প্রিয় পাঠক ও পাঠিকা! আমরা দীর্ঘ এগার মাস প্রতীক্ষার পর পবিত্র মাহে রমযানের রহমত ও বরকত এবং কল্যাণ লাভ করার সুযোগ পেয়েছি। সেই জন্য শুকরিয়া আদায় করছি আলহামদুলিল্লাহ। সেই বরকতের মাস দ্রুত কিভাবে শেষ হয়ে গেলো অনুমানও করতে পারলাম না। যারা এ মাসে পুরো রোযাগুলো রাখার সুযোগ পেয়েছি, সবই আল্লাহর অনুগ্রহ। আর যারা বিনা কারণে অবহেলা করে রোযা রাখেনি, তারা আল্লাহর সমূহ কল্যাণ হতে বঞ্চিত হয়েছে, সে কথা রাসূলে কারীম (সা.) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেগেছেন।
এখন আমরা বক্ষমান প্রবন্ধে ঈদের পর কিভাবে চলবো সেই দিকে ইঙ্গিত করবো ইনশা আল্লাহ।
কয়েকটি বিষয় চিন্তা করলে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এর থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করবেন।
প্রথম ধাপ: আমরা রমযান থেকে কী উপার্জন করলাম?
আমরা কি রমযানের সুশোভিত দিন ও আনন্দমুখর রাতগুলোকে বিদায় জানাচ্ছি?! আমরা কি কুরআনের মাস, তাকওয়ার মাস, ধৈর্যের মাস, জিহাদ, রহমত, মাগফেরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাসকে বিদায় জানাচ্ছি?!
এখানে আমাদের একটি বিষয় খুব ভাল করে জেনে রাখা প্রয়োজন যে, উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো শুধু রমযানের সঙ্গে খাস নয়, বরং প্রত্যেক দিন, প্রতিটি সময়ই আল্লাহর রহমত ও মাগফেরাত পাওয়া যেতে পারে। প্রতিটি মুহূর্তেই তাকওয়া অর্জন ও কুরআনের আদর্শে আদর্শবান হওয়া প্রয়োজন। তবে রমযান মাসে নেকির পরিমাণ খুব বৃদ্ধি করা হয়, নেকি ও ইবাদতের সংখ্যা এতে বেড়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَرَبُّكَ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَيَخْتَارُ ۗ القصص: ٦٨
“তোমার রব যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন এবং যা ইচ্ছা নিজের জন্য তিনি মনোনীত করেন।” (সূরা আল-কাসাস: ৬৭)
আমরা কি তাকওয়া বাস্তবায়ন করেছি এবং মুত্তাকীর সার্টিফিকেট নিয়ে রমযানকে বিদায় জানাচ্ছি?!
আমরা কি রমযানে সব ধরনের ইবাদাতের ওপর নিজেদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি?! আমরা কি আমাদের নফস ও প্রবৃত্তির সঙ্গে জিহাদ করে তাদের উপর জয়ী হতে পেরেছি, না পূর্বের বদভ্যাস এখনো আমাদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে? আমরা কি রহমত, মাগফেরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস পেয়ে আমলের দিকে অগ্রগামী হতে পেরেছি? আমরা কি পেরেছি? পেরেছি আমরা?
এ রকম অনেক অনেক প্রশ্ন ও ভাবনা প্রত্যেক মুসলিমের অন্তরে উঁকি দেয় এবং সে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে: আমি রমযান থেকে কি উপকৃত হলাম?!
