পেছনের পর্বে আমরা দেনমোহর নিয়ে আলোচনা করেছি, এই সংখ্যায় বিয়ের কথা পাকাপাকি হওয়ার যেসব অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড চালু রয়েছে সে বিষয় আলোচনা করবো ইনশা আল্লাহ।
কথা পাকাপাকি হলে বিয়ের দিন ধার্য হবে। তবে কেবল ধার্য করার জন্য ঘটা ও আড়ম্বরপূর্ণ মজলিস করা এবং রাজকীয় পান-ভোজনের বিপুল আয়োজন করা অপব্যয়ের পর্যায়ভুক্ত। বরপক্ষের উচিত, তা খেয়াল রাখা এবং সর্বোত্তম খাওয়ার ব্যবস্থা না হলে দুর্নাম না করা। কেবল মাত্র একজন লোক গিয়ে অথবা না গিয়ে টেলিফোনের মাধ্যমেও বিয়ের দিন ঠিক করা যায়। নিজেদের সুবিধা মতো যে কোন দিনে যে কোন মাসে দিন স্থির করতে কোন বাধা নেই। আল্লাহর দিন সবই সমান। পঞ্জিকা দেখে শুভাশুভ দিন বিদআত এবং বিজাতির অনুকরণ।
নিমন্ত্রণ করার সময় নিমন্ত্রণ পত্রের কোণে হলুদ লাগিয়ে দেওয়া বিদআত। এতে কোন শুভলক্ষণ আছে বলে মনে করা শির্ক।
এরপর পৃথক করে হলুদ মাখার কাপড় পাঠানো এবং বিবাহ-বন্ধনের ৫/৭ দিন পূর্বে কনের বাড়ি ‘লগন’ পাঠানোর প্রথা ইসলামী প্রথা নয়। তারপর এর সঙ্গে যায় বরের ভাই-বন্ধু ও বুনাইরা। সাজ-পোশাক, প্রসাধন সামগ্রীর সাথে পুতুল জরুরি, অনেকে পাঠায় লুডু এবং তাসও! তার সাথে চিনি, পান-সুপারি, মাছ, মুদ্রা , হলুদ মাখার শাড়ি তো থাকবেই। এই ‘লগন-ধরা’ ও মুখ দেখার অনুষ্ঠান এক ব্যয়বহুল ব্যাপার। এতে যা খরচ হয় তা একটা ইসলামী বিবাহ মজলিসের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু হায় রে! কান খোলানকুচি দিয়ে মললেও তাতে নিজের ব্যথা কোথায়?
দিনের শেষে অনুষ্ঠিত হয় মুখ দর্শনের অনুষ্ঠান। পাত্রীকে সুসজ্জিত করে ‘আলম তালা’র (পাত্র-পাত্রী বসার জন্য বিশেষ সুসজ্জিত বিছানা বা) আসনে বসানো হয়। এরপর অঙ্গরাগে সজ্জিত সেই চেহারা দেখে পাত্রের ঐ ভাই-বন্ধুরা। আঙ্গুলে বা টাকায় চিনি নিয়ে পাত্রীর অধরে স্পষর্শ করে! অঙ্গুরীয়র উপহার সুসজ্জিত আঙ্গুলে পরিয়ে দেয়, ঘড়ি পরিয়ে সুদর্শন হাতখানি টেনে! এর ফাঁকে দু’চারটি ঠাট্টা-উপহাস তো চলেই। কারণ এরা দেবর, নন্দাই, বন্ধু উপহাসের পাত্র তাই!
অতঃপর সুগোল কব্জিখানিতে সুতো বাঁধে, ললাটে গলায় হলুদ বাঁধা এবং হাতে দেয় জাঁতি বা কাজললতা! অথচ এদেরকে চেহারা দেখানোও হারাম। প্রিয় নবী (সা.) সত্যিই বলেছেন: “লজ্জা না থাকলে মনে যা চায় তাই করতে পারে” (বুখারী ৩৪৮)
প্রকাশ থাকে যে, এরপর থেকে হাতে বা কপালে সুতো বেঁথে রাখা ও কাজলরতা বা জাঁতি সর্বদা সাথে রাখা বিদআত। বরং এর মাধ্যমে যদি কোন মঙ্গলের আশা করা হয় তবে তা শির্ক।
পাত্র-পাত্রীকে বিয়ের আগের দিনগুলিতে বাড়ির বাইরে যেতে না দেওয়া। এই দিনে মসজিদে বা পীরের খানকায় সিন্নি বিতরণ করা প্রভৃতি বিদআত ও শির্ক।
এবার রইলো গায়ে হলুদ, তেল চাপানো, সাতুশী ও নাপিতের নখ কাটা প্রভৃতি প্রথা। তেল চাপানো সধবা নারী হতে হবে। বিধবা আসতে পারবে না। নির্দিষ্ট কাপড়ে কাবা মুখে বসিয়ে হলুদ মাখবে। কাপড়ে লিখা থাকবে পাত্র-পাত্রীর নাম। পাত্রকে এমন মহিলারা হলুদ মাখাবে যাদের ঐপাত্রকে দেখা দেওয়া হারাম! পাত্রের এমন অঙ্গে (জাঙ্গে, নাভীর নিচে) হলুদ মাখায় যে অঙ্গ পুরুষকে দেখানোও হারাম! আলোচিত প্রথা কি ইসলামের প্রথা হতে পারে?
