ইসলামিক অনলাইন মিডিয়া
ঈদ হচ্ছে মুসলমানদের আত্মার পরিশুদ্ধি, মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি মার্জিত উৎসব। তবে দুঃখের ব্যাপার হল আমরা অনেকেই এ দিনটিকে যথার্থভাবে পালন করতে ব্যর্থ হই। নানাবিধ ইসলাম বহির্ভূত কাজে লিপ্ত হয়ে হারিয়ে ফেলি ঈদের মাহাত্ম্য, পাশ্চত্য সংস্কৃতির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতে আনন্দ অনুভব করি। ঈদের মূলভাব ও দর্শন থেকে আমরা চলে যাই দূরে, বহু দূরে। এ ধরনের আচরণ থেকে বেঁচে থাকা প্রতিটি মুসলমানেরই জরুরি। নিম্নে ঈদে অবশ্য বর্জনীয় কয়েকটি আচরণ তুলে ধরা হল।
১) বিজাতীয় আচরণ প্রদর্শন
মুসলিম সমাজে এ ব্যাধি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পোশাক-পরিচ্ছদে, চাল-চলনে, শুভেচ্ছা বিনিময়ে অমুসলিমদের অন্ধ অনুকরণে লিপ্ত হয়ে পড়েছে মুসলমানদের অনেকেই। এর মাধ্যমে একদিকে তারা সাংস্কৃতিক দৈন্যতার পরিচয় দিচ্ছে অপর দিকে নিজেদের তাহজিব-তামাদ্দুনের প্রতি প্রকাশ করছে অবজ্ঞা-অনীহা। এ ধরনের আচরণ ইসলামী শরিয়তে নিষিদ্ধ। হাদীসে এসেছে
আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সা-দৃশ্যতা রাখবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে। (আবু দাউদ)
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, এ হাদীসের বাহ্যিক অর্থ হল, যে কাফেরদের সাথে সাদৃশ্যতা রাখবে সে কাফের হয়ে যাবে। যদি এ বাহ্যিক অর্থ (কুফরির হুকুম) আমরা না ও ধরি তবুও কমপক্ষে এ কাজটি যে হারাম তাতে সন্দেহ নেই।
২) পুরুষ কর্তৃক নারীর বেশ ধারণ ও নারী কর্তৃক পুরুষের বেশ ধারণ
পোশাক-পরিচছদ, চাল-চলন ও সাজ-সজ্জার ক্ষেত্রে পুরুষের নারীর বেশ ধারণ ও নারীর পুরুষের বেশ ধারণ হারাম। ঈদের দিনে এ কাজটি অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। হাদীসে এসেছে
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত: রাসূলে করিম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষের বেশ ধারণকারী নারী ও নারীর বেশ ধারণকারী পুরুষকে অভিসম্পাত করেছেন।
( আবু দাউদ)
৩) ঈদের দিনে কবর জিয়ারত করা কে সুন্নাত মনে করা
কবর জিয়ারত করা শরিয়ত সমর্থিত একটি নেক আমল। হাদীসে এসেছে
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে করিম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি তোমাদেরকে কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, হ্যাঁ এখন তোমরা কবর জিয়ারত করবে। কারণ কবর জিয়ারত হৃদয়কে কোমল করে, নয়নকে অশ্র“সিক্ত করে ও পরকালকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে তোমরা শোক ও বেদনা প্রকাশ করতে সেখানে কিছু বলবে না। (সহিহুল জামে,)
কিন্তু ঈদের দিনে কবর জিয়ারতকে অভ্যাসে পরিণত করা বা একটা প্রথা বানিয়ে নেয়া শরিয়ত সম্মত নয়। রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : তোমরা আমার কবরে ঈদ উদযাপন করবে না বা ঈদের স্থান বানাবে না…। (আবু দাউদ)
যদি ঈদের দিন কবর জিয়ারত করা হয় তবে কবরে ঈদ উদযাপন হয়েছে বলে গণ্য হবে। মনে রাখা প্রয়োজন যে ‘ঈদ’ মানে ‘যা বার বার আসে’। যদি বছরের কোন একটি দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করা হয় আর তা প্রতি বছর করা হয় তা হলে এটার নামই হবে কবরকে ঈদের উৎসব-সামগ্রী হিসেবে সাব্যস্ত করা। আর সেটা যদি সত্যিকার ঈদের দিনে হয় তবে তা আরো মারাত্মক বলে ধরে নেয়া যায়। যখন আল্লাহর রাসূলের কবরে ঈদ পালন নিষিদ্ধ তখন অন্যের কবরে ঈদ উদযাপন করার হুকুম কতখানি নিষিদ্ধের পর্যায়ে পড়তে পারে তা ভেবে দেখা উচতি।
৪) নারীদের খোলা-মেলা অবস্তায় রাস্তা-ঘাটে বের হওয়া
মনে রাখা প্রয়োজন যে খোলামেলা ও অশালীন পোশাকে রাস্তা-ঘাটে বের হওয়া ইসলামি শরিয়তে নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন :
‘আর তোমরা নিজ ঘরে অবস্তান করবে এবং প্রাচীন মূর্খতার যুগের মত নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে না।’ (সূরা আহযাব : ৩৩)
