কুরবানীর শিক্ষা ও আমাদের সমাজে কুরবানী
﴿ قُلْ إِنَّ صَلاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ * لا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ﴾ الأنعام: 162، 163.
“নিশ্চয় আমার নামায, আমার সকল ইবাদত, আমার জীবন ও জীবনের যাবতীয় কর্ম কার্য এমন কি আমার মরণ পর্যন্ত বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ পাকের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। তার কোন শরীক নাই এবং আমি এটাই আদিষ্ট হয়েছি, আত্মসমর্পনকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম। [সুরা আনআম ১৬২-১৬৩]
হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর কুরবানীর ঘটনা সকল মুসলমানদের জানা আছে। কুরবানীর ঘটনা বর্ণনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কুরবানীর ঘটনা মসজিদের ইমাম সাহেবগণ প্রতি বছর বর্ণনা করে থাকেন।
আমরা মুসলমানরা আজ কুরবানীকে একটি উৎসবের আমেজে পালন করে থাকি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কুরবানী মাংশ খাওয়ার প্রতিযোগিতাসহ একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সমাজের মধ্যে কুরবানী নিয়ে আলোচনা হলে তাতে প্রায়ই শুনা যায় যে, কে কার চেয়ে বেশী দামে কুরবানী দিয়েছে, কার গরুতে বেশী মাংশ হয়েছে কিংবা আগামী কয় মাস মাংশের বাজার না করে পারা যাবে, এসকল আলোচনাই মূখ্য হয়ে ওঠে। এছাড়াও অঞ্চল ভেদে কুরবানী একটি আভিজাত্যের প্রতিযোগিতায় রূপ নিয়েছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ প্রতিযোগিতা বেশ প্রকট। তারা কখনো ভাগে কুরবানী দেয়া পছন্দ করেন না। কারণ তাতে তাদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়। যিনি সবচেয়ে বেশি দামে কুরবানীর পশু ক্রয় করেছেন, তিনি এর দ্বারা সমাজের মধ্যে তার আভিজাত্য জাহির করে থাকেন। অনেক সময় কুরবানীর গরু দ্বারা লড়াই দেয়া হয়। যে গরুটি লড়ায়ে জিতবে সেটি কুরবানীর জন্য সবচেয়ে ভাল পশু হিসেবে ধরে নেয়া হয়।
আমাদের দেশের এক শ্রেণীর আলেমরাও কুরবানীর পশুর শিং কেমন হবে আর লেজ কমেন হবে এ বয়ান করতে করতেই জীবন পার করে দিয়েছেন। কুরবানীর আসল তাৎপর্য ও ব্যাখা না করে এমন ভাবে ফজিলতের বয়ান করেন যাতে অন্যায় ভাবে উপার্জিত অর্থ দ্বারা কুরবানী দাতাগণও চরম আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন এবং অন্যায় সংশোধন হওয়ার তাগিদ অনুভব করেন না। যেমন কুরবানীর পশুর গায়ে যত লোম কুরবানী দাতার আমল নামায় তত পরিমাণ নেকী লেখা হবে এ সকল ফজিলতের হিসেব নিকেশের অন্তরালে কুরবানীর আসল শিক্ষা আজ সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে।
কুরবানীর শিক্ষাঃ
رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلامٍ حَلِيمٍ فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِن شَاء اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلاء الْمُبِينُ وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الآخِرِينَ
প্রকৃত পক্ষে কুরবানীর থেকে কি শিক্ষা নেয়া উচিত তা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বর্ননা করেছেন, তিনি বলেছেন যে, وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الآخِرِينَ * الصافات“পরবর্তী কালের লোকদের জন্য এটাকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ স্থাপন করলাম।” [সুরা-সাফফাত ৩৭: ১০৮]।
