৫ম পর্ব
জালিমকে সহযোগিতা করোঃ আল্লাহর আইন অমান্য করার ক্ষেত্রে ভাইদের সহযোগিতা করে স্বেচ্ছায় মুখ বুজে সম্পত্তি ছেড়ে দেওয়া বোনদের কোন অবস্থাতেই উচিত নয়। রাসূল (সা.) বলেছেন “মজলুমকে সাহায্য করো জালেমকেও সাহায্য করো। সাহাবিরা বললেন ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! মজলুমকে তো সাহায্য করব। জালেমকে কিভাবে সাহায্য করব? রাসূল (সা.) বললেন: জালিমকে জুলুম করা থেকে বিরত রাখবে। এটাই তাকে সাহায্য করা।” (বুখারী, আহমদ, তিরমিযী)
অতএব বোনদের উচিত ভাইদের অন্যায় আবদার অন্যায় আচরণ মুখবন্ধ করে সহ্য না করে এর প্রতিবাদ করা। অনেক বোন আবার উপায়ান্তর না দেখে বলে “আমি যদি স্বেচ্ছায় আমার ভাইকে দিয়ে দিই।” না কোনো বোনের স্বেচ্ছায় সব সম্পত্তি ভাইকে দেওয়ার অধিকার নেই। তাহলে সে নিজে ওয়ারিশ ঠকানো পাপে পাপী হবে। কারণ তার ওয়ারিশ তার সন্তানেরা এবং তার Husband. তারা যে সামান্য দুনিয়াবি স্বার্থে আল্লাহর আইন অমান্য করছে মহান রবের বিধানের অবমাননা করছে তা বোঝানো উচিৎ। বুঝলে ভালো, না বুঝলে করার কিছু নেই-তবে বোনের পাওনা বোনের আদায় করে নেওয়া উচিৎ। আল্লাহর বিধান মানার ব্যাপারে কোনো[dropcap color=”red” font=”times” fontsize=”25″] sacrifice[/dropcap] নেই। অন্যায়ের সাথে কোনো Compromise নেই।
আল্লাহর বিধান পালনের ক্ষেত্রে কোনো sacrifice বা Compromise নেইঃ-
আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব প্রতিবেশী ভাই বোন প্রভৃতির সাথে বন্ধুত্ব হৃদ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য, ভালোবাসা অটুট রাখা এবং বৃদ্ধি করার জন্য sacrifice এবং Compromise করে চলতে বলেছি। ইসলামও আমাদের সেই শিক্ষা দেয়। তাই তো দেখি যুদ্ধ ক্ষেত্রে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও পিপাসার পানিটুকু নিজে পান না করে অপর ভাই এর দিকে ঠেলে দিতে। দেখি নিজে না খেয়ে মেহমানকে খাওয়াতে। নিজের চেয়ে অপর ভাইকে অগ্রাধিকার দিতে। কিন্তু আল্লাহর বিধান পালনের ক্ষেত্রে কোনো sacrifice বা Compromise নেই। আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে কোনো বান্দার সন্তুষ্টির প্রয়োজন নেই। মক্কার কাফের সর্দারেরা যখন প্রস্তাব দিল “মুহাম্মাদ! এসো তুমি কিছুদি
ন আমাদের দেবতাদের উপাসনা করো, আমরাও কিছুদিন তোমার রবের উপাসনা করি।” অর্থাৎ তুমি কিছু ছাড় দাও আমরাও কিছু ছাড় দেই। তারা একটা সমঝোতায় আসতে চেয়েছিলো।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বললেন, “হে মুহাম্মাদ! বলুন হে কাফেররা! আমি যার ইবাদত করি তোমরা তার ইবাদত করো না। তোমরা যাদের ইবাদত করো আমি তাদের ইবাদত করি না—— তোমাদের কাছে তোমার দ্বীন আর আমার কাছে আমার দ্বীন।” (সূরা: কাফিরুন)
