Main Menu

ভালোবাসা পেতে হলে

ভালোবাসা পেতে হলে

ভালোবাসা পেতে হলে

পূর্বে প্রকাশিরে পর

পর্ব : ৩

জাহান আর জেসমিন এর সংসারটার কথাই বলা যায়। শিক্ষা সম্পদ, রূপ, গুণ কি ছিল না ওদের? সোনার টুকরোর মতো চারটি সন্তান। সব থাকা সত্ত্বেও শুধু  Sacrifice  আর compromise  এর অভাবে ভেঙ্গে গেলো সংসারটা। দুজনেই দুজনার জেদের উপর অটল হয়ে। ওদের কি উচিত ছিল না শুধু সন্তানদের মুখ চেয়ে পরস্পরকে Sacrifice করা? একটা সমঝোতায় আসা?
জাহান খুবই সুন্দর, সুঠাম, বলিষ্ট, শিক্ষিত মার্জিত ধার্মিক এবং বুদ্ধিমান একজন পুরুষ। আর জেসমিন জাহানের চেয়েও ধার্মিক বুদ্ধিমতি এবং অপরূপা সুন্দরী একজন মহিলা। এই চারটি সন্তান হওয়ার পরও ওর সৌন্দর্যের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকেই এরা কেউ কাউকে Sacrifice করতে পারেনি তাই এরা কোনোদিন সমঝোতায়ও আসতে পারেনি। এদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়নি আঠারো বছর একসাথে থাকার পরও। এরা দু’জন মানুষই খুব স্বার্থপর। সন্তানের সুখ শান্তি আর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ওরা থাকতে পারতো। জাহান নির্লজ্জের মতো শুধু নিজের সুখের জন্য আর একটা বিয়ে করল আর জেসমিন চারটি সন্তানই রেখে চলে গেলো। কি জানি সন্তানদের জন্য ওর কষ্ট হয় কিনা। জাহানের চেয়েও ধনী লোকের সাথে জেসমিনের বিয়ে হয়েছে। জাহান তো আগেই বিয়ে করেছে জেসমিনের চেয়ে চমৎকার একটি মেয়েকে। শুধু সন্তান কয়টি মা হারা হয়েছে।
এইখানে জেসমিন একটু Sacrifice করলেই সংসারটা টিকে থাকতো। আমার এই লেখায় অনেকেই মনক্ষুন্ন হবেন। হয়ত বলবেন “জাহান Sacrifice করতে পারলো না। শুধু মেয়েরাই Sacrifice করবে কেন? হ্যাঁ জাহানও একটু ছাড় দিতে পারতো কিন্তু জেসমিনদের ছাড় দেওয়া উচিত বেশি। কারণ জাহানদের তো ঘর-সংসার সন্তান রেখে চলে যেতে বাধ্য হতে হয় না। জেসমিনদের তো বাধ্য হতে হয় সন্তান রেখে চলে যেতে।
সম্প্রতি টাংগাইলের ভুয়াপুরের নববিবাহিতা দুইজন মেয়ের সাথে পরিচিত হয়েছি। দুটি মেয়েই উচ্চ শিক্ষিতা, চাকুরিজীবি।
একজনের নাম মমতা। মমতা অতি অল্প দিনের মধ্যেই শ্বশুড়, শাশুড়ী, দেবর, ননদদের তার মমতা আর Sacrifice দিয়ে আপন করে নিয়েছে। মমতার শাশুড়ী বলে “আমি বুঝতে পারিনা কাকে বেশি ভালোবাসী আমার মেয়ে কবিতাকে না আমার পুত্রবধূ মমতাকে।” মমতার স্বামীর কথা আর কি বলব? আমার দৃঢ় বিশ্বাস মমতার সংসারে কোনোদিন অশান্তি আসবেনা। ইন্শা আল্লাহ।
