Main Menu
أكاديمية سبيلي Sabeeli Academy

প্রকৃত জ্ঞানী এবং নফসের প্রবৃত্তি

Preaching Authentic Islam in Bangla
জামে তিরমিযি এবং সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফে একটি হাদিস এই ভাষ্যে বর্ণিত হয়েছে : ‘হজরত সালাদ ইবনে আউস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, চতুর এবং জ্ঞানী সেই ব্যক্তিই যে নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণাধীন রাখে এবং মৃত্যু-পরবর্তী সময়ের জন্য (আখিরাতের সফলতা এবং কামিয়াবির জন্য) আমল করে। মূর্খ এবং অজ্ঞ ওই ব্যক্তি যে নিজেকে নিজের নফসের প্রবৃত্তির অধীন বানিয়ে নেয় (অর্থাত্ আল্লাহর আহকাম ছেড়ে দিয়ে নিজের নফসের চাহিদা অনুযায়ী চলে)। এতদসত্ত্বেও সে আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করতে থাকে। (তিরমিযি ও ইবনে মাজাহ শরীফ)
এই হাদিসে রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রকৃত অর্থে বুদ্ধিমান, জ্ঞানী এবং চালাক চতুর কে সে কথাটিই স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করে দিয়েছেন। সাধারণত দুনিয়ার মানুষ চালাক-চতুর এবং বুদ্ধিমান তাকেই মনে করে থাকে, যে দুনিয়ার সম্পদ কামানো এবং অর্থকড়ি উপার্জনে চালাক-চতুর হয়ে থাকে। অঢেল ধন-সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সে হয় বেশ পটু। সমাজে যার ক্ষমতা, দাপট এবং খ্যাতির ছড়াছড়ি তাকে। আর মূর্খ অজ্ঞ ওই ব্যক্তিকে মনে করা হয়, যার ভেতর এজাতীয় বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী অনুপস্থিত থাকে। কিন্তু রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বুদ্ধিমান এবং মূর্খতার এই ধারণা মূলত সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করার ফলেই এবং মানবজীবনকে দুনিয়ার জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নেয়ার কারণেই হয়েছে। কারণ এক্ষেত্রে শুধু এতটুকুই মনে করা হয় যে, জীবন তো এটিই যা এই দুনিয়ায় অর্জিত হয়। সুতরাং মানবজীবনে যতদূর ধন-সম্পদ এবং যশ-খ্যাতি অর্জন করা যায়, তাই করে নাও। এরপর আর কিছু নেই।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই হাদিসে বলেছেন, মানবজাতির আসল জীবন সামান্য ক’দিনের এই দুনিয়ার জীবন নয়। কেননা এই জীবনের শেষ তো কবরের কিনারা পর্যন্ত। আসল ও অনন্ত জীবন হচ্ছে আখিরাতের জীবন। যে জীবনের কোনো শেষ নেই। সুতরাং আল্লাহর কাছে প্রকৃত জ্ঞানী এবং সফল ওই ব্যক্তিই যে নিজের চিরস্থায়ী অনন্ত জীবন তথা আখিরাতের জীবনের প্রস্তুতিতে লেগে আছে। যারা নিজের নফসের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে আল্লাহর ফরমাবরদার এবং অনুসারী হতে সক্ষম হয়েছে।
নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখার অর্থ হলো, যে নফসের কুমন্ত্রণায় পরে যা ইচ্ছা তাই করবে না; বরং প্রথমে দেখতে হবে নফসের কোন চাহিদাটি বৈধ আর কোনটি অবৈধ? কোনটি যুক্তিসম্মত আর কোনটি অযৌক্তিক। এই বিষয়টি সাব্যস্ত হওয়ার পর বৈধ ও যৌক্তিক কাজটি করতে থাকবে। অযৌক্তিক-অবৈধ কাজ ছেড়ে দেবে, পরিহার করবে। কেননা মানুষের নফসের চাহিদা সীমাহীন। লাগামহীনভাবে মানুষ যদি নফসের চাহিদার পেছনে ছুটতে থাকে, তাহলে দুনিয়ার বাস্তবতাই একথা বলে দেয় যে এই চাহিদার কোনো শেষ নেই, কোনো কিনারা নেই। ক্রমে ক্রমে চাহিদা বাড়তেই থাকে। মানুষ যতই তাকে ছাড় দিতে থাকবে, তার তৃষ্ণা-ক্ষুধা শুধু বাড়তেই থাকবে।। এমন কাজেও জড়িয়ে ফেলে, যা তাকে পশুর কাতারে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
