Main Menu

কারবালার শহীদ : কারণ ও শিক্ষা

composition_aster-yellow2-150x150

ইয়াজিদ হচ্ছে আবু সুফিয়ান রা:-এর বংশধর। আবু সুফিয়ান রা: ছিলেন মক্কার কাফেরদের একজন প্রভাবশালী নেতা। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইয়াজিদ হজরত মুয়াবিয়া রা:-এর ছেলে। মুয়াবিয়া হজরত ওমর রা:-এর শাসনকাল থেকে দামেস্ক শহরের আমির তথা প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন। ইয়াজিদ ২৫-২৬ হিজরির দিকে জন্মগ্রহণ করে প্রায় ৩৫ বছর বয়সে মতাসীন হয়।
ইয়াজিদের ক্ষমতা লাভ: হজরত মুয়াবিয়া রা: বৃদ্ধ বয়সে তার একজন গভর্নর যার নাম মুগিরা এবং ইয়াজিদের চালাকির শিকার হয়ে ইয়াজিদকে দামেস্ক তথা ইসলামী রাষ্ট্রের (মক্কা মদিনা পর্যন্ত যা অন্তর্ভুক্ত ছিল) প্রধান করে যান। হজরত মুয়াবিয়া রা:-এর মৃত্যুর পর ইয়াজিদ মতাসীন হলে, যে মারওয়ান মদিনার গভর্নর ছিল, হজরত ওসমান রা: ও ইমাম হাসানকে রা: শহীদ করার ব্যাপারে যার হাত এবং গভীর চক্রান্ত ছিল, তাকে নিজের সহকারী করে দামেস্ক নিয়ে যান। মারওয়ান আল্লাহর নবী সা: কর্তৃক অভিশপ্ত হাকামের পুত্র, মুনাফিক ও ইহুদিদের চর ছিল। তার চক্রান্তের কারণেই মুনাফিকদের সহযোগিতায় কিছু মুসলমান বিভ্রান্ত ও বিদ্রোহী হয়ে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান রা:-কে কুরআন তেলাওয়াতরত অবস্থায় শহীদ করে। মদিনায় এই মারওয়ান, কুফায় মুগিরা বিন শুবা এবং বসরায় আবদুল্লাহ জেয়াদই ইয়াজিদের মতা দখল এবং মতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কুটিল ও ন্যক্কারজনক ভূমিকা রাখে।
ইয়াজিদের লোভ ও চরিত্র : ইয়াজিদের চরিত্র ইসলামসম্মত ছিল না। তার চরিত্রে মদ্যপান, নামাজ তরক করা, নাচ-গান এবং নারী কেলেঙ্কারিতে লিপ্ত হওয়ার কলঙ্ক লেগে আছে। এ ব্যাপারে সমর্থন পাওয়া যায় মুফতিয়ে আজম শফি সাহেব, কাজি আমিনুল মির্জাপুরী, মাওলানা আবুল হাসানাত আবদুল হাই লাকনৌভী, মাওলানা আবদুল হক মুহাদ্দেছ দেহলবি ও আল্লামা শাইখুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়াসহ বিভিন্ন আলেমের লিখিত বইতে। কোনো রাজা বাদশাহর ছেলের চরিত্রে যদি এত সব অনৈতিকতা থাকে তাহলে তার স্বভাবে মতার লোভ থাকা এবং মতার জন্য চক্রান্তে লিপ্ত হওয়া স্বাভাবিক। ইতিহাস থেকে সে প্রমাণই পাওয়া যায়। ইয়াজিদের অবস্থাও তাই।
নবীবংশের সাথে দুশমনি: ইয়াজিদকে যখন মতাসীন করা হচ্ছিল তখন মদিনার গভর্নর মারওয়ানের চক্রান্তে কুটনি বুড়ির সহযোগিতায় বিষ খাইয়ে হজরত ইমাম হাসান রা:-কে শহীদ করা হয়। এরপর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যারা জিন্দা এবং ইয়াজিদের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার উপযুক্ত ছিলেন ইমাম হোসাইন রা:, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা:, আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর রা:, আবদুল্লাহ ইবনে জোবাইর রা: হচ্ছেন তাদের অন্যতম। ইমাম হোসাইন রা: ও ইমাম হাসান রা: প্রিয়নবী সা:-এর ঘনিষ্ঠজন হওয়ার কারণে তাদের প্রতিই ছিল মুসলিম উম্মাহর আকর্ষণ। তাই ইয়াজিদ অন্যদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করলেও হজরত হাসান ও হোসাইন রা:-কে প্রধান শত্র“ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করে। ইমাম হাসান রা: কে আগেই বিষ খাইয়ে শহীদ করে দেয়া হয়। ইমাম হোসাইন রা:-এর চাচাতো ভাই হজরত মুসলিম রা:-কে তার দুই ছেলেসহ ইয়াজিদ চক্র শহীদ করে দেয়। এরপর ইমাম হোসাইন রা:-কে চরিত্রহীন ইয়াজিদের বশীভূত অথবা দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেয়ার চক্রান্ত শুরু হয়। কারবালার যুদ্ধই হচ্ছে এর চূড়ান্ত রুপ।