আর একজন শিউলি। শিউলী কলেজে চাকুরী করে। শিউলির মায়ের আর কেউ নেই  তাই মায়ের কাছে থাকে। আর এই মায়ের কাছে থাকাটা শিউলির শ্বশুর বাড়ীর কেউ পছন্দ করে না, স্বামীও না। এই নিয়েই প্রথম অশান্তি। এই অশান্তি থেকে আরও অনেক অশান্তির জন্ম। শিউলী আর ওর স্বামী ওরা যে কোনো একজন যদি Sacrifice না করে, একটা সমঝোতায় আসতে না পারে তাহলে এই সংসার টিকবে না। ওদের উচিত হবে হয় নিজের স্বার্থ কিছু ত্যাগ করে সমঝোতার মাধ্যমে সংসার করা না হয় একটা সন্তান আসার আগেই পরস্পর আলাদা হয়ে যাওয়া। এই ভাবে ঝুলে থেকে দু’জনের জীবনকেই দুর্বিসহ করে তোলার কোনো মানে নেই। এখানে ইসলাম ওদের জন্য বিরাট স্বাধীনতা দিয়েছে। বনিবনা না হোক ওদের সারাজীবন এক সাথে থাকতে হবে, এমন নির্দেশ ইসলাম দেয় না। ইসলাম শান্তির ধর্ম। শান্তি দিতে চায় মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতে। এক বছর একত্রে থাকার পরও যদি পরস্পরের দোষগুলোই শুধু পরস্পরের কাছে ফুটে ওঠে গুণ মোটেও ধরা  না পরে তাহলে একত্রে থাকা উচিত না।
রাসূল (সা.) এর জামানায় বিয়ের পরদিন ই জামিলা নাম্মি এক সুন্দরী মহিলা সাহাবী হাজির হলেন রাসূল (সা.) এর আদালতে বললেন “ইয়া রাসূলুল্লাহ আমাকে তালাক করায়ে দেন।”
রাসূল (সা.) বললেন “কেন সাবিত কি ভালো লোক নয়? সে কি গরীব?”
জামিলা বললেন “হে আল্লাহর রাসূল! সাবিত চরিত্রবান ধার্মিক এবং একজন ধনী লোক। কিন্তু সাবিত কে দেখে আমার পছন্দ হয়নি। আমাকে জোর করে তার সাথে থাকতে বাধ্য করলে আমি আল্লাহর নাফরমানিতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছি।”
রাসূল (সা.) বললেন “তাহলে সাবিত তোমাকে যে বাগানটি দিয়েছে তা ফেরৎ দিতে হবে।” জামিলা বললেন,“বাগানতো ফেরৎ দেবই আপনি যদি বলেন তো আরও বেশি কিছু দিয়ে দেব।” রাসূল (সা.) সাবিতকে ডেকে তালাক করায়ে দিলেন।
স্ত্রীর পছন্দ না হওয়ার কারণেই বিখ্যাত সাহাবী যায়েদ বিন হারেসার সাথে জয়নাব বিনতে জাহাশের বিবাহ বন্ধন টেকে নি। অথচ বিয়েটা দিয়েছিলেন রাসূল (সা.) নিজে পছন্দ করে। হযরত আয়েশা সিদ্দিকার আযাদকৃত দাসী বারিরাহ’র ঘটনাটাও এমনি। আযাদ হওয়ার পর বারিরাহ তার কৃতদাস স্বামীকে তালাক দেয়। বারিরাহ’র স্বামী কাঁদতে থাকে। রাসূল (সা.) এর কাছে করুন মিনতি জানায়। রাসূল (সা.) বারিরাহকে বলেন,“তালাক না দিলেই কি হয় না?”
বারিরাহ বলেন, “একি আপনার নির্দেশ?” রাসূল (সা.) বললেন “আমার নির্দেশ নয়, আমি বেচারার পক্ষ হয়ে ওকালতি করছি।”
বারিরাহ বললেন, আপনার নির্দেশ যদি হয় তাহলে আমি তালাক দেওয়া থেকে বিরত থাকব। না হলে তাকে আমার দরকার নেই।”
অতএব পছন্দ না হলে, খাপ খাওয়াতে না পারলে রুচিতে না চাইলে, বনিবনা না হলে, পরস্পরকে ভালোবাসতে না পারলেÑবিয়ে হয়েছে বলেই যে একসাথে থাকতে হবে, জীবন বিষিয়ে তুলতে হবেÑযন্ত্রণায় জর্জরিত হতে হবে। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির পথ নেই এমন কথা ইসলাম বলেনা।