নিশ্চয় রমযান একটি রূহানী বিদ্যালয়। পরবর্তী বছরের জন্য সম্বল অর্জন করার বিদ্যাপীঠ, অবশিষ্ট জীবনের জন্য প্রেরণা সঞ্চয় করার শিক্ষাকেন্দ্র। যখন সে এ বিষয় নিয়ে চিন্তা করবে, ভাববে, তখন সে উপকৃত হবে, নিজের জীবনে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে, এবং এ চেষ্টা আমাদেরকেই করতে হবে, মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
إِنَّ اللَّـهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ ۗ الرعد: ١١
“আল্লাহ কোনো জাতির পরিবর্তন ঘটান না, যতক্ষণ না তারা তাদের নিজের পরিবর্তন ঘটায়।” (সূরা আর-রাদ: ১১)
দ্বিতীয় ধাপ: সে নারীর মত হয়ো না, যে শক্ত করে সূতো পাকানোর পর তা টুকরো টুকরো করে ফেলে
প্রিয় পাঠক ও পাঠিকা,
আপনি যদি রমযানে তাকওয়া অর্জন করে থাকেন এবং যথাযথভাবে রমযানের হক আদায়কারী একজন ভাগ্যবান হয়ে থাকেন, তবে আপনি সে নারীর মত হবেন না, যে সূতো মজবুত করে পাকানোর পর তা টুকরো টুকরো করে ফেলে। আপনি আপনার এ অর্জন ভূলুণ্ঠিত করবেন না। যে রমযানের পর গুনাহে ফিরে গেল সে ঐ নারীর মত, যে কাপড় বুনে তা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলল। নিশ্চয় হতাভাগা তারা, যারা রমযান ছাড়া আল্লাহকে চেনে না।
প্রিয় পাঠক! রমযানের ওয়াদা ভঙ্গের অনেক আলামত রয়েছে। উদাহরণত:
১. রমযানের পর প্রথম দিনেই জামাতের সঙ্গে সালাত ত্যাগ করা। রমযানে তারাবীর সালাতে মসজিদ ভরে যেত, অথচ তা ছিল সুন্নাত। এখন ফরয সালাতের সময় লক্ষ্য করছি লোকজন মসজিদে আসা ত্যাগ করে দিয়েছে, অথচ ফরয নামায জামায়াতের সাথে পড়া ওয়াজিব।
২. গান-বাদ্য, অশ্লীল ছবি ও নগ্ন দেহে ঘর থেকে বের হওয়া এবং নারী-পুরুষ এক সঙ্গে বিনোদন ও অশ্লীল স্পটে জমায়েত হওয়া ইত্যাদি।
৩. অনেকে আবার শুধু গুনাহ করার জন্য টুরিস্ট ভিসা সংগ্রহ করে। বিভিন্ন অমুসলিম দেশে সফর করে। এভাবেই কি আমরা আল্লাহর নি‘আমতের শুকরিয়া আদায় করব? এটা কি আল্লাহর নি‘আমতের সঙ্গে অকৃতজ্ঞতা নয়? এটা কি আমল কবুল হওয়ার আলামত?
না, এটা আমল কবুল হওয়ার আলামত নয়। আমল কবুল হওয়ার আলামত হল, বান্দার অবস্থা আগের চেয়ে ভাল হয়ে যাবে। সে আগের তুলনায় আরো বেশি কল্যাণমূলক কাজে আগ্রহী হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِن شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ ۖ ابراهيم: ٧
“স্মরণ কর যখন, তোমাদের রব ঘোষণা দিয়েছেন যে, যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তাহলে অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য নেয়ামত বৃদ্ধি করে দেব।” (সূরা ইবরাহীম: ৭ )
তৃতীয় ধাপ: মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত করা
বান্দার উপর ওয়াজিব সবসময় ও সব জায়গায় আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন থাকা। কী রমযান কী গায়রে রমযান সব সময় তাঁর ইবাদত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَن تَابَ مَعَكَ هود: ١١٢
“ তোমাকে যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তুমি সেভাবে অটল থাক এবং তোমার সঙ্গে যারা তাওবা করেছে।” (সূরা হুদ: ১১২)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
قُلْ: آمَنْتُ بِاللَّهِ، ثُمَّ اسْتَقِمْ
“বল, আমি আল্লাহ ওপর ঈমান এনেছি। অতঃপর তুমি অটল থাক”। (সহীহ মুসলিম হাদীস: ৩৮)
যদি আমাদের থেকে রমযানের সাওম বিদায় নেয়, তবুও আমাদের সামনে অন্যান্য সাওম বিদ্যমান রয়েছে। যেমন শাওয়ালের সাওম, সোম ও বৃহস্পতিবারের সাওম এবং প্রতি মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের সাওম, আশুরা ও আরাফা ইত্যাদির সাওম।
আরো অনেক কল্যাণমূলক কাজ রয়েছে, যা রমযানের সঙ্গে খাস নয়, যেমন ফরয যাকাত, নফল সদাকাহ, জিহাদ, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি।
এভাবে প্রতিটি দিন ও প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর ইবাদতে অটল থাকা। আর এভাবেই আল্লাহর সাক্ষাত প্রত্যাশা করা। আমরা বলতে পারি না, কখন আমাদের মৃত্যু চলে আসে।
পরিশেষে বলতে চাই, আসুন আমরা রমযান মাসের মত সারা বছর বিভিন্ন ভালো কাজ করে অতিবাহিত করি। গুনাহের কাজ থেকে দূর থাকার চেষ্টা করি, কখনো ভুলবশত পাপ হয়েগেলে সঙ্গে সঙ্গে বিলম্ব না করে তাওবা করি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন। আমীন