কোরআন তেলাওয়াত অর্থাৎ পড়ার উদ্দেশ্য কি কেবল শব্দ পড়া, না কি অর্থ বুঝে পড়া? রাসূল (সা•) বলেছেন, কোরআনের প্রতিটি অক্ষর পড়ার জন্য রয়েছে ১০টি নেকি। এটা কি অর্থ ছাড়া পড়ার জন্য, না কি অর্থসহ পড়ার জন্য, এটা কি আবার কেবল অর্থসহ বোঝার জন্য, না কি তা জীবনে প্রয়োগ করার জন্যও? আরবের লোকের মাতৃভাষা আরবি। তাই তারা আরবিতে লেখা কোরআন সহজে বুঝতে পারে। যেমন আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় লেখা কোন বই সহজেই বুঝতে পারি। কোরআন বাংলায় নাজিল হলে আমরা সহজে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থও বুঝতে পারতাম। উল্লেখ্য, আল্লাহ বলেছেন, রাসূলদের মাতৃভাষা অনুযায়ীই তাদের ওপর কেতাব ও সহিফা নাজিল হয়েছিল।
একটি বোতলভর্তি মধু ছিপি দিয়ে বদ্ধ। এখন এ বোতলটার বাইরের অংশ চুষলে বা বোতলটি মুখে লাগালে কি মধু খাওয়া হবে? উদ্দেশ্য তো মধু খাওয়া। তাই ছিপি খুলে মধু খেতে হবে। তেমনি অর্থসহ কোরআন পড়লে প্রকৃত কোআন পড়া হবে। এবং তা হলেই হৃদয়-মন-কলব পরিপুষ্ট হবে।
রাসূল (সা•) বলেছেন, যে ব্যক্তি আ-রিকতা সহকারে কলেমা পড়ে সে অবশ্য বেহশতে যাবে। সাহাবারা আন্তরিকতার অর্থ জানতে চাইলে তিনি বলেন, যখন কলেমার বাক্য মানুষকে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হারাম ও অবৈধ কর্ম থেকে বিরত রাখবে তখন তা আন্তরিকতা সহকারে পড়া হবে।
রাসূল (সা•) এও বলেছেন, এমন দিন আসবে যখন ইসলামের কিছুই থাকবে না শুধু নাম ছাড়া ও কোরআনের বাহ্যিক রূপ ছাড়া। মুসলমানদের মসজিদগুলো হবে ভক্তি ও জ্ঞানশূন্য।
আল্লাহ কোরআনে (সূরা আনআম আয়াত ৫০) বলেছেন, ‘চক্ষুষ্মান ও অন্ধ কি সমান? তোমরা কি অনুধাবন করবে না?’ তেমনি সূরা মুহাম্মদ আয়াত ২৪-এ আল্লাহ বলেন, ‘তবে কি ওরা কোরআন সম্বন্ধে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা করে, না ওদের অ-র তালাবদ্ধ? তোমরা কি ভেবে দেখবে না? (কাসাস-আয়াত ৭১-৭২)।
এগুলো কি কোরআনের অর্থ ও তাৎপর্য জানার কথা বলে না? ইসলাম প্রথম পর্যায়ে আরব এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। পরে তা অন্যান্য ভাষাভাষী অঞ্চলে প্রসার লাভ করে। অর্থ ছাড়া পড়লেই যদি প্রতিটি অক্ষরের জন্য ১০টি নেকি পাওয়া যায়, তাহলে অর্থসহ পড়লে কি অনেক বেশি নেকি পাওয়া যাবে না?
যে কোন বিবেকবান ব্যক্তি বলবেন, অবশ্য বেশি নেকি পাওয়া যাবে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, কোন কোন ধর্মবিশারদকে দেখেছি, কেবল কোরআন শব্দ পড়ার কথা বলেন। অর্থসহ পড়ার জন্য তেমন তাকিদই দেন না। ফলে সুখ ও শান্তিময় জীবন (ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক) নির্বাহের জন্য, সুষ্ঠু প্রশাসন, বিচার, অর্থনীতি ইত্যাদি ব্যবস্থার জন্য, উত্তম চরিত্র গঠনের জন্য শাশ্বত কল্যাণময় কোরআনে যে শত শত বিধিবিধান ও দিকনির্দেশনা রয়েছে, সেগুলো সম্বন্ধে আমরা অজ্ঞই থেকে যাই।
সমাজ থেকে তাই অসত্যতা, কুসংস্কার, কলুষতা, পঙ্কিলতা, অশান্তি, অস্থিরতা দূরীভূত না হয়ে বরং বেড়েই চলছে যদিও আমরা নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদির বাহ্যিক অনুষ্ঠানাদি পালন করে যাচ্ছি। মানুষ কে, কোথা থেকে এসেছে, তাকে এবং এ বিশ্ব জগৎকে কে সৃষ্টি করেছেন এবং নিয়ন্ত্রণ করছেন, স্রষ্টার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, সৃষ্টির সঙ্গে মানুষের কি সম্পর্ক কি, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কি? সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি, এ জন্যই কি শেষ, নাকি মৃত্যুর পর আরেক জগৎ আছে, কারও কাছে মানুষের জবাবদিহিতা আছে কি ইত্যাদি অনেক মৌলিক, গূঢ়, সূক্ষ্ম ও জীবনধর্মী প্রশ্ন মনোজগতে জাগে। মানুষ যুগে যুগে এগুলো সম্পর্কে বিভিন্ন ভুল ও অস্বচ্ছ ধারণা পোষণ করে আসছিল। এগুলোর অকাট্য, সত্য ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান আমরা কোরআন পড়ে জানতে পারি। তেমনি কোরআনে প্রায় ৭০০টি বিজ্ঞানবিষয়ক আয়াত পড়লে আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ব, সার্বভৌমত্ব, অসীমত্ব, বিশালত্ব, বিশ্বজগৎ পরিচালন প্রকৌশলী প্রভৃতি অবহিত হয়ে আল্লাহর প্রতি আমাদের বিশ্বাস দৃঢ়তর হয় এবং অনুগত্যে মাথা নত হয়ে আসে। তাই অর্থ জানা জরুরি।