অথচ আমাদের সমাজে মেয়েদের পছন্দ অপছন্দের মূল্য খুব কমই দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেদের পছন্দের মূল্যও দেওয়া হয়না। আত্মীয় স্বজনের পছন্দের মূল্য দিতে গিয়ে সংসারটাকে স্থায়ী জাহান্নামে পরিণত করে। পরবর্তীতে কঠিন কষ্টে নিক্ষিপ্ত হয় কয়েকটি নির্দোষ নিস্পাপ শিশু।
এই বাংলাদেশের একজন জামিলার কথা বলি। বিয়ের পর থেকেই বনিবনা হচ্ছিল না তথাকথিত স্বামী নামের ব্যক্তিটির সাথে। চৌদ্দ বছরের জামিলার পুকুর পাড়ে বসে কচুরির ফুল দেখতে ভালো লাগতো, রাজহাঁসের সাথে সাতার কাটতে ইচ্ছে হতো। জোসনা দেখতে, রাতের তারা দেখতে ভালো লাগতো ভালো লাগতো ধানের ক্ষেতে বাতাসের ঢেউ দেখতে। ভালো লাগতো গল্প উপন্যাস পড়তে, কবিতা পড়তে। মাঝে মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লিখতো জামিলা। আর এসব অনাসৃষ্টি কাজ কারবার জামিলার স্বামী শাশুড়ী একদম পছন্দ করত না। শাশুড়ীর কাছে প্রচুর বকা ঝকা এমন কি স্বামীর কাছে মার খেতে হয়েছে এই জমিলাকে। জামিলা কিছুতেই মন বসাতে পারে নি এই সংসারে। মা বাবার কাছে বলেছে তার সমস্যার কথা কিন্তু তার সমস্যাকে কেউ সমস্যাই মনে করেনি। জামিলার মামী চাচী ভাবীরা জামিলার ই দোষ দিয়েছে সংসার করার অযোগ্য বলে।
এই ভাবেই কেটে গেছে তার জীবনের নিষ্প্রাণ দিনগুলো। এখন জামিলা বেগমের বয়স ৬০/৬২ বছর। তার কবিতা এখনও মরে যায়নি মাঝে মাঝে এখনও তিনি কবিতা লেখেন আর তার স্বামী দেখলেই বলেন,“বুড়া কালেও তোমার ঢং গেল না ”
সে দিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম রাসূল (সা.) বলেছেন “ঐ পুরুষ উত্তম যে তার স্ত্রীর বিবেচনায় উত্তম।”  তিরমিযী মানে স্ত্রী যদি সাক্ষ্য দেয় যে তার স্বামী ব্যক্তিটি ভালো মানুষ তাহলেই ঐ পুরুষ সমাজে এবং আল্লাহর কাছে ভালো বলে গৃহিত হবে।”
জামিলা বেগম বললেন “ আমাকে যদি আল্লাহ পাক মৃত্যুর পরে জিজ্ঞেস করেন, তোমার স্বামী কেমন লোক ছিল? আমি বলব ‘মাবুদ গো আমি তাকে কোনোদিন নামায কাজা করতে দেখি নাই, রোজা ভাংতে দেখি নাই তোমার জান্নাতের সর্বোচ্চ দরজাটা তারে দিও।” বলেই দুই হাত জোড় করে আবার বললেন “শুধু মাবুদ মাওলা আমারে ওর সাথে জুড়ে দিওনা। দুনিয়াতে আমারে ওর সাথে জুড়ে দিয়েছিলে আমি সারা জনম ছটফট করেছি ছুটতে পারি নাই আখেরাতে তুমি ওর সাথে আমারে দিও না আল্লাহ! শুধু জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাতের এক পাশে একটু জায়গা দিও। আমি বড় কোনো বালাখানা চাইনা আল্লাহ। শুধু ওর হাত থেকে মুক্তি চাই।”