পক্ষান্তরে পুরুষ রং ব্যবহার করতে পারে না। তাই হাতে পায়ে মেহদী লাগাতে পারে না। হলুদ ব্যবহার করাও তার জন্য শোভনীয় নয়। বিশেষ করে হলুদ রঙের পোশাক পুরুষের জন্য নিষিদ্ধ।
একদা সাহাবীর গায়ে হলুদ রঙ দেখে রাসূল (সা.) বুঝেছিলেন, তিনি নব বিবাহিত। (বুখারী ও মুসলিম) প্রকৃত পক্ষে সেটা হলুদের রঙ ছিলো না, বরং স্ত্রীর দেহের (মহিলাদের ব্যবহার্যের একপ্রকার সুগন্ধি) ‘খালুক’ এর রঙ, যা তার কাপড়ে লেগেছিলো। (ফাতহুল বারী ৯/১৪৪) সুতরাং এটাকে পাত্র-পাত্রীর হলুদ মাখার বৈধতার দলীল মানা যায় না। হ্যাঁ তবে যদি কেউ দেহের রঙ ‘কাঁচা সোনার মত উজ্জ্বল’ করার উদ্দেশ্যে নিজ হাতে মেখে ধুয়ে ফেলে তবে সে কথা ভিন্ন। তাছাড়া বিয়ের পাত্র-পাত্রীর জন্য এই দিয়ে ‘লগন’ শুরু করা বিদআত। অবশ্য পাত্রী হাতে পায়ে মেহদী ব্যবহার করতে পারে। বরং মহিলাদের হাতে সর্বদা মেহেদী রাখাই বিধি সম্মত। (মিশকাত: ৪৪৬)
এর রাতে ক্ষীর মুখে দেওয়ার দেশাচার। সাধারণত এ প্রথা পাশ্ববর্তী পরিবেশ থেকে ধার করা বা আমদানী করা প্রথা। রাসূল (সা.) বলেন: ‘যে ব্যক্তি যে জাতির অনুকরণ করে, সে তাদেরই দলভুক্ত ’। (মিশকাত: ৪৩৪)
তা ছাড়া এমন মহিলারা পাত্রর ওষ্ঠাধর স্পর্শ করে, তার মুখে ক্ষীর-মিষ্টি দেয়, যাদের জন্য ঐ পাত্রকে দেখা দেওয়াও হারাম। অনেক সময় উপহাসের পাত্রী (?) ভাবী, নানাী, হলে হাতে কামড়ও দেওয়া হয়! বরং পাত্রও ভাবীর মুখে তুলে দেয় প্রতিদানের ক্ষীর! অথচ এই স্পর্শ থেকে তার মাথায় সুচ গেঁথে যাওয়াও উকত্তম ছিলো। (সিলসিলা সহীহা: ২২৬) অনুরূপ করে পাত্রীর সাথেও তার উপহাসের পাত্ররা! বরং যে ক্ষীর খাওয়াতে যায়, তার সাথেও চলে বিভিন্ন মস্করা।
আর সাথে চলে ‘গীত-পার্টি’ যুবতীদের গীত। শুধু গীতই নয় বরং অশ্লীল গীতও হাত তালিসহ ঢোল-বাদ্য বাজিয়ে গীত। এর সঙ্গে থাকে ‘লেডি ড্যান্স’ বা নাচ। আর শেষে বিভিন্ন অশ্লীল ও অবৈধ অভিনয় বা কাপ। এমন পরিস্থিতি দেখে শুনে প্রত্যেক রুচিবান মুসলিম তা ঘৃণা করতে বাধ্য। কিন্তু বহু রুচিহীন অভিভাবক এসব দেখে-শুনেও শুধু এই বলে ভ্রƒক্ষেপ করে না যে, ‘আম কালে ডোম রাজা, বিয়ে কালে মেয়ে রাজ।’ ফলে ইচ্ছা করে অনুগত প্রজা হয়ে তাদেরকে নিজ অবস্থায় ছেড়ে দেয় অথবা মেয়েদের ধমকে বাধ্য হয়েই চুপ থাকে। তাই নিজ পরিবারকে নির্লজ্জতায় ছেড়ে দিয়ে বাড়ির বাইরে রাত কাটাতেও লজ্জা করে না। অথচ ‘গৃহের সমস্ত দায়িত্ব সম্পর্কে কিয়ামতে গৃহকর্তার নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (মিশকাত: ৩৬৮৫)
