সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর যিনি তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য যুগেযুগে রাসূল প্রেরণ করেছেন, যদিও এতে কাফেররা অসন্তুষ্ট হয়, সালাত ও সালাম অবতীর্ণ হতে থাক নবীকুলের শিরোমনী মুহাম্মাদ বিন আব্দিল্লাহর উপর। যিনি পথহারা মানুষকে পথের সন্ধান দিয়েছেন আল্লাহর বলে দেওয়া নির্দেশিকা দিয়ে। এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরামগণের উপরও, যারা তাঁর পদাঙ্ক অনুসরসণ করেছেন, আর কিয়ামত অবদি যারা অনুসরণ করবেন তাদের উপরও।
অতঃপর: বাংলাদেশ কুরআন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র-কুয়েত কর্তৃক আয়োজিত আজকের এই ওলামা সমাবেশের সম্মানিত পরিচালক, জনাব মাওলানা মুশতাকুর রহমান সাহেব, উক্ত অনুষ্ঠানের মুহতারম সভাপতি জনাব মাওলানা হাফেজ নূরুল আলম সাহেব। বাংলাদেশ কুরআন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। এবং অন্যান্য সংগঠনের প্রতিনিধি ও দায়িত্বশীলবৃন্দ। কুয়েতে অবস্থানরত বিভিন্ন অঞ্চল হতে আগত আম্বিয়ায়ে কেরামগণের উত্তরসূরী, সাধারণ জনগণের মধ্যে মর্যাদাবান, যেমন মর্যাদা রাখে পূর্ণীমা রাতে ¯িœগ্ধযুক্ত চন্দ্র, তারকারাজীর উপর। ও উপস্থিত বিশিষ্ট জন: আচ্ছালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ ॥
আকজের ওলামা সমাবেসের আলোচ্য বিষয় হলো: মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী: يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ
অর্থাৎ: তারা (অমুসলিমরা) মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহ তাঁর আলোকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে। (সূরা সাফ্ফ আয়াত: ৮)
এই বিষয়ের উপর লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে; তাই আপনাদের সামনে বিষয়টি উপস্থাপন করার জন্য দাঁড়িয়েছি।
সম্মানিত উলামের কেরাম! পৃথিবীর সূচনা লগ্ন হতেই সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব চলে আসছে। সত্য বা আলোর জ্যোতি বিকশিত করার দায়িত্ব নিয়েছেন মহান আল্লাহ তায়ালা, তিনি ঘোষণা করলেন, আমি আমার “আলোকে” বিকশিত করবোই যদিও এতে কাফের ও মুশরিকরা অসন্তুষ্ট হয়।
সম্মানিত উপস্থিতি! আলো ও অন্ধকারের প্রতিযোগিতা বা দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে হযরত আদম (আ.)-এর সন্তান হাবীল ও কাবীলের যুগ হতে। কালের আবর্তনে এই দ্বন্দ্ব অব্যাহত রয়েছে। হযরত ইবরাহীম (আ.)-কে আগুনে নিক্ষেপ করে নমরূদ ইসলামের “জ্যোতি বা আলোকে” নিভিয়ে দিতে চেয়ে ছিলো; কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালা বাতিলের অন্ধকার হতে ইবরাহীম (আ.)-কে নিরাপদে রাখলেন, তাঁর মাধ্যমে বিশ্বময় বিকশিত হলো, আল্লাহর আলো, কেননা তাঁর বংশ হতে পৃথিবীতে আগমন করেছেন নাম জানা অজানা অসংখ্য নবী ও রাসূল।