এখানে কুরবানীর ঘটনার দ্বারা এ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো যে, ইব্রাহীম (আঃ) দুনিয়ার সকল কিছুর উপর অর্থাৎ নিজের সন্তানের জীবনের চেয়েও আল্লাহর হুকুমকে প্রধান্য দিলেন। আল্লাহ তায়ালার হুকুমের কাছে নিজের এবং তার সন্তানের জীবন তুচ্ছ করে দিলেন। তিনি নিজের সন্তানকে কুরবানী দিতে গিয়ে কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব বা ইতস্ততা বোধ করেন নি, কিংবা কোন অজুহাত ও তুলে ধরেননি। তিনি ইচ্ছে করলে বলতে পারতেন যে,
(১) হে আল্লাহ আমার বার্ধক্য বয়সের একমাত্র সন্তানকে তুমি এরকম কঠিন আদেশ থেকে আমাকে ক্ষমা কর কিংবা
(২) হে আল্লাহ, তোমার দ্বীন প্রচারের জন্য ছেলে চেয়েছিলাম, তোমার দ্বীনের কাজের জন্য এ ছেলেটাকে বেঁচে থাকতে দাও কিংবা
(৩) যেহেতু তিনি বিষয়টি স্বপ্নে দেখেছেন, তাই স্বপ্নের উপর ভিত্তি করেই সন্তান কুরবানী করা উচিত হবে কিনা, কিংবা স্বপ্নের ব্যাখ্যা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে সন্তান কুরবানী করা থেকে বিরত থাকার পথ খুঁজতে পারতেন। তিনি এরকম কোন অজুহাত না তুলে আল্লাহ তায়ালার হুকুমের কাছে সন্তানের জীবনকে উৎসর্গ করে দিলেন। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ ۚ وَاللَّـهُ عِندَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ ﴿١٥﴾ التغابن
“তোমাদের ধন সম্পদ ও সন্তান সন্তুতি তো কেবল পরীক্ষাস্বরূপ।” [আত তাগাবুন ৬৮: ১৫]
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) সে পরীক্ষাই দিলেন। মূলতঃ মুসলমানদের জন্য এটাই আল্লাহ তায়ালা নিদর্শন হিসেবে স্থাপন করেছেন যে, তারা সকল অবস্থায় নিজেদের জান-মাল, সন্তান-সন্ততিসহ সকল কিছুর উপর আল্লাহর হুকুম পালন করাকে প্রধান্য দিবে। এজন্যই আল্লাহ তায়ালা ঘটনাটিকে মুসলমানদের দৃষ্টান্তহিসেবে বর্ননা করেছেন।
ইব্রাহীম (আঃ)-এর জীবনে এরকম আর একটি ঘটনা। তৎকালীন দেশের বাদশাকে বলা হতো নমরুদ। তিনি যখন বললেন যে, আল্লাহ তায়ালার শাসন ছাড়া আর কারো শাসন মানবো না, নমরুদের শাসন মানা যাবে না। তখনই নমরুদ বাদশা সভাষদদের নিয়ে পরামর্শে বসলেন এবং হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে রাষ্ট্রদ্রোহী সাব্যস্ত করা হলো। বর্তমানে যে রকম রাষ্ট্রদ্রোহীদের ফাঁসি দেয়ার ব্যবস্থা আছে, তখনও রাষ্ট্রদ্রোহীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার জন্য আগুনে পুড়িয়ে মারা হতো। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে আগুনে পুড়িয়ে মারার জন্য বিচার করা হলো। ইব্রাহীম (আঃ) আগুনে পুড়ে মরার ভয়ে কিংবা জীবন বাঁচানোর জন্য তিনি নমরুদের শাসন মেনে নেননি। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
ﯖ إِنَّ اللَّـهَ اشْتَرَىٰ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ ۚ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّـهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ ۖ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنجِيلِ وَالْقُرْآنِ ۚ وَمَنْ أَوْفَىٰ بِعَهْدِهِ مِنَ اللَّـهِ ۚ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُم بِهِ ۚ وَذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ﴿١١١﴾ التوبة