এই ধরণের অসার ও অশ্লীল মজলিসে কোন মুসলিম নারীর উপস্থিত হওয়া এবং ক্ষীর খাওয়ানো নিঃসন্দেহে হারাম। যেমন মহিলাদের এই কীর্তিকলাপ দর্শন করা বা নাচে ফেরী দেওয়া পুরুষদের জন্য বিশেষভাবে হারাম। এমন নাচিয়েকে ফেরি দেওয়ার বদলে তার কোমর ভেঙ্গে দেওয়া উচিত তার অভিভাবকের।
আইবুড়ো বা থুবড়া ভাতের (অবিবাহিত অবস্থায় শেষ অন্নগ্রহণের) অনুষ্ঠানও বিজাতীয় প্রথা। এই দিনে ক্ষীর-সিন্নি বিতরণও বিদআত। বরং পীরতলায় বিতরণ শির্ক। আর এই দিন সাধারণত পাকান বা বাতাসা বিতরণ (বিক্রয়ের) দিন। যাদেরকে এই পাকান বা বাতাসা দেওয়া হবে তাদেরকে পরিমাণ মতো টাকা দিয়ে ‘ভাত’ খাওয়াতেই হবে। না দিলে নয়। এই লৌকিকতায় মান রাখতে গিয়েও অনেকে লজ্জিত হয়। সুতরাং এসব দেশাচার ইসলামের কিছু নয়।
তারপর আসে তেল নামানোর পালা। ঝোমর ডাল হয় পাত্র পাত্রীকে কেন্দ্র করে হাত তালি দিয়ে গেয়েও ও প্রদক্ষিণ করে।
এ ছাড়া আছে শিরতেল ঢালার অনুষ্ঠান। সধবাদের হাতের উপর, সবার উপর নোড়া, তার উপরে তেল ঢালা হয় এবং পাত্রীর মাথায় গড়িয়ে পড়ে। এই সঙ্গে আরো কি মেয়েলি কীর্তি। তা ছাড়া এ প্রথা সম্ভব শিবলিঙ্গ পূজারীদের। কারণ, অনেকেই এই প্রথাকে ‘শিবতেল ঢালা’ বলে থাকে। তা ছাড়া এর প্রমাণ হলো শিবলিঙ্গের মত ঐ নোড়া।
সুতরাং যে মুসলিম নারীরা মূর্তিপূজকদের অনুরূপ করে তারা রাসূলের বাণীমতে ওদেরই দলভুক্ত। আর এদের সঙ্গে দায়ী হবে তাদের অভিভাবক ও স্বামীরাও।
এই দিনগুলিতে ‘আলম তালায়’ বসার আগে পাত্র-পাত্রীর কপাল ঠেকিয়ে আসনে বা বিছানায় সালাম বিদআত। কোন বেগানা (যেমন বুনাই প্রভৃতি) কোলে চেপে আলম তালায় বসা হারাম। নারী-পুরুষর (কুটুম্বদের) অবাধ মেলা-মেশা, কথোপকথন মজাক, ঠাট্টা, পর্দাহীনতা প্রভৃতি ইসলাম বিরোধী আচরণ ও অভ্যাস। যেমন রঙ ছড়াছড়ি করে হোলী ও কাদা খেলা প্রভৃতি বিজাতীয় প্রথা। এমন আড়ম্বর ও অনুষ্ঠান ইসলামে অনুমোদিত নয়।
সুতরাং মুসলিম সাবধান! তুলে দিন ‘আলম তালা’ নামক ঐ রথতালাকে পরিবেশ হতে। পাত্র-পাত্রীও সচেতন হও! বসবে না ঐ রথতলাতে। ক্ষীর খাবে না এর-ওর হাতে। কে জানে ওদের হাতের অবস্থা কি? ছিঃ!