অর্থাৎ দ্বীনের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া বা আপোস করা যাবে না। সাহাবিরা তার বাস্তব প্রমাণ দেখিয়েছেন। যেমন হযরত আনাস (রাঃ) মা উম্মে সুলাইমের বে-দ্বীন স্বামী উম্মে সুলাইমকে বললেন “তুমি যদি এই নতুন দ্বীন না ছাড় আমি তোমার সাথে থাকব না। চলে যাব দূরের কোনো দেশে।” উম্মে সুলাইম অনেক চেষ্টা করলেন স্বামীকে বোঝাতে কিন্তু হতভাগ্য স্বামী কিছুতেই হেদায়েতের বুঝল না। উম্মে সুলাইমও অটল রইলেন তার সিদ্ধান্তে। compromise করলেন না।
এমনি একটি বাস্তব প্রমান পেশ করল এই জামানার উম্মে সুলাইম অধ্যাপিকা লাবন্য। লাবন্য খুব মনে পড়ে। ভুলতে পারি না লাবন্যকে। লাবন্যর সাথে প্রথম পরিচয় আমার অসুস্থ্যতার মধ্যে। আমাকে দেখতে এসেছিল আমার বান্ধবী আক্তারুন্নেসার সাথে। প্রথম দেখাতেই মেয়েটিকে অসম্ভব ভালো লাগলো আমার। ওর দিকে তাকিয়ে মনে হলো ওর লাবন্য নামটা যথোপযুক্ত হয়েছে। স্বার্থক হয়েছে। যেনো একটা পবিত্রতা সর্বক্ষণ ঘিরে আছে ওকে। কলেজের প্রভাষক লাবণ্য। এর পর প্রায় দিনই আসত আমার সাথে দেখা করতে। কখোনো আক্তারুনন্নেসার সাথে কখোনো একা। ওর কলেজ আবার আমার বাসার কাছেই। আমার কাছ থেকে মাঝে মাঝে বই পুস্তক নিয়ে পড়ত। অসম্ভব বুদ্ধিমতি লাবন্য অল্পদিনের মধ্যেই আল্লাহপাকের বিধান খুব সহজেই বুঝে ফেললো। ইতোমধ্যে বিয়ে হয়ে গেলো লাবন্যর ওর পছন্দ করা ছেলের সাথেই। ওর Husband চাকুরী করত দূরে। মাসে একবার আসত দু’একদিন থেকেই চলে যেতো তার কর্মস্থলে। সে ওর পরিবর্তনের কিছুই বুঝতে পারল না।
আমূল পরিবর্তন হলো ওর চালচলনে। হিযাবে আবৃত করে ফেললো নিজেকে। ইসলামকে জানা মানা আর অপরের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালনে তৎপর হল লাবন্য। আমি একদিন বললাম “লাবন্য তোমার স্বামী যদি এসব করতে তোমাকে নিষেধ করে তখন কি করবে?” লাবন্য পরম আস্থার সাথে মাথা নেরে বললো “না আপা আমার Husband খুব ভালো মনের মানুষ। সে এসব পছন্দ করবে বলেই আমার বিশ্বাস যদিও কুরআন হাদীস সম্পর্কে তার তেমন ধারনা নেই।”
আশ্বস্ত হয়ে বললাম “তাহলে তো ভালোই”। অনেক চেষ্টা চরিত্র করে লাবন্য ওর ঐঁংনধহফ কে বদলী করে কাছে নিয়ে এল। কিন্তু কাছে এনে লাবন্য পড়ল চরম বিপাকে। যে পরম আস্থা নিয়ে লাবন্য বলেছিল “আমার হাসব্যান্ড খুব ভালো মনের মানুষ” সেই আস্থায় ভাঙ্গন ধরল লাবন্যর।
ভোর না হতেই উঠে নামায পড়াটা তবু সহ্য করল কিন্তু কলেজে যাওয়ার সময় হিযাব পড়তেই ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল সৌরভ “ওকি ওটা কি পরছ তুমি? তুমি জুব্বা পরছ কেন?”
মিষ্টি হেসে লাবন্য বললো “আমি মুসলমান হয়েছি——–।” কথা শেষ করতে না দিয়ে সৌরভ চেচিয়ে উঠল “তোমার মতো একজন শিক্ষিতা আধুনিকা মেয়ে মান্ধান্তার আমলের এই ড্রেস পরতে লজ্জা করলো না? খোল, খোল বলছি তোমার এই জুব্বা।”
লাবন্য বললো “তুমি কুরআন বিশ্বাস করো না, কুরআন মানো না?”