তেমনিভাবে ফেরাউনও তার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বলে হযরত মূছা (আ.)-কে পৃথিবীর আলো দেখার পূর্বেই হত্যা করার নিমিত্তে তৎকালীন জ্যোতিষী বা তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শে পুত্র সন্তানদের হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা হলো মূছা (আ.)-এর মাধ্যমে বনী ইসরাইলদের মাঝে ইসলামের আলো বিকশিত করা। তাই তিনি ফেরাউনকে তার এই হীন চক্রান্তে সফল করেননি। মূছা (আ.) তার ঘরেই লালিত পালিত হলেন। ঘটনা সকলেরই জানা, ফেরাউনকে মহা শক্তিধর আল্লাহ তায়ালা সমুদ্রে ডুবিয়ে, চুবিয়ে চুবিয়ে মারলেন। ইতিাহস সাক্ষী যে কাফের বা ইসলামের শত্রুরা যখনই ইসলামকে মুছে ফেলতে চেয়েছে, মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর দ্বীনকে হিফাযত করেছেন। এবং ইসলামের শত্রুদের কী পরিণতি হয়েছে, ফেরাউনের লাশ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইসলামের শত্রুরা বিশ্বশান্তির অগ্রদূত মুহাম্মাদ (সা.)কেও হত্যা করে পৃথিবীর মানচিত্র হতে চিরতরে ইসলামের নাম-নিশানা মিটিয়ে দিতে চক্রান্ত করেছিলো। কিন্তু মহাকৌশলী আল্লাহ জাল্লা শানুহু, তাঁর প্রিয়বন্ধুকে শত্রুদের কবল হতে হিফাযতের মাধ্যমে ইসলামের “আলোক রশ্মিকে” বিশ্বময় বিকশিত করেছেন।
সম্মানিত উলামায়ে কেরাম! সত্য এবং মিথ্যার লড়াই চিরন্তন। যুগে-যুগে একদিকে ছিল নবী-রাসূল ও তার সঙ্গী-সাথীরা, অন্যদিকে ছিল বাতিলপন্থী তথা আল্লাহদ্রোহীরা। সত্যপন্থীদের আহ্বান ছিল অত্যন্ত সত্য, শান্তিপূর্ণ ও যুক্তিসঙ্গত। অপরদিকে ছিল অসত্য, যুক্তির পরিবর্তে অন্ধ আবেগ, উন্মত্ততা, হিং¯্রতা, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যতা। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আজো তার ব্যতিক্রম নয়। সত্যপন্থীদের পথ কখনো ফুল বিছানো ছিল না, এখনো নেই। ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ, ঠাট্টা, উপহাস, গালিগালাজ ও অশালীন উপাধি ছিল সত্যপন্থীদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এভাবে সত্যপন্থীদেরকে তারা দ্বীন প্রচারের কাজ হতে দূরে রাখতে চায়। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিয়ামত পর্যন্ত একদল সৈনিককে তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত রাখবেন, একথা আল্লাহর রাসূল (সা.) বলে গিয়েছেন:
لَا يَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظَاهِرِينَ حَتَّى يَأْتِيَهُمْ أَمْرُ اللَّهِ وَهُمْ ظَاهِرُونَ رواه البخاري
“আমার উম্মতের মধ্যে সবসময়ই একটি দল থাকবে যারা বিজয়ী থাকবে, যতক্ষণ না তাদের জন্য আল্লাহর আদেশ চলে আসে এবং তারা সেসময় বিজয়ী বেশে থাকবে”। (বুখারী) এদের মাধ্যমেই আল্লাহ তাঁর নূর বা আলোকে পূর্ণতা দান করবেন।