হাদীসে এসেছে: আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : জাহান্নাম বাসীর দু’ধরনের লোক যাদের আমি এখনও দেখতে পাইনি। একদল লোক যাদের সাথে গরুর লেজের ন্যায় চাবুক থাকবে, তা দিয়ে তারা লোকজনকে প্রহার করবে। আর এক দল এমন নারী যারা পোশাক পরিধান করেও উলঙ্গ মানুষের মত হবে, অন্যদের আকর্ষণ করবে ও অন্যেরা তাদের প্রতি আকৃষ্ট হবে, তাদের মাথার চুলের অবস্থা উটের হেলে পড়া কুঁজের ন্যায়। ওরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি তার সুগন্ধিও পাবে না, যদিও তার সুগন্ধি বহু দূর থেকে পাওয়া যায়। ( মুসলিম)
৫) নারী পুরুষ পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ করা:
দেখা যায় অন্যান্য সময়ের চেয়ে এই গুনাহের কাজটা ঈদের দিনে বেশি করা হয়। নিকট আত্মীয়দের মাঝে যাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ শরিয়ত অনুমোদিত নয়, তাদের সাথে অবাধে দেখা-সাক্ষাৎ করা হয়।
হাদীসে এসেছে : উকবাহ ইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে করিম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : তোমরা মহিলাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখবে। মদিনার আনসারদের মধ্য থেকে এক লোক প্রশ্ন করল হে আল্লাহর রাসূল ! দেবর-ভাসুর প্রমুখ আত্মীয়দের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? তিনি উত্তরে বললেন : এ ধরনের আত্মীয়-স্বজন তো মৃত্যু। ( মুসলিম)
এ হাদীসে আরবি ‘الحمو’ (হামু) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ এমন সকল আত্মীয় যারা স্বামীর সম্পর্কের দিক দিয়ে নিকটতম। যেমন স্বামীর ভাই, তার মামা, খালু প্রমুখ। তাদেরকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করার কারণ হল এ সকল আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমেই বে-পরদাজনিত বিপদ আপদ বেশি ঘটে থাকে। যেমনটি অপরিচিত পুরুষদের বেলায় কম ঘটে।
৬) গান-বাজনা করা
ঈদের দিনে এ গুনাহের কাজটাও বেশি হতে দেখা যায়। গান ও বাদ্যযন্ত্র যে শরিয়তে নিষিদ্ধ এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আর তা যদি হয় অশ্লীল গান তাহলে তো তা হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোন ভিন্নমত নেই। হাদীসে এসেছে
রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : আমার উম্মতের মাঝে এমন একটা দল পাওয়া যাবে যারা ব্যভিচার, রেশমি পোশাক, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল (বৈধ) মনে করবে। (বোখারি)
এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় গান-বাদ্য নিষিদ্ধ। কারণ হাদীসে বলা হয়েছে ‘তারা হালাল মনে করবে’। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় মূলত এটা হারাম।
ইসলামি শরিয়ত কিছু কিছু পর্বে বিনোদনের অনুমতি দিয়েছে। তাই অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম নিুোক্ত কয়েকটি সময়ে দফ (একদিকে খোলা ঢোল জাতীয় বাদ্য) বাজানোকে জায়েজ বলেছেন
(ক) বিবাহের অনুষ্ঠানে : হাদীসে এসেছে
রাবী বিনতে মুয়াওয়াজ রা. বর্ণনা করেন : যখন আমার বিবাহের অনুষ্ঠান হচ্ছিল তখন রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এসে আমার বিছানায় এমনভাবে বসলেন যেমন তুমি বসেছ। তখন কয়েকজন বালিকা দফ বাজাচ্ছিল ও আমাদের পূর্ব-পুরুষদের মাঝে যারা বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন তাদের প্রশংসামূলক সংগীত গাচ্ছিল। এ সংগীতের মাঝে এক বালিকা বলে উঠল। ‘আমাদের মাঝে এমন এক নবী আছেন যিনি জানেন আগামী কাল কি হবে।’ তখন আল্লাহর রাসূল বললেন : ‘এ কথা বাদ দাও এবং যা বলছিলে তা বল।’ (বোখারি)
(খ) ঈদের সময়ে : হাদীসে এসেছে
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, একদিন আবু বকর রা. আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন দু’জন আনসারী বালিকা বুয়াছ যুদ্ধে তাদের বীরত্ব সম্পর্কিত গান গাচ্ছিল, কিন্তু তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না। আবু বকর রা. বললেন : ‘আশ্চর্য! আল্লাহর রাসূলের ঘরে শয়তানের বাদ্য !’ এদিনটি ছিল ঈদের দিন। আবু বকর রা. এর একথা শুনে রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : ‘হে আবু বকর ! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এদিন হল আমাদের ঈদ। ( বুখারি)