পরিবার রাষ্ট্রের প্রথম স্তর, সামগ্রিক জীবনের প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর। পরিবারেরইবিকশিত রূপ রাষ্ট্র। পৃথিবীকে আবাদ করার জন্য মহান আল্লাহ প্রথমে আদম আ:কে সৃষ্টিকরেন। অতঃপর তাঁর পাজর থেকে সৃষ্টি করেন মা হাওয়া আ:কে। তাঁদের মাধ্যমেই পৃথিবীতেপরিবারের সূচনা হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি হতেই সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা হতে তার স্ত্রী সৃষ্টিকরেছেন এবং যিনি তাদের দু’জন হতে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন।’ (সূরা আন নিসা : ১)।অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ এবং নারী থেকে।তারপর তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতেপারাসূরা আল হুজুরাত : ১৩)। পরিবার ঠিক হলে ব্যক্তি ঠিক হয়ে যায়। আর ব্যক্তি ঠিক হয়েগেলে পরিবার ও সমাজ উভয়ই ঠিক হয়ে যায়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ইসলামের সুমহান আদর্শভুলে গিয়ে অনেক পরিবারই আজ চরম বিপর্যয়ের মুখে। এ থেকে উদ্ধারে ইসলামী আদর্শঅনুসরণের বিকল্প নেই। পরিবার থেকেই শুরু হয় মানুষের সামাজিক জীবন। সামাজিক জীবনেরসুষ্ঠুতা নির্ভর করে পারিবারিক জীবনের সুষ্ঠুতার ওপর। আবার সুষ্ঠু পারিবারিক জীবনএকটি সুষ্ঠু রাষ্ট্রের প্রতীক। পরিবারকে বাদ দিয়ে যেমন সমাজের কল্পনা করা যায় না, তেমনি সমাজ ছাড়া রাষ্ট্রওঅচিন্তনীয়। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা, ভাই-বোন প্রভৃতি একান্নভুক্তব্যক্তিদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে পরিবার। আর বড় বড় পরিবার কিংবা বহু সংখ্যক পরিবারেরসমন্বয়ে গড়ে ওঠে সমাজ। সুতরাং বলা যায়, রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার পরস্পর অবিচ্ছেদ্য।বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ যেমন প্রথম ও দ্বিতীয় তলা নির্মাণের পরই সম্ভব, তার আগেনয়, অনুরূপভাবে পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র, সমাজও পরিবার ব্যতীত গড়ে তোলা শুধু অসম্ভবই নয়, বরং অমূলক ও অচিন্তনীয়ও বটে। কাজেই সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে মানবসমাজ ও রাষ্ট্রেরপ্রাথমিক ভিত্তি হচ্ছে পরিবার ।
ইসলামী পরিবারের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে পরিবারের সব সদস্যের মধ্যে প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও মনের প্রশান্তি লাভ। নৈতিক ও চারিত্রিক উৎকর্ষতা সাধনের মাধ্যমে মানবতারপরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের শিক্ষা পরিবার থেকেই লাভ করে মুসলিম সন্তানেরা। দুঃখজনক হলেওসত্য যে, শয়তানের প্ররোচনায় নিপতিত হয়ে কিছু মুসলিম পরিবার আজ পাশ্চাত্যের অনুকরণেতাদের পরিবার গড়ে তুলতে চাচ্ছে। তারা তাদের পরিবারের নারী সদস্যকে ঘরোয়া পরিবেশথেকে, পোশাকের বাধ্যবাধকতা থেকে, সতীত্ব, শালীনতা ও লজ্জাশরমের বাধ্যবাধকতা থেকে, ধর্ম ও নৈতিকতার সীমা থেকে এবং সামাজিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের আনুগত্য থেকে একেবারেইমুক্ত ও স্বাধীন করে দিতে চাচ্ছে। অথচ তারা জানে না যে, পাশ্চাত্যে বহু আগেইপারিবারিক প্রথা ভেঙে পড়েছে। সেই ঢেউয়ের প্রচণ্ড অভিঘাত আমাদের পারিবারিক ব্যবস্থারওপরও আছড়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত। অবাধ নারী স্বাধীনতার নামে আমাদের দেশের নারীদের পরিবারথেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা চলছে পুরোদমে। পারিবারিক বিপর্যয় রোধে গ্রহণ করতেহবে কার্যকর ব্যবস্থা। নিচে এ সম্পর্কে কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করা হলো- ১. আমাদেরসমাজের নারী-পুরুষ বিশেষত যুবক-যুবতীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ আমূল পরিবর্তন করতেহবে। তাদের বোঝাতে হবে, পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ও