ভূমিকা: পৃথিবীতে মানবজাতির হিদায়াত তথা সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য যুগেযুগে প্রয়োজনের তাগীদে জান্নাতী মনীষীদের আগমন ঘটেছিলো। তারা ছিলেন আল্লাহর পক্ষথেকে মনোনীত। তাদেরকে নবী ও রাসূল বলা হতো। আদি মানব আদম (আ.) থেকে এর ক্রমধারা চলতে শুরু করে; আর বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.) এর আবির্ভাবের মধ্যদিয়ে এধারার পরিসমাপ্তি ঘটে। তিনি এমন এক সময় আগমন করেন যখন বিশ্বব্যাপী চলছিলো নানাহ জুলুম, নিপীড়ন, শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন ও কুসংস্কার। সব মিলিয়ে গোটা বিশ্বছিলো একটি অশান্তির দাবানল সদৃশ! ঠিক এমনই এক প্রেক্ষাপটে মহান আল্লাহ এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন ঘুনেধরা সমাজের সকল পর্যায়ে সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে প্রেরণ করেন স্বর্গীয় মহামানব মুহাম্মাদ (সা.) ; কবি বলেন-
“বিশ্বজুড়ে জ্বলছিলো যবে
হাবিয়া জাহন্নাম
স্বর্গ থেকে আসিলেন নবী
লয়ে শান্তির পয়গাম”।
সকল নবী রাসূলকে মহান আল্লাহ কোন নির্দিষ্ট গোত্র, এলাকা, ভূ-খন্ড বা দেশের জন্য প্রেরণ করতেন। কিন্তু রাসূল (সা.) কে পাঠালেন কুল জাহানের রহমত স্বরূপ। তাই তাকে বিশ্বনবী বা রাহমাতুল্লিল আ’লামীন নামে অভিহিত করেন। তিনি ছিলেন উত্তম আদর্শ ও শ্রেষ্ঠ গুণাবলীর অধিকারী। তিনি সকল কালের সকল দলের সর্বাধুনিক ছিলেন। মহান স্রষ্টা আল্লাহ তাকে এক নিআ’মত দান করেন যা ছিলো সমগ্র জাতির জন্য গাইড লাইন স্বরূপ। এক অভিনব পদ্ধতিতে আধুনিক ধাঁচে গঠন করে মহানবী (সা.) এর নিকট ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন অবতীর্ণ করেন। যার ফলে রাসূল (সা.) তৎকালীন প্রচলিত আধুনিকতাসমূহ ওহীর ভিত্তিতে গ্রহণ করতেন। আমাদেরকে সুন্দর ও শ্রেষ্ঠজীবন গঠনে সচেষ্ট হতে হবে। আর শ্রেষ্ঠ মানুষের জীবনাচরণ অনুসরণের মাধ্যমেই শ্রেষ্ঠজীবন গড়তে হয়। মহানবী (সা.) ছিলেন জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। তাঁর জীবন শ্রেষ্ঠজীবনের একমাত্র অনুপম আদর্শ, তাঁর জীবনই আদর্শজীবনের মডেল। তাঁর আধুনিক শিক্ষা সুন্দর ও অনাবিলজীবন গড়ার সর্বোত্তম হাতিয়ার এবং আদর্শজীবনের আলোর মিনার। এ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন পবিত্র ক্বুরআনের সূরা আল আহযাবের ২১ নম্বর আয়াতে বলেন
لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّـهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّـهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّـهَ كَثِيرًا
– “যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে”।
বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.) মহোত্তম গুণাবলীর মূর্তপ্রতীক পবিত্র ক্বুরআনে বর্ণিত যত মহৎ ঘটনা বা গুণাবলীর কথা রয়েছে সেগুলোর বাস্তব সমাহার ঘটেছিলো প্রিয় নবীর জীবনে, তাই তিনি পবিত্র ক্বুরআনেরও মূর্তপ্রতীক। রাসূল (সা.) এর মৃত্যুর পর কিছু সংখ্যক সাহাবী তাঁর প্রিয়তমা জীবন সঙ্গিনী আম্মাজান আয়শা (রা.) এর কাছে রাসূল (সা.) এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তদেরকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন- কেন তোমরা কি ক্বুরআন পড়নি? অর্থাৎ ক্বুরআনই হলো রাসূল (সা.) এর চরিত্র। ক্বুরআনে বর্ণিত সকল গুণ, বৈশিষ্ট্য, চরিত্র, মার্ধুয, স্বভাব, প্রকৃতি, আচার-ব্যবহারের বাস্তব নমুনা ছিলেন তিনি। সকল দিক থেকে তার সীরাত ছিলো নিষ্কলঙ্ক ও নিখুঁত। তাইতো তার সম্পর্কে ক্বুরআন ঘোষণা করে-
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا وَدَاعِيًا إِلَى اللَّـهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُّنِيرًا وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ بِأَنَّ لَهُم مِّنَ اللَّـهِ فَضْلًا كَبِيرًا
“হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহবায়করূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপরূপে। আপনি মুমিনদেরকে সুসংবাদ দিন যে, তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট অনুগ্রহ রয়েছে”। (সূরা আহযাব: ৪৫-৪৬)
কুরআন এমন একটি শাস্ত্র যা বিশ্বে সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। তার শব্দ গুচ্ছসমূহ অলঙ্কার শাস্ত্রমন্ডিত, ভাবের ব্যঞ্জনায় পরিপূর্ণ, যা পৃথিবীর আর কোন শাস্ত্রে নেই। সকল মানব রচিত গ্রন্থ ধ্বংসশীল। কিন্তু একমাত্র আল-ক্বুরআনুল কারীমই হলো সেই চিরস্থায়ী গ্রন্থ যার সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তাআ’লার। আল্লাহর বাণী-
