয়ে না করার দরুন যে ক্ষতি সাধিত হয়, তাও গোটা জাতিকেই বহন করতে হয়। বস্তুত বৈধ বিবাহ প্রথা রহিত করে দিলে গোটা জাতীয় চরিত্রই যে তাতে পুঁতিগন্ধময় হয়ে উঠবে, কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তিই তা অস্বীকার করতে পারবেন না। উক্ত আয়াতের পরবর্তী অংশে আল্লাহ পাক আরো বলেছেন যে, কোনো কল্পিত আশঙ্কাকে অজুহাত হিসাবে দাঁড় করিয়ে এই শুভ পরিণয় থেকে বিরত থাকা অবাঞ্ছনীয়।
যা হোক, উক্ত আয়াত থেকে এ কথা পরিষ্কারভাবেই জানা গেলো যে, যে নারী কিংবা পুরুষ বিয়ের যোগ্য হবে, তাকে বিয়ে করাতে হবে। আর বিয়ে করানোর এ দায়িত্ব অর্পিত হবে যুগপৎ অভিভাবক ও রাষ্ট্রের ওপর। এ দুয়ের কেউই এ দায়িত্ব এড়াতে পারবে না।
ফিকাহবিদদের দৃষ্টিতে বিয়ে ঃ
কোনো কোনো আলিমের মতে, বিয়ে করা ওয়াজিব। অবশ্য তার সপক্ষে হাদীসেরও সমর্থন রয়েছে। ফিকাহবিদগণ লিখেছেন, যৌন তাকীদ যখন সহ্যসীমা অতিক্রম করে যায় এবং শরঈ সীমা ভেঙে ফেলার আশঙ্কা দেখা দেয়, অর্থাৎ উক্ত দুর্ঘটনায় লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবলতর হয়ে ওঠে, তখন মুমিন লোকের পক্ষে বিয়ে করা ওয়াজিব হয়ে যায়। কিন্তু যৌন তাড়না যদি সীমাতিক্রম না করে, তাহলে সেমতাবস্থায় বিয়ে সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। পক্ষান্তরে, স্ত্রীর হক আদায় করতে না পারার ধারণা যদি প্রবলতর হয়, তাহলে সেমতাবস্থায় বিয়ের ফাঁদে নিজকে জড়ানো শরীয়তের দৃষ্টিতে অপছন্দনীয় অর্থাৎ মাকরূহ। বরং স্ত্রীর হক আদায় করতে না পারার ব্যাপারে যে- ব্যক্তি স্থির নিশ্চিত, তার পক্ষে বিয়ে করা হারাম।
বিয়েতে শ্লীলতা রক্ষা ঃ
উপরিউক্ত কুরআনী নির্দেশ ছাড়া বিয়ের তাকীদ সম্বন্ধে হাদীসেরও বিরাট ভাণ্ডার বিদ্যমান। তাতে প্রতীয়মান হয় যে, বিবাহকারী যখন বিয়ের প্রয়োজন অনুভব করবে, তখন নিজের উদ্যোগেই তার বিয়ে করা আবশ্যক। রাসূলে আকরাম (সা) বলেছেন ঃ ‘হে যুব সমাজ! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ রাখে, সে যেনো বিয়ে করে নেয়। কেননা, বিয়ে দৃষ্টিকে অধিকতর আনত এবং যৌনাঙ্গকে অধিকতর সংযত রাখে।’ (বুখারী, বিবাহ অধ্যায়)
এ হাদীসে যেখানে যুবকদের বিয়ে করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেখানে বিয়ের উপকারিতাও বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিয়ের দ্বারা যৌন পবিত্রতা সৃষ্টি হবে এবং মানুষ ব্যভিচার থেকে রেহাই পাবে। হাদীসে যদিও যুবকদেরই সম্বোধন করা হয়েছে, তবু যৌন তাকীদ যার শিথিল ও নিস্তেজ হয়ে যায়নি, সে যদি যুবক না-ও হয়ে থাকে, তারও বিয়ে করা কর্তব্য।
অন্য এক হাদীসে রাসূলে আকরাম (সা) বলেছেন ঃ ‘তোমরা অধিক সন্তান প্রসবকারী স্ত্রীলোককে বিয়ে করো এবং বংশ বৃদ্ধি করো। কেননা, কিয়ামতের দিন তোমাদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে আমি অন্যান্য উম্মতের ওপর গর্ব করবো।’ (ইবনে কাছীর, তৃতীয় খণ্ড, ৩৮৩ পৃষ্ঠা)
এ হাদীসে বিয়েরও নির্দেশ দান করা হয়েছে, আর বিয়ের উদ্দেশ্যও বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সন্তান উৎপাদন ও মানব জাতির বংশরক্ষাই হচ্ছে বিয়ের মৌল উদ্দেশ্য। বিয়ের দরুন জাতির লোকসংখ্যা অধিক থেকে অধিকতর হয়। মিশকাত শরীফের একটি হাদীসে নিম্নোক্ত শব্দসমূহ উদ্ধৃত হয়েছে ঃ ‘তোমরা অধিক পতিপরায়ণা ও অধিক সন্তান প্রসবিনী নারীকে বিয়ে করো। কেননা, তোমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আমি অন্য উম্মতদের ওপর জয়ী হবো।’ (মিশকাত ঃ কিতাবুন নিকাহ) এ হাদীসে বংশবৃদ্ধির সাথে সাথে এ-ও বর্ণিত হয়েছে যে, পতিপরায়ণা স্ত্রীই ইপ্সিত ও আকাঙ্খিত। সমাজ জীবনকে সুখময় করার এ-ই হচ্ছে একমাত্র উপায়। স্বামী-স্ত্রীর প্রেম-ভালবাসার মধ্যেই গোটা পরিবারের সুখ-শান্তি নিহিত।