সুতরাং বুদ্ধিমত্তা তাকেই বলা হবে নফসের চাহিদাকে লাগামহীন হতে না দেয়া, বরং সব সময় তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উত্তম পন্থা এটিই যে, শুধু ওইসব চাহিদাই পূরণ করবে, যা আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের আহকাম অনুযায়ী হয়। আর যেসব চাহিদা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নাজায়েয-অবৈধ, তা ছাড়তে হাজারো কষ্ট হলেও তা ছেড়ে দেবে। কেননা এই কষ্ট ক্ষণস্থায়ী, খুব সামান্য সময়ের এবং একেবারে সামান্য কষ্ট। মানুষ ধৈর্য ধারণ করে দৃঢ়চিত্তে সাহসিকতার সঙ্গে যখন তা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত হয়ে যায়, তখন তার ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকেই অন্তরের প্রশান্তি ধাবিত হয়। চাহিদা পূজারীরা যা কখনও ধারণাও করতে পারবে না। আর এভাবেই এজাতীয় মানুষের দুনিয়ার জীবনও শান্তিময়-সুখকর হয়ে যায়, আর পরকালের জীবনও হয় পরম তৃপ্তিদায়ক, মহা শান্তিময় ও অনন্ত সুখকর।
এর বিপরীত যে ব্যক্তি লাগামহীনভাবে নিজের নফসের চাহিদা অনুযায়ী বৈধ-অবৈধ, জায়েজ-নাজায়েজ সব চাহিদাই পূরণে তত্পর থাকে, তাকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মূর্খ অজ্ঞ অসহায় সাব্যস্ত করেছেন। অসহায়-নিরুপায় আখ্যা দেয়ার কারণ হলো, সে তার নিজের নফসের নিয়ন্ত্রণে নিরুপায় অসহায়। আর অজ্ঞ-মূর্খ আখ্যা দেয়ার কারণ হলো, সে তার নফসের চাহিদা পূরণে সুখ-শান্তি অর্জনের প্রচেষ্টায় রয়েছে। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে দেয়, এর দ্বারা মানুষের কখনোই পুরোপুরি সুখ-শান্তি অর্জিত হয় না। কারণ হলো, যারা চাহিদার পেছনে ছুটে বেড়ায়, তাদের এই চাহিদা কোনো একটি স্তরে সীমিত থাকে না। বরং প্রতি মুহূর্তে আরও বেশি, আরও উন্নতি, আরও অগ্রগতির দিকে দৃষ্টি দৌড়াতে থাকে। এভাবেই সারা জীবন তাকে অস্থিরতার সাগরে হাবুডুবু খেতে হয়। আর শেষকালে যে এতে সুখ-শান্তির পায়রা ধরা দেবে না, তা সবারই অনুধাবন করার কথা। দুনিয়ায়ও সে অশান্তির অনলে জ্বলতে থাকে, আর আখিরাতের শান্তির পথও তার জন্য হয়ে যায় রুদ্ধ।
হাদিসের শেষে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন যে, কিছু কিছু মানুষ আল্লাহর আহকামের বিপরীতে নিজের নফসের চাহিদা পূজারী হয়ে যায়; এরপরও যখন আল্লাহর কোনো বান্দা যখন তাকে পরখ করতে যায় তখন নফসের চাহিদা পূজারী এই বলে পাশ কেটে যায় যে, আল্লাহর দয়ার সাগর, তাঁর দয়া-অনুগ্রহ ব্যাপক, সীমাহীন। যারা এহেন ধারণা পোষণ করে পাড়ি জমানোর হীনমানসিকতা লালন করছে, তারা মারাত্মক ধোঁকায় রয়েছে। কেননা শুধু প্রত্যাশা, শুধু তামান্নার দ্বারাই পরকালের জীবন সংশোধন হয় না; বরং তার জন্য প্রয়োজন বাস্তব জীবনের আমল। আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশী হওয়া, তামান্না করা নিশ্চয়ই একটি ভালো কাজ, উত্তম কাজ। কিন্তু তা তখনই উত্তম হিসেবে বিবেচিত হবে, যখন তার সঙ্গে কিছু আমলেরও সমন্বয় থাকবে। মন্দ আমল করে, আখিরাতের জন্য কোনো চিন্তা-ফিকির না করেই যে প্রত্যাশা, যে তামান্না করা হয়; বাস্তবে তা প্রত্যাশাই নয়, বরং তা নফস ও শয়তানের ধোঁকা-প্রতারণা। আল্লাহ আমাদের সবার নফস ও শয়তানের ধোঁকা থেকে নিরাপদ রাখুন। আমীন!
মুল-জাস্টিস আল্লামা মুফতি তাকী উসমানী
অনুবাদ : মুহাম্মদ তৈয়্যেব হোসাইন

Related Post