সৌরভ বললো “কুরআন বিশ্বাস করব না ক্যান? অবশ্যই কুরআন মানি কিন্তু গোড়াঁমী সহ্য করতে পারি না—।”
বিকেলে এই নিয়ে আবার ঝামেলা বেধেঁ যায়। লাবন্যকে নিয়ে বেড়াতে যাবে সৌরভ। সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে লাবন্য হিযাব পরতেই রাগে ফেটে পরে সৌরভ।
“আবার ঐ জুব্বা? ঐ জুব্বা পরে তুমি আমার সাথে যেতে পারবে না।” বলে রাগ করে ঘর থেকে বের হয়ে যায় সৌরভ। অনেক রাতে বাসায় ফেরে। রাগ করে সারারাত কথা বলে না। সকালে নাস্তা খেতে বসে বলে,“লাবন্য তোমার সাথে একটা বোঝাপড়া আছে।”
জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকিয়ে থাকে লাবন্য। সৌরভ বলে “তোমাকে যে কোনো একটা জিনিষ ছাড়তে হবে।”
কম্পিত কন্ঠে জানতে চায় লাবন্য “কি?”
“হয় আমাকে ছাড়বে না হয় তোমার জুব্বা ছাড়বে।” তোমাকে আজকের দিন ভেবে দেখার সময় দিলাম কাল সকালে তোমার সিদ্ধান্ত আমাকে জানাবে।”
লাবন্য মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলে “ঠিক আছে।”
পরদিন সৌরভ জানতে চায় সিদ্ধান্ত নিয়েছ? গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দেয় লাবন্য “নিয়েছি।”
ঃ কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ?
ঃ আমি একটাও ছাড়ব না।
ঃ ঠাট্টা মনে করেছ? আমি চলে যাব। থাক তোমার জুব্বা নিয়ে।” বলে সত্যি নাস্তা না করে বের হয়ে যায় সৌরভ।
লাবন্য কান্নায় ভেঙ্গে পরে। বারবার বলতে থাকে “প্রভূ আমাকে রক্ষা করো”।
তোমার দ্বীনের উপর অটল থাকার তৌফিক দাও।
বিকেলেই আমার কাছে এসে সব জানায় লাবন্য। বললাম লাবন্য তুমি তোমার সিদ্ধান্তে অটল থাকো। আল্লাহ তোমাকে সাহায্য করবেন। এই ব্যাপারে তো কোনো ঝধপৎরভরপব করা যাবে না বোন। আল্লাহপাক যাকে যত বেশি ভালোবাসেন তার পরীক্ষা তত বড়। “তোমার এই পরীক্ষা বিখ্যাত সাহাবী উম্মে সুলাইমের মতো। ইসলাম গ্রহণ করার অপরাধে তার স্বামী তাকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। আর উম্মে সুলাইম অটল থেকেছেন ঈমানের উপর। তার সিদ্ধান্তের উপর। লাবন্য তুমি ধৈর্য ধর-আল্লাহপাক তোমাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন। আমার বিশ্বাস তোমার ঐঁংনধহফ নমনীয় হবেন।”
হ্যা সপ্তাহ খানিকের মধ্যেই সৌরভ নমনীয় হয়েছে। লাবন্য ওকে নিয়ে একদিন বেড়াতে এসেছে আমার বাসায় আমি পর্দার এপাশ থেকে সালাম দিতেই সৌরভ বললো “আপনি কি আমার সামনে একটু আসবেন?”
বললাম ‘কেনো ভাই?’
ঃ “আমি আপনাকে একটু দেখবো।”
আবার বললাম “আমাকে দেখবে কেনো?
সৌরভ বললো “আমার এমন শিক্ষিতা স্মার্ট বউটাকে আপনি কিভাবে মৌলবাদী করে দিলেন? জুব্বা প্রেমে দেওয়ানা করে দিলেন? ও এখন আমাকে ছাড়তে পারে জুব্বা ছাড়বেনা। অথচ এমন এক সময় ছিল যখন ও আমার জন্য দুনিয়া ছাড়তে পারত।”
বললাম “ভাই আমি কিছুই করিনি-আল্লাহর তরফ থেকে আপনার স্ত্রী হেদায়েত পেয়েছেন। আমি তো শুধু দাওয়াত দিয়েছি মাত্র। সে গ্রহণ না করলে আমার কিছু করার ছিল না। হেদায়েতের মালিক মহান আল্লাহ বারী তায়ালা।
আমি কিছু নাস্তা ওপাশে পাঠালাম।
সৌরভ বললো “আপনার দেওয়া নাস্তা আমি খাব না।
বললাম “কেন খাবেন না?”
- “খাব না কি জানি কি যাদু মন্ত্র তুক-তাক করে দিয়েছেন এর মধ্যে। এসব খেয়ে হয়ত দেখা যাবে আমিও জুব্বা পরতে শুরু করেছি।”
- তুক-তাক যখন বিশ্বাস করেন, মনটা তো তাহলে কুসংস্কারেই আচ্ছন্ন আছে কি বলেন?
