শহরের শাসনকর্তা ইকরামা ফাইয়ায যখন থলে নিয়ে নিজ বাসভবন থেকে বের হয়েছিলেন, তখন তিনি ভেবেছিলেন, কেউ তাকে দেখেনি, কেউ টের পায়নি। কিন্তু আর যা-ই হোক, সজাগ ও বুদ্ধিমতি স্ত্রীর চোখ ফাঁকি দেওয়া কি এত সহজ? না, মোটেও সহজ নয়। তাইতো দেখা গেল, ফিরে আসার পরপরই স্ত্রী অতি সন্তর্পণে স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, এতো রাতে এই বেশে কোথায় গিয়েছিল শহরের মহামান্য শাসনকর্তা?
এই তো জরুরি একটা কাজে!
মনে হয়, কিছু লুকানোর চেষ্টা চলছে। প্রেমাস্পদ! আমি তো আপনার জীবনসঙ্গিনী, অর্ধাঙ্গিনী। আমার কাছ থেকে কোনো কিছু লুকিয়ে রাখা উচিত হবে কি?
তুমি জানতে চেষ্টা করো না। লুকানো জিনিসকে লুকিয়েই থাকতে দাও।
এ আমার কৌতূহল। আর আপনি তো জানেন, মেয়েরা তাদের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারে না!
চেষ্টা করে দেখো।
চেষ্টা করলেও কাজ হবে না। অন্ততঃ আপনার বেলায়। সুতরাং দেরী না করে বলে ফেলুন, কী উদ্দেশ্য ছিল আপনার এই ছদ্মবেশী গোপন অভিযানের?
ইকরামা চেয়েছিলেন, তার এই দানের কথা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানবে না। কিন্তু এখন? হ্যাঁ, এখন তিনি না জানিয়ে পারলেন না। কেননা, কে জানে স্ত্রীর মনে সন্দেহের বীজ অঙ্কুরিত হয় কিনা? তাই তিনি বললেন, শুনতেই যদি চাও, তাহলে আল্লাহর নামে শপথ করে বলো, কোনোদিন কারো কাছে তা প্রকাশ করবে না।
স্ত্রী মৃদু হেসে বললেন, আপনার ইচ্ছাকে অবশ্যই আমি সম্মান করব।
ইকরামা একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন। তারপর প্রিয় জীবনসঙ্গিনীর চোখে চোখ রেখে বললেন, প্রেয়সী আমার! তুমি কি জানো, উত্তপ্ত মরুভূমিতে একজন মুসাফিরের জন্য একটু ছায়ার কত প্রয়োজন? হোক না তা বাবলা গাছের ছায়া! লাখ দিনারের বিনিময়ে হলেও কি সে তা পেতে চাইবে না?
লাখ দিনার কেন? আরও বেশি হলেও চাইবে। কেননা এ সময় তো প্রাণ তার ওষ্ঠাগত থাকে। আর প্রাণ চলে গেলে লক্ষ দিরহাম কী কাজে লাগবে তার?
ধন্যবান তোমাকে। এবার হাশরের দিন ও হাশরের মাঠের ভয়াবহ অবস্থাটা একটু চিন্তা করে দেখো তো!
যেখানে সূর্য চলে আসবে মাথার উপরে!
যেখানে লোকজন হাবুডুবু খাবে নিজের ঘামে!
যেদিন কোনো ছায়া থাকবে না আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া!
যে দিনটা হবে দুনিয়ার পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান!!