এই মনোকষ্ট নিয়ে আমাদের দেশের অনেক জামিলারাই সংসার করে যা করতে ইসলাম তাকে বাধ্য করেনি। এ দিকে একদল আছেন যারা এর জন্য সব দোষটুকুই চাপাতে চায় ইসলামের উপর। এই মনোভাব অজ্ঞতা এবং বিদ্বেস প্রসূত। ইসলাম কখনই কারো উপর জুলুম করেনা। নারীর উপর নয় পুরুষের উপরও না। ইসলাম উভয়কে শিক্ষ দেয় Sacrifice এবং compromise  করে চলার জন্য। ইসলামের পরিভাষায় তার নাম ইহসান।
তাই রাসূল (সা.) বলেন “স্ত্রীর একটা ত্রুটি তোমার খারাপ লাগলে তার একটি গুণের দিকে তাকাও।”
শুধু দাম্পত্য জীবনেই না জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি আমরা এই মনোভাব পোষণ করতে পারিÑতাহলেই শান্তি, তাহলেই মুক্তি।
সবচেয়ে বড় কথা হলো কয়দিন বাঁচবো? আজ যে জিনিষটা খুবই প্রয়োজনীয় মনে হয়, ছয়মাস পরে পৃথিবীতে থাকতেই সেই জিনিষ আর তত প্রয়োজনীয় মনে হয় না। মরে গেলে তো আর কথাই নেই। একবার বাঁশের তৈরী খুব সুন্দর একটা জিনিষ কিনেছিলাম খুব পছন্দ করে। যতœ করে টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখলাম। সবাই জিনিষটার সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে লাগলো। আমার ছোট ননদের মেয়ে নুরজাহান জিনিষটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো। ওর দেখার ধরন দেখে আমার আশঙ্কা হলো জিনিষটা ও চেয়ে বসতে পারে। আর একবার ওর মায়ের সামনে যদি চায় তখন আমার তো আর না দিয়ে উপায় থাকবে না।
নূরজাহান একটু সরে যেতেই আমি জিনিষটা লুকিয়ে রাখলাম। কিছুক্ষণ পরে নূরজাহান তার মাকে বলতে লাগলো “মা আমি সেই জিনিষটা নেব”।
ওর মা বুঝতে না পেরে বললো “কোন জিনিষ?”
ছোট মানুষ মাকে বুঝিয়ে কথাটা বলতে পারলো না। আর আমি সব বুঝেশুনেও চুপ করে থাকলাম। দু’দিন পর নূরজাহানরা চলে গেলো। যাওয়ার সময় ও নূরজাহান বললো “মা সেই জিনিষটা নেব।” ওর মা আবার বললো “কোন জিনিষ?” এবারও নূরজাহান ঠিকমতো বলতে পারল না। ওর মা ধমক দিয়ে বললো “কোন জিনিষ ঠিকমত বলতে পারিস না শুধু প্যা প্যা করিস ক্যান?” মন খারাপ করে চুপ করে থাকল নুরজাহান।
ওরা চলে যাওয়ার পর আমিও জিনিষটার কথা একদম ভুলে গেলাম। প্রায় তিনমাস পরে মনে হলো। আমি তাড়াতাড়ি জিনিষটা বের করতে গেলাম। ধরতেই ঝুরঝুর করে ভেঙ্গে পড়ল আমার কাঁচাবাঁশের তৈরী সুন্দর জিনিষটি। আমার ছোটলোকির শাস্তি আমি এভাবেই পেলাম। লজ্জায় আর অনুতাপে মনটা ভেঙ্গে গেলো। বার বার মনে হতে লাগল, ছি! কি ছোটোমন আমার। কেন দিলাম না আমি জিনিষটা নুরজাহানকে? কয় টাকার জিনিষ ছিল ওটা? ছোট নূরজাহান বড় হয়েছে। ওর মামীর ছোটলোকির কথা নিশ্চয়ই ওর মনে নেই কিন্তু আমি ভুলতে পারি নি। সেই দিন থেকে আমার প্রয়োজনীয় কিংবা অতি পছন্দের কোনো জিনিষও যদি কেউ চায় আমার তখন সেই ছোট্ট নূরজাহানের কথা মনে পড়ে। আমি আর না বলতে পারি না।
আসলে পছন্দ, প্রয়োজন যা-ই বলি না কেন, এগুলো সবই আপেক্ষিক। আর পৃথিবীতে একান্তই নিজের বলে কোন জিনিষ নেই।

Related Post