সৌরভ বললো “আপনার ভেতর কি যেনো এক সম্মোহনী পাওয়ার আছে। কারণ আপনার প্রতি যে রাগ আর অসন্তোষ নিয়ে আমি এসেছিলাম তা নিজের ভেতর কেনো যেনো আর খুঁজে পাচ্ছিনা।
মনে হচ্ছে আপনি যাদু জানেন। আপনার বাসায় আসাও আসলে নিরাপদ না।
বললাম “সৌরভ আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি? আমার প্রভাবেই যদি আপনার স্ত্রী কুরআনের পথে আসে, পর্দা করতে শুরু করে এতে কি আপনি লাভবান হচ্ছেন না? রাসূল (সা.) বলেছেন “দাইউস কখোনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আর দাইউস হলো ঐ পুরুষ যে তার স্ত্রী কন্যাকে পর্দায় রাখে না। আমি আপনার বেপর্দা স্ত্রীকে যদি পর্দায় এনে থাকি তাহলে কি আপনাকে দাইউস হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করলাম না? আপনার তো আমার উপর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। সৌরভ আমি যদি বলি আপনাকে আমি ভালোবাসি আপনি কি বিশ্বাস করবেন?”
সৌরভ বললো “না” বললাম “কেনো বিশ্বাস করবেন না?”
- “প্রথম কথা আপনি আমাকে চেনেন না। দেখেন নি। এমনকি যেটুকু পরিচয় হয়েছে তাতে প্রমাণ হয়েছে আমি আপনার আদর্শের ঘোর বিরোধী। অতএব আপনি আমাকে ভালোবাসতেই পারেন না।
বললাম“ লাবন্যর সাথে আমার পরিচয় প্রায় চার বছরের। শুধু হৃদ্যতা বললে ভুল হবে লাবন্যর কাছে জেনে নেবেন ও আমাকে কি পরিমাণ ভালোবাসে আর ভালোবাসা নিশ্চয়ই এক তরফা হয়না। আর লাবন্য আপনাকে ভালোবাসে তো ওর জীবনের চেয়েও বেশি। আপনাকে এখানে বদলী করে আনার জন্য লাবন্যর কি পেরেশানি ছিল তা আপনি জানেন না। আমি লাবন্যকে ভালোবাসি আর আপনি লাবন্যর জীবন। এই জন্য আপনাকে না দেখলেও আমি ভালোবাসি। আপনি যাতে বদলী হয়ে এখানে আসতে পারেন, আপনি যেনো সুস্থ্য থাকেন এর জন্য কতোদিন নামাজের পরে দোয়া করেছি। ভালো না বাসলে তার জন্য দোয়া করা যায়?
যেমন এখনও দোয়া করছি আল্লাহপাক যেনো আপনাকে সঠিক বুঝ দেন, আপনি যেনো সত্য মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে পারেন। আপনি যেনো ভালো থাকেন দুনিয়া ও আখেরাতে।”
সৌরভ একটু চুপ করে থেকে অন্য প্রসঙ্গে গেলো।
বললো “আপনার বই এর কালেকশন তো খুব ভালো। রবীন্দনাথ, জীবনান্দ দাশ-তার মধ্যে মওদুদী, গোলাম আযম। আপনার দুই একটা বই নিতে পারি?
বললাম “অবশ্যই?”
সৌরভ বেছে বেছে দুটি বই নিল। দুটিই গোলাম আযম সাহেবের। একটা ‘আমার দেশ বাংলাদেশ।’ আর একটা কি তা এতো দিন পরে মনে নেই। আর আমি আমার পছন্দের বই নামায রোজার হাকিকত খানা ওকে দিলাম। ‘আমার দেশ বাংলাদেশ’ বইখানা তুলে নিয়ে বললো “এই যে গোলাম আযম বলছে ‘আমার দেশ’ এর চেয়ে তামাশার কথা আমার দৃষ্টিতে আর নেই।”
লাবন্য শরিয়তের ব্যাপারে একটুও ছাড় দেয়নি। একটুও Compromise করে নি। আজও টিকে আছে ওর দ্বীন ও ঈমান নিয়ে। আল্লাহপাক তো বলেছেন, “আমি ঈমান এনেছি একথা বললেই কি ছেড়ে দেব? আল্লাহকে তো পরীক্ষা করে দেখতে হবে, ঈমানের দাবীতে কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যাবাদী। (সুরা আনকাবুত)