প্রিয়তম! সেই কঠিন দিনে আরশের একটুখানি ছায়া লাভের সওদা করতেই বেরিয়েছিলাম আমি। তুমি তো এই হাদীস নিশ্চয়ই পড়েছ যে, যারা দান করে অতি গোপনে, এমনকি ডান হাতে দান করলে বাম হাতও টের পায় না, তাদেরকে ডাকা হবে সেদিন আরশের ছায়াতলে।
এতটুকু শুনতেই আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে বুদ্ধিমতী স্ত্রী বলে ওঠল, বুঝেছি প্রিয়তম! আর বলতে হবে না। সত্যি আপনি বড়ো ভাগ্যবান। আর আপনার মতো মহৎপ্রাণ লোকের স্ত্রী হতে পেরে আমিও বড়ো ভাগ্যবতী।
আহা! সৎপথে স্বামীর দান করা দেখে জগতের সকল স্ত্রী যদি এমনই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করত!! সবাই যদি স্বামীর দান করার বিষয়টিকে এভাবেই হাসিমুখে বরণ করত!!!
সে সময় খলীফা ছিলেন সোলায়মান বিন আব্দুল মালিক। যিনি এককালে ছিলেন খোযায়মার অন্তরঙ্গ বন্ধু। তাই মুখোশধারী ঘোড়সওয়ার চলে যাওয়ার পর তিনি খুব একটা দেরী করলেন না। দু’দিন পরেই ‘আঁধার রাতের দরদী বন্ধু’ ও তার খবর নিয়ে হাজির হলেন খলীফা সোলাইামানের কাছে। অনেকদিন পর বন্ধুকে পেয়ে খলীফাও তাকে সাদরে গ্রহণ করলেন।
আদর-আপ্যায়ন ও খানিক বিশ্রামের পর দু’বন্ধুর কথাবার্তা শুরু হলো।
কথাবার্তা ও আলাপচারিতার এক পর্যায়ে খোযায়মার মুখ থেকে মুখোশধারীর গল্প শুনে খলীফা খুবই কৌতূহলী হয়ে ওঠলেন। বললেন, ‘বন্ধু! যেভাবে পারো, মুখোশধারী ঘোড়সওয়ারের পরিচয় খুঁজে বের করো। উপযুক্ত পুরস্কার তার প্রাপ্য’।
আরো কিছু কথাবার্তা বলে খলীফার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাঁর দরবার থেকে বের হয়ে এলেন খোযায়মা। এবার তাঁর নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার পালা। ফিরে যাওয়ার পালা। কিন্তু তাঁর জন্য এখনই এবং এ মুহূর্তেই যে অপোক্ষ করছে এক নতুন চমক, অবিশ্বাস্য পুরস্কার, তা কে জানে?
রওয়ানা হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হলো খলীফার সীল ও স্বাক্ষর সম্বলিত একটি ‘পরওয়ানা’। যাতে লিখা ছিল, ‘আজ থেকে তুমি আরব উপদ্বীপের নতুন শাসনকর্তা।’
প্রিয় পাঠক! পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে, বিপদের সময় ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করলে আল্লাহ পাক এভাবেই পুরস্কৃত করেন তার বান্দাদেরকে। তিনি কাউকে পুরস্কৃত করতে চাইলে এভাবেই করেন। মানুষের কল্পনাও অনেক সময় তাঁর সাহায্য ও অনুগ্রহের সীমানা স্পর্শ করতে পারে না। চিন্তা করে দেখুন তো! আল্লাহ পাকের করুণা কত অসীম! তাঁর দান কত মহান!! দু’দিন আগেও যে খোযায়মা অনাহারে দিন কাটিয়েছেন, আজ সে খোযায়মাই খলীফার দরবার থেকে শাসনকর্তা হয়ে ফিরে আসছেন! দান করে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার পরও যিনি মানুষের কাছে হাত পাতেননি; ভরসা করেছেন শুধু আল্লাহর উপর, এমন ব্যক্তির জন্যে তো এ ধরনের পুরস্কারই মানায়। বরং বলা যায় এমন পুরস্কারই তাঁর ন্যায্য পাওনা।
সবরের গাছে তো মেওয়া ফলবেই!
তাওয়াক্কুলের বাগানে তো ফুল ফুটবেই!! (চলবে…)