মনে করা হয়, রুক্ষতা ও কঠোরতা তারবিয়তের পক্ষে সহায়ক। কিন্তু তা ঠিক নয়। কঠোরতার দ্বারা শিশু-কিশোরদের স্তব্ধ করে দেয়া যায়, একে তারবিয়ত বলে না। প্রকৃত অর্থে তারবিয়ত হচ্ছে শিশুর প্রতিভাগুলোকে বিকশিত হতে সাহায্য করা। মানুষের প্রতিভাগুলো অতি নাযুক ও সংবেদনশীল। সদ্য অঙ্কুরিত চারা গাছের মতোই কোমল। এর পূর্ণবিকাশের জন্য প্রয়োজন খোলা আকাশের আলো আর প্রয়োজনীয় পরিচর্যা। আলোহীন বদ্ধ ঘরে চারাগাছ যেভাবে হলদে হয়ে শুকিয়ে যায়, সেভাবে স্তব্ধ মানুষের মধ্যেও প্রতিভাগুলো শুকিয়ে যায়। তাই শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত মানসিক বিকাশের জন্য তারবিয়তকারীর কোমল আচরণ অতি প্রয়োজন। শুধু শিশু-কিশোরদের বেলায়ই নয়, সব শ্রেণীর তারবিয়ত গ্রহণকারীর জন্য নম্রতা ও কোমলতা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর অনুগ্রহে আপনি তাদের জন্য কোমল হয়েছেন। আপনি যদি রূঢ় ও কঠিন-হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। অতএব, তাদের ক্ষমা করুন এবং তাদের জন্য (আল্লাহর কাছে) ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং (বিভিন্ন) বিষয়ে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন। এরপর যখন কোনো বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ হবেন তো আল্লাহর ওপর ভরসা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালোবাসেন।’—সুরা আল ইমরান : ১৫৯
এই আয়াতের তাফসিরে মুফতি শফী রাহ. লেখেন-উপরোক্ত বিষয়গুলো থেকে ইসলাহ ও সংশোধন এবং তাবলিগ ও দ্বীন প্রচারের বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা পাওয়া গেল। তা এই, যে ব্যক্তি মানুষের ইসলাহ ও সংশোধন এবং দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজে আত্মনিয়োগ করতে চায় তার জন্য উপরোক্ত গুণাবলি-নম্রতা ও সুন্দর ব্যবহার এবং কোমলতা ও ক্ষমাশীলতা, অর্জন করা অপরিহার্য। কেননা, আল্লাহর পেয়ারা হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ হতে কঠোরতা হলে তাও মানুষ বরদাশত করতে পারে না তাহলে আর কার পক্ষে সম্ভব হবে যে, রুক্ষতা ও মন্দ ব্যবহার দ্বারা আল্লাহর বান্দাদের নিজের সঙ্গে একত্র করবে এবং তাদের ইসলাহ ও সংশোধনের কাজ আঞ্জাম দিবে?-তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন ২/২১৬-২১৭ কোমলতা ও এর ফলাফল উল্লেখ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে বিষয়ে কোমলতা আছে তা সৌন্দর্যমণ্ডিত। আর যেখানে কোমলতা নেই তা হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ।-সহিহ মুসলিম হাদিস : ২৫৯৪
কোমলতার দ্বারা মানুষের কথাবার্তা ও আচার-ব্যবহার সুন্দর হয়। আর সুন্দর ব্যবহার মানুষের মনে যে প্রভাব সৃষ্টি করে তা অন্য কোনোভাবে সৃষ্টি হয় না। এ প্রসঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সিরাত থেকে কিছু দৃষ্টান্ত পেশ করছি।
হযরত মুআবিয়া ইবনুল হাকাম আসসুলামী (রা.) বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে জামাতে নামাজ পড়ছিলাম। এরই মধ্যে এক ব্যক্তি হাঁচি দিলো। আমি বললাম, ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ।’ এতে অন্য মুসল্লিরা আমার দিকে তীক্ষষ্ট চোখে তাকাতে লাগল। আমি বললাম, হা! আমার মরণ! তোমরা আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছ কেন? এতে তারা আরও বিচলিত হলো এবং তাদের উরুতে চাপড় দিয়ে আমাকে নিবৃত্ত করতে চাইল। এতে আমি নিশ্চুপ হলাম। নবীজি যখন নামাজ সমাপ্ত করলেন—আমার বাবা-মা তাঁর ওপর কুরবান হোক! কোনো শিক্ষককে তাঁর চেয়ে উত্তমরূপে শিক্ষা দিতে আমি দেখিনি! না তার আগে আর না তার পরে। খোদার কসম, তিনি আমাকে কোনো ধমক দিলেন না, প্রহার করলেন না, কোনো কটুবাক্য বললেন না। শুধু বললেন-‘এ নামাজে জাগতিক কথাবার্তা বলা যায় না।’-সহিহ মুসলিম (সমাপ্ত)