তৎকালীন কাফেররা মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে পরিবেশ ভারী ও শ্বাসরুদ্ধকর করে তুলতো। জ্বলে উঠতো হিং¯্রতার দাবানলে। রাসূল (সা.) এর পথে কাঁটা বিছানো, সিজদার সময় তাঁর পিঠের ওপর জবাই করা পশুর নাড়িভুঁড়ি নিক্ষেপ করা, চাদর পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দেয়া এবং কুরআন পড়ার সময় তাঁকে, কুরআনকে এবং আল্লাহকে গালি দেয়ার মতো জঘন্য কাজ করতেও তারা পিছপা হয়নি। কিন্তু মানুষের মন এসবের প্রতি বিরক্ত ও বিতৃষ্ণ হয়ে উঠলো। রাসূল (সা.)-এর বিরুদ্ধে নতুন গালি উদ্ভাবন করার দায়িত্ব পড়লো ইবনে আবি কাবশার উপর। নিন্দাসূচক কবিতা রচনা ও অপপ্রচার করার জন্য কবিদের মধ্য হতে, আবু সুফিয়ান বিন হারেস, আমর বিন আস এবং আব্দুল্লাহ বিন যাবারীকে দায়িত্ব দেয়া হলো। কারণ সে কালের কবিরা অনেকাংশে আজকের দিনের তথাকথিত হলুদ সাংবাদিক, তথাকথিত সুশীল সমাজ আর বুদ্ধিজীবিদের ন্যায় ভূমিকা পালন করত। যে ভূমিকা কবি সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, শামসুল হক, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসির মামুন আর জাফর ইকবাল গং এবং তার উত্তরসূরীরা পালন করে থাকে। এতেও কাবু করতে না পেরে তারা আরো হতাশ হয়ে পড়লো। আঁটতে থাকলো নতুন নতুন ষড়যন্ত্র আর ফন্দি। এমন অপবাদ ও ষড়যন্ত্র হতে আজও ইসলামী আন্দোলন মুক্ত নয়। তাদের বিরুদ্ধেও অযৌক্তুতিক ও মিথ্যা বানাওয়াট অভিযোগ দায়ের করে ইসলাম বিজয়ের পথ হতে তাদেরকে সরিয়ে দিতে হীনচক্রান্ত করে যাচ্ছে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার মনোনীত এমন ব্যক্তিদের মাধ্যমে যে, তিনি তাঁর এই ‘আলোকে’ জিয়ে রাখবেন- তা ক্রমশঃ পরিস্ফূটিত হচ্ছে।
কুরআন আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির মাঝে অন্যতম। ধরার বুকে সবচেয়ে দামী। কুরআনের সংস্পর্শে এসে মানুষ অনেক দামী হয়েছে, আর সে কারণেই মানুষ আশরাফুল মাখলুকাতের আসনে সমাসীন হয়েছে। হযরত ওমরের মত একসময় ইসলাম বিদ্বেষী ব্যক্তি কুরআনের সৈনিক হয়ে নিজের জীবনকে আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গিন করেছেন, দ্বীনের ঝাণ্ডা হাতে তুলে নিয়ে দ্বীনকে বিজয়ী করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। আবার হযরত বেলালের মত কৃতদাস মর্যাদার আসনে সমাসীন হয়েছেন।
কুরআনের আহ্বান যাদের কাছে অসহ্য মনে হয়েছে তারাই কুরআনের বিরুদ্ধে নানাভাবে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে। তারা নানা ধরনের বাধা প্রদানের মাধ্যমে তাদের গাত্রদাহের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। আল্লাহদ্রোহীরা কালে কালে কুরআনের প্রচার-প্রসারকে বন্ধ করে দেয়ার জন্য নানা ছুঁতোয় গণ্ডগোল পাকিয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্ত হচ্ছে তিনি যে কোন মূল্যে তাঁর দ্বীনের আওয়াজকে বুলন্দ করবেনই। আল্লাহ বলেন-
يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ
“এরা (কাফেররা) তাদের মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, অথচ আল্লাহর ফয়সালা হলো তিনি তার নূরকে প্রজ্বলিত করবেন।” (সূরা সাফফ: আয়াত ৮)