“আল্লাহ মুসলমানদের থেকে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে।” [ আত তাওবাহ-৯:১১১]। তাই ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহ তায়ালার হুকুমকে প্রধান্য দিয়ে প্রয়োজনে জীবন বিষর্জন দিতে তৈরি হলেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তায়ালার হুকুম মানতে গিয়ে জীবন চলে যেতে পারে তবুও বাতিলের সাথে আপোষ করা যাবে না। হয় বাতিলকে অস্বীকার করতে হবে অন্যথায় বাতিলকে মেনে নিতে হবে। এ দুয়ের মাঝামঝি কোন অবস্থান নেই, যেখান থেকে বলা যাবে যে আমি হকের উপর আছি আবার বাতিলের সাথেও ভাল সম্পর্ক আছে। এ দুটি ঘটনার দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, কোন প্রকার ওজর আপত্তি বা অজুহাত ছাড়াই জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। মূলতঃ এটাই হচ্ছে কুরবানীর শিক্ষা। কিন্তু আমাদের সমাজে আজ এক শ্রেণীর কথাকথিত ইসলামী রাজনীতিবিদরা বাতিলের সাথে আপোষ করে নিজেদের মনগড়া হিকমত প্রচার করে ফেরাউনরূপী রাজ শক্তির আনুকুল্য লাভ ও ক্ষমতার উৎছিষ্ঠ ভোগের আশায় আপোষ করে থাকেন।
আমাদের করণীয়ঃ
কুরবানীর ঘটনার দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর হুকুম পালন করতে গিয়ে যতই বিপদের ঝুকি থাকুক না কেন, সে ঝুকি মাথায় নিয়ে তা পালনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। আল্লাহ তায়ালার হুকুম মানতে গিয়ে যদি সম্পদ হারানোর ভয় থাকে, যদি সন্তানের বা নিজের জীবন বিপন্ন হওয়ারও আশঙ্কা থাকে, তাহলেও আল্লাহর হুকুম মানা থেকে পিছিয়ে আসা যাবে না, বরং সর্ব অবস্থায় আল্লাহ তায়ালার হুকুম মানার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। কোন ভাবেই পাশ কাটানোর মনোভাব, ওজর, আপত্তি বা অজুহাত তুলে হুকুম পালনের পথ থেকে সরে আসা যাবে না। ইব্রাহীম (আঃ) সন্তানের জীবন বাঁচানোর জন্য কোন রকম অজুহাত উত্থাপন করেন নাই রবং আল্লাহর হুকুমকেই প্রাধান্য দিয়েছেন, এটাই হচ্ছে কুরবানীর শিক্ষা।
কিন্তু আমাদের সমাজের মধ্যে একদিকে মহা উৎসবে কুরবানী করা হয়, আর অন্যদিকে যখন আল্লাহ তায়ালার হুকুম প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোন বিপদের আশঙ্কা থাকে তখন পাশ কাটানোর জন্য নানা রকম অজুহাত দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়। যেমন সমাজের মধ্যে যখন সৎ কাজ প্রতিষ্ঠা করা, অন্যায় কাজের নিষেধ করা, সুদী অর্থতৈনিক ব্যবস্থা অপসারণ করা, ইসলামী আইন-কানুন বাস্তবায়নের কথা বলা হয়, তখন এ কুরবানী করা মুসলমানরাই নানা রকম অজুহাত তুলে ধরেন। এ কুরবানী করা মানুষেরাই মসজিদের মধ্যে নামাজ আদায় করেন কিন্তু সমাজের মধ্যে ইসলাম বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে নানা অজুহাত তুলে ধরেন, কেউ কেউ আবার এটাকে দায়িত্ব হিসেবেই মনে করেন না। তাহলে আল্লাহর আদেশের কাছে অত্মসমর্পন করা বলতে কি বুঝলাম? ইব্রাহীম (আঃ) সন্তান উৎসর্গ করা থেকে আমরা কি শিক্ষা গ্রহণ করালাম? মূলতঃ কুরবানীর আসল শিক্ষা হচ্ছে যে আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালনের জন্য কোন রকম ওযর আপত্তি বা অজুহাত তুলে না ধরে যে কোন অবস্থায় তৈরি থাকতে হবে, তাতে যত বড় আত্মত্যাগের প্রয়োজন হোক না কেন।
আসুন আমরা জীবনের সকল অবস্থায় যে কোন আত্মত্যাগের বিনিময়ে নামায রোযার মতো সমাজে ও রাষ্ট্রের মধ্যে আল্লাহর হুকুম পালন করার জন্য সচেষ্ট হই এবং বুঝতে চেষ্টা করি যে “নিশ্চয় আমার নামায, আমার সকল ইবাদত, আমার জীবন ও জীবনের যাবতীয় কর্ম কার্য এমন কি আমার মরণ পর্যন্ত বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ পাকের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। তার কোন শরীক নাই এবং আমি এটাই আদিষ্ট হয়েছি, আত্মসমর্পনকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম। [সুরা আনআম ১৬২-১৬৩]” আমিন