বিয়ে ও যৌন পবিত্রতা ঃ
এক হাদীসে রাসূলে আকরাম (সা.) বলেন ঃ বিয়ে করলে মানুষ বহু রকম অনিষ্ট থেকে বেঁচে যায়। বরং কেউ যদি স্বীয় কাম-প্রবৃত্তির আঁচল নিষ্কলুষ ও পবিত্র রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় হতে চায়, তবে এটাই তার একমাত্র পথ। ‘আল্লাহর সাথে যে পাক-পবিত্র অবস্থায় মিলিত হতে চায়, তার ভদ্র মহিলাদের বিয়ে করা উচিত।’ (মিশকাত, বিবাহ অধ্যায়)
বিয়ের দরুন যৌন পবিত্রতা ও পুণ্যশীলতা হাসিল হয়। বরং বিয়ে করলে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অন্যান্য পাপ থেকে মুক্ত রাখেন। অর্থাৎ বিয়ে হচ্ছে বিবাহকারীর জন্য হিদায়েত ও নাজাতের ওয়াসীলা স্বরূপ।
বাস্তবেও দেখা যায়, যে ব্যক্তি বিয়ে করে না এবং বৈধভাবে যৌন চাহিদা পূরণ করে না, সে সাধারণত বহু পাপ-কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তা ইচ্ছায়ই হোক আর অনিচ্ছায়ই হোক। কিন্তু বিবাহিত ব্যক্তির নিকট যেহেতু আত্মরক্ষার উপকরণ বিদ্যমান, সেহেতু সাধারণত ওই সব পাপকার্য থেকে তার সম্পর্ক স্বতঃই ছিন্ন হয়ে যায়। পক্ষান্তরে যারা বিয়েও করে না অথচ নিষ্কলুষ জীবন যাপন করতে আগ্রহী, তারা অহেতুক টানা-হেঁচড়ার জীবন নির্বাহ করে থাকে। তারা কখন কি করে বসবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
অপর এক হাদীসে বিয়েকে দ্বীনের অর্ধেক বলা হয়েছে। নবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘বান্দাহ যখন বিয়ে করলো, তখন সে দ্বীনের অর্ধেক পূর্ণ করলো। (মিশকাত, বিবাহ অধ্যায়)
একটু চিন্তা করলে সহজেই বুঝা যায় যে, কাম প্রবৃত্তির সাথেই পাপের বিরাট অংশ জড়িত। শরঈ এবং আইনগত গন্ডিতে নিজকে আবদ্ধ করার পর বাহ্যিক আচারের ক্ষেত্রে পথভ্রষ্টতার আশঙ্কা কমে যায়।
বিয়ে রাসূলদের সুন্নত ঃ
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) বলেন, ‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, তুমি কি বিয়ে করেছ? আমি জওয়াব দিলাম, না। তিনি বললেন ঃ বিয়ে করো, কেননা, যিনি এই উম্মতের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি, তাঁর অধিক সংখ্যক স্ত্রী ছিলেন। অর্থাৎ নবী করীম (সাঃ) অধিক সংখ্যক বিবাহ করেছেন।
(জামেউল ফাওয়ায়িদ, বিবাহ অধ্যায়, বুখারী) তাছাড়া, এ-ও সর্বসম্মত কথা যে, বিয়ে করা ছিলো সকল নবী- রাসূলের সুন্নত ও রীতি এবং প্রায় সমস্ত রাসূলই স্ত্রী-পুত্র-পরিজন নিয়ে সংসার জীবন যাপন করেছেন। আল্লাহ পাক বলেন ঃ ‘আর নির্ঘাত আপনার পূর্বেও আমি অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি এবং তাঁদেরকে স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করেছি।’ (সূরা রাদ ঃ ৩৮)
রাসূলের দৃষ্টিতে অবিবাহিত ব্যক্তি ঃ