নবী ও রাসূল আগমনের পূর্বে অন্ধকারের কালো থাবায় অস্থির মানবতা যখন গুমরে কাঁদছিল, ঠিক তখন নবী মুহাম্মদ (সা.) মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের নির্দেশনা নিয়ে মানবতার দুয়ারে হাজির হলেন। প্রতিটি যুগে ফেরাউন নমরূদের উত্তরসূরীরা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে নবীদের উপর নির্যাতনের সর্বশক্তি প্রয়োগ করতো। নবী করিম (সা.) এর ব্যাপারেও এর ব্যতিক্রম হলোনা। শত প্রতিকূলতার পরও একদল সাহসী আল্লাহর গোলাম নবীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলামের অগ্রযাত্রাকে সামনের দিকে দূর্বার গতিতে এগিয়ে নেন। এইসব মানুষ ইতিহাসে সোনার মানুষ হিসাবে কিয়ামত পর্যন্ত মানবতার মাঝে অনুসরণিত হবেন। আল কুরআনই ছিল এঁদের জীবনের অনন্য গাইড লাইন। সম্মানিত আলেমগণ! আসুন আমরাও তাঁদের মিছিলে শরীক হই।
কুরআনের অগ্রযাত্রায় ভীত হয়ে নানাভাবে এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে। ফলে কুরআনপ্রেমীদের হৃদয় আহত হয়েছে। ১৯৮৫ সালের ১০ এপ্রিল কুরআন বাজেয়াপ্ত করার ঘৃণ্য আবেদন করে মামলা হয় কলকাতা হাইকোর্টে। এ ঘটনায় বিক্ষোভের ঢেউ আছড়ে পড়ে সারা মুসলিম বিশ্বে। বাংলাদেশেও প্রতিবাদের ঝড় উঠে। কুরআনের মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে হাসি মুখে জীবন দেয় অনেকে।
এখনো কুরআনের মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন থেমে নেই, থেমে নেই বাধাও। মর্যাদা রক্ষার তাগিদে জীবন বিসর্জন দিচ্ছেন অনেকে। কুরআনের অবমাননার প্রতিবাদ চলবে ততদিন, যতদিন আল্লাহর গোলামরা বেঁচে থাকবে। এই গোলাম বা আলেমগণ বসে থাকলে কিয়ামতের দিন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কেননা মানুষ এর মান রক্ষায় ব্যর্থ হলেও আল্লাহ নিজেই এর রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন- কুরআনের ঘোষণা হতে আমরা তা জানতে পারি: আল্লাহ তায়ালা বলেন: ﴿إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ﴾ “নিশ্চয় কুরআন আমিই নাযিল করেছি, আর উহার হেফাজতের দায়িত্ব আমারই” (সূরা হিজর-আয়াত ৯)।
সূরা সাফ এর ৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহর এই রীতি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে বলা হয়েছে, এক শ্রেণীর লোক আল্লাহর নূর তথা তাঁর স্মরণ ও নামকে মিথ্যা প্রচারের স্রোতে মানুষের অন্তর থেকে মুছে ফেলতে চায়। তারা মনে করে যে ফুঁ দিয়ে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে ফেলা সম্ভব, অথচ সূর্যের আলোর মতোই মহান আল্লাহর নূর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে।
এ আয়াত থেকে আমাদের নি¤েœর কথাগুলো মনে রাখা দরকারঃ
এক: ইসলামকে নির্মূলের জন্যে ইসলামের শত্রুরা মিথ্যা প্রচার ও প্রোপাগাণ্ডার ওপরই সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে, তাই তাদের কোনো কথায় প্রভাবিত হওয়া উচিত নয়।
দুই: ইসলামের শত্রুদের এটা বোঝা উচিত আল্লাহর ইচ্ছার বাস্তবায়ন অনিবার্য এবং মিথ্যার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তাই ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের যে কোনো প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।