ভোগবাদী সমাজ ও পরিবার মুসলমানদেরসমাজ ও পরিবারের জন্য কোনো দিক দিয়েই আদর্শ ও অনুসরণীয় হতে পারে না। আমাদের আদর্শহচ্ছে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর গড়া ইসলামি সমাজ ও পরিবারব্যবস্থা। ইউরোপীয়সমাজ ও পরিবারের রীতিনীতি শুধু পারিবারিক বিপর্যয়েরই সৃষ্টি করে না, মানুষকে পশুরচেয়েও নিকৃষ্ট চরিত্রের বানিয়ে দেয়। অতএব, তাদের অন্ধ অনুকরণ করে আমরা কোনোক্রমেইপশুত্বের স্তরে নেমে যেতে পারি না। ২. অসৎ সঙ্গে মিশে ছেলে-মেয়ে যাতে নষ্ট না হয়েযায় সেদিকে পরিবারের অভিভাবক ও সদস্যদের তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতে হবে। তারা কার সাথেচলাফেরা, ওঠাবসা, খেলাধুলা ও বন্ধুত্ব স্থাপন করে সে বিষয়ে খোঁজখবর নিতে হবে। এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সা:-এর নিম্নোক্ত হাদিসটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
হজরত আবু মুসা আশ’আরি রা: বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, ‘সৎ সঙ্গ ও অসৎ সঙ্গের দৃষ্টান্তহচ্ছে সুগন্ধি বিক্রেতা ও কামারের হাঁপরে ফুঁদানকারীর মতো। সুগন্ধি বিক্রেতা হয়তোতোমাকে এমনিতেই কিছু দিয়ে দেবে অথবা তুমি তার কাছ থেকে কিছু ক্রয় করবে অথবা তারসুঘ্রাণ তুমি পাবে। আর কামারের হাঁপরে ফুঁদানকারী হয় তোমার কাপড় জ্বালিয়ে-পুড়িয়েদেবে নতুবা তার দুর্গন্ধ তো তুমি পাবেই।’ ৩. ছোটবেলা থেকেই ছেলে-মেয়েদেরপোশাক-পরিচ্ছদের প্রতি খেয়াল রাখা। ৪. উপযুক্ত বয়সে ছেলে-মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থাগ্রহণ করা। ৫. সুন্দরী প্রতিযোগিতা ও ফ্যাশন শোর নামে নারী দেহের নগ্ন প্রদর্শনীবন্ধ করতে হবে। সাথে সাথে অশ্লীল গান, নৃত্য ও নাচ পরিহার করতে হবে। ৬.বেশ্যাবৃত্তির লাইসেন্স প্রদান বন্ধ করে অবাধ যৌনতার পথ রুদ্ধ করতে হবে। ৭. যৌতুকনামক পরিবার বিধ্বংসী প্রথা বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে এবং এ ব্যাপারেগণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ৮. যৌন সুড়সুড়ি প্রদানকারী অশ্লীল বইপত্র ও ম্যাগাজিনবাজেয়াপ্ত করতে হবে। ৯. মেয়েদের জন্য পৃথক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে।১০. পর্দা প্রগতির অন্তরায় নয়; বরং তা শালীনতা, শুচি-শুভ্রতার প্রতীক এবং নারীনির্যাতন, ইভটিজিং, এসিড নিপে প্রভৃতি রোধের কার্যকর উপায়। সুতরাং মেয়েদের ছোটবেলাথেকেই পর্দার বিধান মেনে চলার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। ১১. নারী-পুরুষ উভয়েই যাতেনিজ নিজ অবস্থানে থেকে দেশ ও জাতির উন্নয়নে কাজ করতে পারে সে লক্ষ্যে কার্যকর পদপেগ্রহণ করতে হবে।
পারিবারিক বিপর্যয় রোধে ইসলামি পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবারের হাল ধরে রাখারজন্য ধার্মিক ও চরিত্রবতী নারীর বিকল্প নেই। তাই একটি আদর্শ পরিবার গঠনের জন্যধার্মিক ও চরিত্রবতী স্ত্রী বেছে নেয়ার জন্য কুরআন মজিদ ও সহিহ হাদিসে নানাভাবেউৎসাহিত করা হয়েছে। কারণ স্ত্রী হচ্ছে ঘরের রানী।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘প্রত্যেক আদম সন্তান কর্তা। পুরুষ তার পরিবারের কর্তা আর নারী তার ঘরেরকর্ত্রী।’
পারিবারিক বিপর্যয় রোধে আজ অনেকেই চিন্তিত। নানা কলাকৌশল প্রয়োগেপারিবারিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যাপৃত। অথচ মানব চিন্তা যতই শানিত যুক্তিরকষ্টিপাথরে উন্নীত হোক না কেন, আল্লাহ প্রদত্ত নির্ভুল জ্ঞানের সহায়তা ব্যতীতপ্রকৃত সফলতা কখনো সম্ভব নয়। কাজেই এ পর্যায়ে আমরা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, পারিবারিক বিপর্যয় রোধের নিশ্চয়তা প্রদান করেছে ইসলাম।
জীবনের সব পর্যায়ে যদিআল্লাহ প্রদত্ত ও মহানবী সা: প্রদর্শিত বিধান মেনে চলা যায় তাহলেই পারিবারিকবিপর্যয় রোধ সম্ভব হবে। নতুবা মানবীয় প্রচেষ্টা মরীচীকার মতো নিষ্ফল ও ব্যর্থ হতে বাধ্য।
সমাপ্ত