একবার নবী করীম (সাঃ) বললেন ঃ ‘যার স্ত্রী নেই, সে মিসকীন।’ সাহাবা কিরাম আরয করলেন ঃ সে ব্যক্তি মালদার হলেও? তিনি বললেন ঃ ‘হ্যাঁ, সে ব্যক্তি মালদার হলেও (যদি তার স্ত্রী না থাকে, তবে সে মিসকীন)’। অতঃপর নবী করীম (সাঃ) বললেন ঃ ‘যে স্ত্রীলোকের স্বামী নেই, সেও মিসকীন।’ লোকেরা জিজ্ঞাসা করলো ঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! তার নিকট যদি অঢেল সম্পদ থাকে, তবুও সে মিসকীন? তিনি বললেন ঃ ‘হ্যাঁ তবু সে মিসকীন।’ (জামউল ফাওয়ায়িদ, বিবাহ অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃঃ ২১৬)। এরূপ আরো বিশটি হাদীসে বিয়ের প্রতি স্পষ্ট উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
রাসূলের দৃষ্টিতে বৈরাগ্যবাদ ঃ
এ কারণেই রাসূলে করীম (সাঃ) যখন জানতে পারলেন যে, কোনো কোনো লোক বিয়ে না করাকে উত্তম কাজ বলে মনে করছে, তখন তাদেরকে তিনি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিয়ে করতে উদ্বুদ্ধ করেন।
হাদীস শরীফে উসমান ইবনে মাযউন (রা)-এর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তিনি একাগ্রচিত্তে দিনরাত আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হওয়ার জন্য নারী সংস্রব পরিত্যাগ করেন এবং যৌন-যাতনা থেকে চির মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে অণ্ডকোষ কর্তন করে নপুংসক হয়ে যাওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করেন। নবী করীম (সাঃ) এ খবর জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে তার এই মনোভাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরিশেষে হযরত উসমান ইবনে মাযউন (রাঃ) তাঁর এই সংকল্প প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। (মিশকাত শরীফ, বিবাহ অধ্যায়)
এক হাদীসে উক্ত হয়েছে, একদা তিন ব্যক্তি নবী করীম (সা.)-এর দওলতখানায় এসে নবী সহধর্মিণীদের কাছে তাঁর ইবাদত সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে মন্তব্য করলেন, কোথায় আল্লাহর রাসূল, যার সমস্ত গুনাহ-খাতা আল্লাহ পাক মাফ করে দিয়েছেন আর কোথায় আমরা যারা আপাদমস্তক গুনাহর সাগরে ডুবে আছি! অতঃপর একজন বললেন, আমি সারারাত নামায পড়বো। দ্বিতীয় জন বললেন, আমি দিনে সর্বদা রোযা রাখবো। তৃতীয় জন বললেন, আমি নারী সং¯্রব পরিত্যাগ করবো, কখনো বিয়ে-শাদী করবো না। রাসূল (সাঃ) এ ঘটনা অবগত হয়ে বললেন, ‘তোমরা কি এরূপ কথা বলাবলি করেছ?’ অতঃপর বললেন ঃ ‘শোনো, আল্লাহর কসম, আমি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মুত্তাকী। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি রোযাও রাখি, ইফতারও করি। নামাযও পড়ি, আবার নিদ্রাও যাই। বিয়ে-শাদীও করি, স্ত্রীর কাছেও যাই। সুতরাং যে-ই আমার তরীকা থেকে বিমুখ থাকবে, সে আমার দলভুক্ত নয়। (বুখারী শরীফ)
হযরত আবু যর (রা) বর্ণনা করেন ঃ একদা উকাফ ইবন বিশর তামীমী রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূলের দরবারে উপস্থিত হন। রাসূল (সাঃ) তাকে শুধালেন ঃ ‘উকাফ, তোমার স্ত্রী আছে?’ হযরত উকাফ জওয়াব দিলেন ঃ না। রাসূল জিজ্ঞেস করলেন ঃ ক্রীতদাসী? উকাফ বললেন ঃ তাও না। এই উত্তর শুনে রাসূল বললেন ঃ তুমি যদি সক্ষম ও সচ্ছল হয়েও বিয়ে ত্যাগ করো, তবে তুমি শয়তানের ভাই। অতঃপর রাসূল (সাঃ) তাকে বিয়ে করিয়ে দিলেন। (আহমদ)
কোনো কোনো রিওয়ায়াত থেকে জানা যায় যে, কারো আর্থিক অসচ্ছলতা যদি তাকে বৈবাহিক দায়িত্ব গ্রহণের অনুমতি না দেয়, তবে তাতে সিয়াম পালন করে কামভাব নিস্তেজ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকল মুসলমানকে ইসলামী জিন্দেগী অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার তাওফীক দান করুন।