সম্মানতি উপস্থিতি! পশ্চিমা বিশ্বে যখন ইসলাম বিদ্বেষ চরমে পৌঁছেছে …
যখন ইসলামকে উপহাস করে কার্টুন, রম্য রচনা লিখা হচ্ছে, ঠিক তখন তাদের নিজেদের দেশেই মানুষ স্রোতের মত ইসলাম গ্রহণ করছে। মূলত ইসলাম হচ্ছে এক উজ্জ্বল আলোকরশ্মি। অপপ্রচার দিয়ে এই রশ্মিকে থামিয়ে দেওয়ার চিন্তা করাটা নিতান্তই বোকামি।
যখন ইসলামী সংগঠনগুলো বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলতো, তখন স্যাকুলাররা মনে করত এ দাবী উত্থাপনকারীরা পাগলের প্রলাপ বকছে। কালান্তরে আজ প্রতিয়মান হতে চলছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী এখন শুধু দাবী নয়, অচিরেই তা বাস্তবে রূপান্তরিত হবে। ইনশা আল্লাহ।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে ইসলামপন্থী দলগুলোর উপর স্যাকুলার সরকাররা তেমন কোন বৈরী মনোভাব পোষণ না করলেও বর্তমানে জুলুম নির্যাতনের এক ভয়াল ছোঁবলে ইসলামপ্রেমীদের হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত করেই চলছে। কারণ স্যাকুলাররা এখন ইসলামপন্থীদের উত্থানে সাংঘাতিক তটস্থ। ক্ষমতালিপ্সুরা কুরআনের আন্দোলনকে তাদের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করেই আদর্শিক লড়াইয়ের পরিবর্তে জুলুম-নির্যাতনকে ক্ষমতায় টিকে থাকার পথ হিসেবে বাছাই করে নিয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ দা’ঈ ইলাল্লাহ বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী, শহীদ হাসান আল বান্না, সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ, সাইয়্যেদ আহমদ বেরলভী, শাহ ইসমাইল শহীদ, শায়খ আহমেদ সারহিন্দ, সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী, শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক, ফজলুল হক আমিনী, শহীদ আবদুল কাদের মোল্লাÑ তাঁরা সবাই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টা। আরো যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া, ইমাম আবু হানীফা (রহ.) তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের নির্যাতন, মিথ্যা মামলা, কারাগারের অন্ধকার কুঠুরি, জালিম সরকারের ফাঁসির মঞ্চ তাঁদের নির্ভীকতা এবং অবিচলতার কাছে হার মেনেছে। পরাজিত হয়েছে সকল ষড়যন্ত্র। যখনই কুরআনের বিরুদ্ধে, ইসলামী আইনের বিরুদ্ধে, ষড়যন্ত্র হয়েছে, তখনই দ্বীনের এই মুজাহিদরা তাঁদের বক্তব্য ও লেখনীর মাধ্যমে ঈমানদারদের তাওহীদি চেতনাকে উজ্জীবিত করেছেন, তৈরি করেছেন প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের দেয়াল।
এখনও দিকে দিকে নাস্তিক্যবাদীরা কুরআনের সম্মানকে ভুলুন্ঠিত করার জন্য নানা ফন্দি-ফিকিরে ব্যস্ত। যেখানেই কুরআনের সম্মান লঙ্ঘন করার ঘৃণ্য চেষ্টা হবে, সেখানেই ইস্পাত কঠিন প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ভেঙ্গে দিতে হবে ইসলাম বিদ্বেষীদের বিষদাঁত। এমন প্রতিবাদী এক দল মুজাহিদের মাধ্যমেই আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুত ওয়াদা পূর্ণ করবেন। হে আল্লাহ! আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন।
কুরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজে যারা বাঁধা দিতে চায়, কুরআনের পাখি আল্লামা সাঈদীকে যারা উদ্ভট অভিযোগে অপমানিত করতে চায়, কুরআনের কর্মীদের যারা নিঃশেষ করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে ঈমানদারদের সংগ্রাম কি থেমে থাকতে পারে? আজকের ওলামা সমাবেশে ইসলামের শত্রুদের প্রতিবাদ করা হোক সবার প্রতিজ্ঞা। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
পরিশেষে গেল শতাব্দির শেষ বছরে কুরআনের “জ্যোতিকে” নিভিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য অপচেষ্টা করেছিলো তুরস্কের জনৈক অফিসার, তার ভাগ্যে কী ঘটেছিলো তা বর্ণনা করে প্রবন্ধ শেষ করবো, ইনশা আল্লাহ ॥
১৯৯৯ সালের আগস্ট মাসে তুরস্কে ঘটেছিল এক প্রলয়ঙ্করী আল্লাহ কর্তৃক গজব ভূমিকম্প। সারা বিশ্বের মানুষকে সেই ভূমিকম্পের ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছিল। কী এমন ঘটেছিলো সেদিন আসুন জেনে নেই ॥
জনৈক সামরিক অফিসার কর্তৃক পবিত্র কুরআন অবমাননার জন্য তুরস্কের উপর নাযিল হয়েছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে ভূমিকম্পের মহা গজব। এই ভূমিকম্পে পঞ্চাশ হাজারেরও অধিক লোক নিহত হয়েছিল। এই গজবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল অনেক শহর, জনপদ।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রাপ্ত এই ভয়াবহ সংবাদের সারমর্ম হচ্ছে- ‘সাগরের পারে তুরস্কের এক বিখ্যাত নৌঘাঁটি। অবসরপ্রাপ্ত কিছু সংখ্যক তুর্কী জেনারেলের সংবর্ধনা উপলক্ষে সেখানে আয়োজন করা হয়েছে এক জাঁকালো অনুষ্ঠান। গধফ হরমযঃ ভবংঃরাধষ বা উন্মত্ত রজনী উৎসব নামে সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান করেছেন ইসরাইলী, আমেরিকান, স্বাগতিক তুর্কী দেশের জেনারেলবৃন্দ। প্রত্যেক দেশের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করছিলেন ত্রিশজনের অধিক করে। আমদানী করা হয়েছিল সুন্দরী নর্তকীদের। যথাসময়ে শুরু হল মদ পান আর নৃত্য। জেনারেলদের চারদিকে ঘিরে নাচছে নর্তকীরা। চলছে মনের সমারোহ।
রজনীর উন্মত্ততা তখন তুঙ্গে। সুরায় নেশায় উন্মত্ত। আয়োজক আল্লাহদ্রোহী জেনারেলের মাথায় এলো ইবলিসী চিন্তা। চিৎকার দিয়ে ডাকলো এক ক্যাপ্টেনকে। আনতে বলল কুরআন কারীম। ধর্মপ্রাণ ক্যাপ্টেন শিউরে উঠলেন জেনারেলের শয়তানী কথা শুনে। জেনারেলের হুকুম মত কুরআন শরীফ হাজির করা হলো। জেনারেল নির্দেশ দিলো ক্যাপ্টেনকে। কুরআন পাঠ কর ১৪ পারার সূরা হিজরের ৯নং আয়াত। ভয়ে পাঠ করলেন ক্যাপ্টেন- إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ ﴿٩﴾ অর্থাৎ আমিই (আল্লাহ) কুরআন নাযিল করেছি এবং নিশ্চয় আমি নিজেই এর সংরক্ষক।’