কারবালায় নবীবংশ শহীদ : ইমাম হোসাইন রা: ইয়াজিদ চক্রের হোতা মারওয়ানের চক্রান্তের কারণে অস্থির হয়ে মদিনা থেকে হিজরত করে মক্কা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, কুফাবাসী তাঁকে কুফায় চলে আসার দাওয়াত দেন। তিনি কুফা যাওয়ার পথে ইয়াজিদ বাহিনী ফুরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে তার কাফেলাকে অবরোধ করে। তারা ইমাম হোসাইনকে জোর করে ইয়াজিদের অনুগত বানাতে চায়। যেহেতু ইয়াজিদ প্রিয়নবী সা: এবং চার খলিফার সুন্নত অনুযায়ী মতাসীন হয়নি এবং যার চরিত্রও কুৎসিত ও অনৈতিক, তাকে নিজের এবং মুসলিম রাষ্ট্রের নেতা হিসেবে মেনে নেয়া অন্যায় এবং নাজায়েজ বলে মনে করতেন ইমাম হোসাইন রা: । তাই কারবালা ময়দানে ৬১ হিজরি সনে মহররম মাসের ১০ তারিখ জুমাবার তাঁর সাথে ইয়াজিদ বাহিনীর সামনাসামনি যুদ্ধ হয়। সে সময় সব সাথী এবং পরিবার পরিজন সবাইকে ডেকে ইমাম হোসাইন রা: বললেন, ‘যত দুশমনি ইয়াজিদ ও ইয়াজিদ বাহিনীর, সব আমার সাথে। তোমাদের সাথে তাদের কোনো শত্র“তা নেই। তোমরা সবাই চলে যাও নিরাপদে। যা হওয়ার আমার সাথেই হবে।’ কেউ কিন্তু তাকে একা ছেড়ে যেতে রাজি হয়নি। তারা অবৈধভাবে ইসলামবর্জিত উপায়ে মতা দখলকারী চরিত্রহীন ইয়াজিদ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে রাসূল সা:-এর আদর্শে অটল থাকা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য শাহাদতবরণ করতে রাজি, ইমাম হোসাইন রা:-কে একা ছেড়ে যেতে রাজি নন। ইয়াজিদের বশ্যতা স্বীকার করতেও রাজি নন। অসুস্থ হজরত জয়নুল আবেদিন ছাড়া ইমাম পরিবারের ছোট শিশু হজরত আলী আসগর পর্যন্ত সে যুদ্ধে তীরের আঘাতে শাহাদতবরণ করেন। জালিম ইয়াজিদ বাহিনী ছোট শিশুটিকে এককাতরা পানি দিতে রাজি হয়নি। তারা ইমাম পরিবারে খাদ্য ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল যেন তারা ভাতে ও পানিতে কষ্ট পায়। শেষ পর্যন্ত ইয়াজিদ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার মতো আর কোনো পুরুষ সদস্য জিন্দা ছিল না। ইয়াজিদ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে পুরুষ সদস্যরা যখন সবাই শহীদ হয়ে যান, তখন প্রিয়নবী সা:-এর কলিজার টুকরা হজরত ইমাম হোসাইন রা: নানার আদর্শের মর্যাদা রার জন্য, ইয়াজিদি মতবাদের প্রতিবাদে, ইয়াজিদ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে ৬১ হিজরি সনের ১০ মহররম জুমাবার জোহরের শেষ সময়ে সিমারের হাতে শাহাদতবরণ করেন ।
কারবালা যুদ্ধের কারণ : প্রিয় রাসূল সা:-এর ইন্তেকালের পর সাহাবা আজমায়িনদের মতামতের ভিত্তিতে হজরত আবু বকর রা: খলিফা নির্বাচিত হন। কারণ আল্লাহর রাসূল সা: কাউকে মনোনীত করে যাননি। এরপর হজরত আবু বকর রা: সাহাবাদের পরামর্শ নিয়ে হজরত ওমর রা:-কে পরবর্তী খলিফা মনোনীত করেন। যিনি তার বংশের কেউ ছিলেন না। হজরত ওমর রা: পরবর্তী খলিফা মনোনয়নের জন্য ছয় সদস্যবিশিষ্ট পরিষদ গঠন করে দিয়েছিলেন। যেখানে তার কোনো আত্মীয় ছিল না। মদিনার মুসলমানদের মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে হজরত আলী রা: হজরত ওসমানের পর খলিফার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, যা ছিল মুসলিম রাষ্ট্রে মতাসীন হওয়ার এবং খলিফা নির্বাচনের ইসলামী নিয়ম। হজরত মুয়াবিয়া রা: যিনি সিরিয়ায় হজরত ওমর রা:-এর প্রতিনিধি ও আমির ছিলেন, তিনি পরবর্তী পর্যায়ে তার ছেলে ইয়াজিদকে ইসলামী নিয়মবহির্ভূতভাবে খলিফা মনোনীত করায় এবং চরিত্রগতভাবে ইয়াজিদ দুষ্ট চরিত্রের হওয়ায় নবী পরিবার ইমাম হোসাইন রা: এবং মদিনার মুসলমানেরা ইয়াজিদকে খলিফা মেনে নিতে রাজি হননি। এই কারণেই এবং আগামীতে বেনামাজি, নাচ-গানকারী চরিত্রহীন লোকদেরকে মুসলামনেরা যেন নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে গ্রহণ না করে, প্রিয়নবী এবং খোলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নত রা করার শিা পায়, তাই ইমাম হোসাইন রা: সপরিবারে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শাহাদতবরণ করেন; কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে রাজি হননি ।
কারবালা যুদ্ধের শিক্ষা : ইমাম হোসাইন রা:-এর আপসহীন সিদ্ধান্ত, চারিত্রিক ও আদর্শিক দৃঢ়তা, ইমামের প্রতি আহলে বাইতের আনুগত্য ও মহব্বত এবং কারবালার যুদ্ধ মুসলমানদের জন্য নিম্নলিখিত শিক্ষা পেশ করে।