إِنّا نَحنُ نَزَّلنَا الذِّكرَ وَإِنّا لَهُ لَحافِظونَ
“আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক” (সূরা আল হিজর -৯)।
ক্বুরআন এমন এক আধুনিক গ্রন্থ যার প্রভাব বলয় সারাজাহানে বিস্তৃত। আজকের বিজ্ঞানীরা যতই আধুনিক তত্ত্ব আবিস্কার করুক এতে তাদের গর্বের কী আছে? যা আজ আমাদের দৃষ্টির সম্মুখে আবিস্কার হচ্ছে ; ক্বুরআন গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে সহজেই বোধগম্য হয় যে, আজ থেকে প্রায় দেড়হাজার বছর পূর্বেই ক্বুরআন তার সূত্র বর্ণনা করে রেখেছে।
আজকাল আমাদের দেশের কিছু আলেম ওলামা রাসূল (সাঃ) এর সুন্নত নিয়ে খুব বেশী বাড়াবাড়ী করেন, তাদের মতে আধুনিক বিজ্ঞানের তৈরী জিনিসপত্র ব্যবহার করা সুন্নতের পরিপন্থী! অথচ এই বিজ্ঞান এসেছে ক্বুরআন থেকেই। আর আধুনিক সাজে সজ্জিত বলেই বিধর্মীরা আজ এতো উচ্চে সমাসীন হতে পেরেছে।
ওয়েলসের ঐতিহ্যবাহী নগরী কার্ডিফ। এই নগরীর একটি হাসপাতালে কাজ করেন গাইনোকলোজিস্ট ড. জেইন স্কট। প্রায় বিশ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৯৯৮ সালের দিকে লন্ডনের “দ্য ডেইলি টাইমস” পত্রিকায় এক বিশেষ সমীক্ষায় তার ইসলাম গ্রহণের পটভূমি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন- একদিন নিজের পেশার প্রয়োজনে আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অবদান ডি.এন.এ. এর ওপর কানাডার মন্ট্রিল থেকে পাঠানো একটি ইন্টারনেট পেজ গভীরভাবে অধ্যয়ন করছিলেন। এতে তিনি ক্বুরআনে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের আবিস্কৃত ডি.এন.এ এর এনালাইসিস করতে গিয়ে যতই তিনি স্টাডি করছেন ততই বিজ্ঞানের এ অবদানকে ইসলামের অত্যন্ত কাছাকাছি দেখতে পেয়েছেন। তখন ড. স্কট অকপটে স্বীকার করেছেন যে ইন্টারনেটে প্রদত্ত বিষয়টিই তার জন্য ক্বুরআনকে জানা এবং তার বাহক বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে জানার একটি সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছে।
কোন এক কালে আধুনিক এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধনভাণ্ডার মুসলমানদের হাতেই ছিলো। তখন মুসলমানরা প্রায় সমগ্র বিশ্ব শাসন করেছিলো। অথচ মুসলমানরা আজ ক্বুরআন গবেষণা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে বিশ্বের মুসলিম সমাজ পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ফিলিস্তিন, কাশ্মিীর, আরাকান, আন্দামান, আফগান, ইরাক, চেচনিয়া, সিরিয়া, লিবিয়াসহ সমগ্র মুসলিম জাতি আজ ঘোষিত-অঘোষিত পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। এই ত্রাহী ত্রাহী অবস্থা থেকে নাজাত পাওয়ার একটি মাত্র পথ, তা হলো বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.) এর ওপর নাযিলকৃত জান্নাতী সওগাত আল-ক্বুরআনুল কারীমের সুগভীর অধ্যয়ন ও গবেষণা।
তাই আমাদেরকে ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না । আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চূড়ান্ত শিখরে আরোহণের মাধ্যমে জাতিকে এ দুর্যোগের মুকাবিলায় সাহসী ভূমিকা রাখার প্রয়াস চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে আধুনিকতাকে বর্জন করে নয় বরং তাকে সাথে নিয়ে অর্থাৎ তথ্য-প্রযুক্তির সমস্ত মাধ্যম (স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, রেডিও, টিভিসহ আধুনিক সকল গণমাধ্যম, সামাজিক মিডিয়া, পারমানবিক শক্তিসহ সকল বৈজ্ঞানিক শক্তি) কে ক্বুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলাম ও মুসলমানদের সার্বিক কল্যাণে কাজে লাগানোর মাধ্যমে হতাশায় নিমজ্জিত অবসাদগ্রস্থ মুসলিম জাতির হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে। তবেই বিশ্বনবী ও তার সহচরদের রেখে যাওয়া ইসলামের সঠিক সংরক্ষণ সম্ভব।
আধুনিক বিশ্বের মুকাবিলায় আধুনিকতার ধাঁচে আমাদের গড়ে উঠতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্বনবীর রেখে যাওয়া ক্বুরআন ও হাদীসের যথাযথ অনুসরণ-অনুকরণ প্রয়োজন। বিশ্বনবী তৎকালীন সবচেয়ে আধুনিক ব্যক্তিত্বছিলেন। কেননা তিনি ক্বুরআন দিয়ে তার গোটা চরিত্রটা সাজিয়েছিলেন । তাঁর আদর্শের যথাযথ অনুকরণের মাধ্যমেই আল-ক্বুরআন ও আধুনিকতার সমন্বয় ঘটানো সম্ভব।