জেনারেল বলল, ব্যাখ্যা কর এই আয়াতের। সংকিত ক্যাপ্টেন- বললেন, আমি জানি না এর ব্যাখ্যা। ব্যাখ্যা কর এই আয়াতের, সংকিত ক্যাপ্টেন বললেন, আমি জানি না এর ব্যাখ্যা। ব্যাঙ্গাত্মক হাসি ফুটে উঠল জেনারেলের মুখে। সে নিজেই বলতে লাগল, ‘আল্লাহ বলছে নাকি, সে নাযিল করেছে কুরআন আর সে নিজেই নাকি হেফাযত করবে এই কুরআনকে।’ আর সাথে সাথে জেনারেল টুকরো টুকরো করে ফেললো পবিত্র কুরআন, ছড়িয়ে দিল মদের আসরে, নৃত্যরত নগ্ন নর্তকীদের পায়ের তলায়। আর দম্ভ ভরে উচ্চারণ করলো, কোথায় সে কুরআন নাযিলকারী আর কোথায় সে এর হেফাযতকারী? এই অমানবিক শয়তানী কার্যকলাপ দেখে ভয়ে আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার চিৎকার দিতে দিতে হল রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন। ত্যাগ করলেন ঘাঁটি। আর ঠিক তখনই সমুদ্র বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে বেরিয়ে এল হেফাযতকারীর পক্ষ থেকে প্রচন্ড এক অগ্নিস্তম্ভ আল্লাহর গজব। কমলা রঙের প্রবল আলোর বিচ্ছুরণে ধাঁধিয়ে গেল চোখ। সঙ্গে সঙ্গে ভয়াবহ এক মহাশব্দ, মহা আর্তনাদ। সব কিছু নিমিষের মধ্যে শেষ হয়ে গেল। নৌঘাঁটি বিলীন হয়ে গেল মাটির গর্ভে। কারো কোন নাম নিশানা বাকী রইল না।
প্রচণ্ড ধ্বংসস্তুপে প্রমাণিত হলো যালেমদের রেহাই নেই, অহংকারীদের ধ্বংস অনিবার্য। আর ইহাই মহাসত্য। আরো সত্য আল্লাহ ও তাঁর নাযিলকৃত পবিত্র কুরআন মাজীদ। চিরন্তন সত্য আল্লাহর ওয়াদা। আবার নতুন করে দেখিয়ে দিলেন বিশ্বের নাফরমানদের। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
﴿قُلْ هُوَ الْقَادِرُ عَلَىٰ أَن يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عَذَابًا مِّن فَوْقِكُمْ أَوْ مِن تَحْتِ أَرْجُلِكُمْ أَوْ يَلْبِسَكُمْ شِيَعًا وَيُذِيقَ بَعْضَكُم بَأْسَ بَعْضٍ. انظُرْ كَيْفَ نُصَرِّفُ الْآيَاتِ لَعَلَّهُمْ يَفْقَهُونَ﴾
অর্থাৎ ঃ আপনি বলুন, তিনিই শক্তিমান যে তোমাদের উপর কোন শাস্তি, উপর দিক থেকে অথবা তোমাদের পদতল থেকে প্রেরণ করবেন অথবা তোমাদেরকে দলে উপদলে বিভক্ত করে সবাইকে মুখোমুখি করে দিবেন এবং একজনকে অন্যের উপর আক্রমণের স্বাদ আস্বাদন করাবেন। দেখ, আমি কেমন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিদর্শনাবলী বর্ণনা করি-যাতে তারা বুঝে নেয়। (সূরা আনআম আয়াত: ৬৫)
যালিম আল্লাহদ্রোহী ব্যক্তি ও গোষ্ঠির এই ঘটনা থেকে যেমন শিক্ষা নেয়ার সুযোগ রয়েছে, তেমনি মুমিন মুসলমানের ঈমান-ইয়াকীনকে আরও শুদ্ধতর মজবুত করারও রয়েছে তাগিদ। হে আল্লাহ আমাদের আলেম সমাজকে স্বীয় অনুধাবন করে, তা যথাযথ পালন করার তাওফীক দান কর। দয়াময় মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা হে আল্লাহ! আমাদেরকে তুমি তোমার মহাগজব থেকে হেফাযত কর। তোমার এই বিশাল শামিয়ানার নিচে তোমারই আশ্রয় চাই। তুমি অসীম, মহান। তোমার রহমতের কোন সীমানা নেই। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফীক ও ক্ষমতা দান করুন। আমীন