১. মুসলমানদের এবং ইসলামের তি করার জন্য শত্রু কত গভীর চক্রান্ত করে এবং কিভাবে করে তার প্রমাণ কারবালার ইতিহাসে পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে মুসলমানদের সতর্ক থাকতে হবে।

২. বেনামাজি, চরিত্রহীন, মতালোভী নেতা এবং শাসক হলে তারা কত নির্মম, পাষাণ, অমানবিক ও অত্যাচারী হতে পারে কারবালার ঘটনা তার প্রমাণ।

৩. চরিত্রহীন, মুনাফিক মার্কা মতালোভী নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধান যারা, তারা শুধু রাষ্ট্রীয় শক্তির অপব্যবহার করে না, নিজের স্বার্থ ও মতার জন্য তারা ভালো মানুষ আর আলেম ওলামা শুধু নয়, নবী সা:-এর বংশধর হলেও তাদেরকে খুন করতে সঙ্কোচ বোধ করে না।

৪. নিজের ইজ্জত-সম্মান ও জানমাল এবং পরিবার পরিজনের চেয়ে ইসলামী আদর্শ ও রাসূল সা:-এর সুন্নাহকেই বেশি মূল্য দিতে হবে।

৫. যে নিজে আল্লাহ রাসূলের পথে চলে এবং চালায় তার আনুগত্য করা এবং তার প্রতি ভালোবাসাকে আল্লাহ ও রাসূলের পরে তৃতীয় স্থানের মর্যাদা দিতে হবে।

৬. আল্লাহর-রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা আমার এবং আমার চার খলিফার (মতা, দায়িত্ব পালন এবং পরবর্তী দায়িত্বশীল নির্বাচনের) সুন্নতকে মাঢ়ির দাঁত দিয়ে আঁকড়িয়ে ধরবে’ (আল-হাদিস)। ইমাম হোসাইন রা: তাই করেছেন। আমাদেরকেও এখান থেকে শিা নিতে হবে । সমাপ্ত

Related Post