ভূমিকা: সমস্ত প্রশংসা মহান রাব্বুল আলামীনের জন্য, যিনি তার শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠ উম্মাতকে উপহার দিয়েছেন অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ মাস রমযানুল মোবারক। এ মাসেই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়েছে। রমযান মাসে সিয়াম সাধনায় মহান আল্লাহর অনন্ত অসীম রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। তাই তো রমযানের আগমনে আল্লাহ প্রেমিক বান্দার অন্তরে এক অনাবিল আনন্দধারা প্রবাহিত হয়। সকল ঈমানদারেরা শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে এই পবিত্র মাসটি অতিবাহিত করে। মুসলিম উম্মাহর জন্য রমযান অত্যন্ত কাঙ্খিত ও প্রাপ্তির মাস। এ মোবারক মাসে রাব্বুল আলামীন লাইলাতুল কদর নামে এমন এক মহামূল্যবান ও মহিমান্বিত রজনী আমাদের দান করেছেন, যা ইতিপূর্বে কোন উম্মাতকে দেয়া হয়নি। লাইলাতুল কদর এমন একটি রজনী যা হাজার মাস (ইবাদত) অপেক্ষা উত্তম।
কদর নামের তাৎপর্য : লাইলাতুল কদরকে কদর নামে কেন অবহিত করা হয়েছে এ বিষয়ে কয়েকটি বিশ্লেষণ পাওয়া যায়।
এক, কদর শব্দটির এক অর্থ হচ্ছে সম্মান, মহিমান্বিত, যেহেতু এ রাতটি সম্মানিত রাত। এ রাতে আল্লাহ তা’আলার সম্মানিত ফেরেশতাগণ জিবরাঈল -সহ জমিনে আগমন করেন। এ রাতে ইবাদত করলে হাজার মাসের চেয়ে বেশি ইবাদতের সওয়াব পাওয়া যায়। এই সম্মান ও মাহাত্ম্যের জন্যই এ রাতের নামকরণ করা হয়েছে লাইলাতুল কদর বা মহিমান্বিত রাত।
দুই, পূর্ববর্তী উম্মতদের শত-শত বছর বেঁচে থেকে ইবাদত করার অবকাশ ছিল। কিন্তু শেষ নবীর উম্মতগণ অল্প হায়াত পাওয়ার কারণে পূর্ববর্তী উম্মতদের মতো ইবাদত করে সওয়াব অর্জন করতে পারে না। তাই তাদের জন্য কদরের রাতকে হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম করা হয়েছে। যাতে এই রাতে ইবাদত করে হাজার মাসের ইবাদতের সওয়াব লাভ করতে পারে।
তিন, কদর শব্দটির এক অর্থ হচ্ছে নির্ধারণ করা। যেহেতু এই রাতে আল্লাহ তা’আলা বান্দাদের অনাগত বছরের আয়-রোজগার, সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি বিষয়ে একটি বাজেট ঘোষণা করেন। এ জন্যই এ রাতকে লাইলাতুল কদর বা ভাগ্যনির্ধারণের রাত বলা হয়।
সূরা কদরের শানে নুযুল : ইবনে আবী হাতেম (রহ.)-এর রিওয়ায়াতে আছে, রাসূল (সা.) একবার বানী-ইসরাঈলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। সে এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জিহাদে মশগুল থাকে এবং কখনও অস্ত্র সংবরণ করেনি। মুসলমানগণ একথা শুনে বিস্মিত হলে এ সূরা কদর অবতীর্ণ হয়। এতে এ উম্মতের জন্য শুধু এক রাত্রির ইবাদতই সে মুজাহিদের এক হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ইবনে জারীর (রাহঃ)-এর অপর একটি ঘটনা এভাবে উল্লেখ করেছেন যে, বানী-ইসরাঈলের জনৈক ইবাদতকারী ব্যক্তি সমস্ত রাত ইবাদতে মশগুল থাকত ও সকাল হতেই জিহাদের জন্যে বের হয়ে যেত এবং সারাদিন জিহাদে লিপ্ত থাকত। সে এক হাজার মাস এভাবে কাটিয়ে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই আল্লাহ তা’আলা সূরা কদর নাযিল করে এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। এ থেকে আরও প্রতীয়মান হয় যে, লাইলাতুল কদর উম্মাতে মুহাম্মাদীরই বৈশিষ্ট্য।
লাইলাতুল কদরের ফযীলত ও মর্যাদা : মহান রাব্বুল আলামীন বিশ্ব মানবের হিদায়াত ও পথ নির্দেশিকা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এ রজনীতেই লাওহে মাহ্ফুজ থেকে প্রথম আসমানে সম্পূর্ণ রূপে অবতীর্ণ করেছেন। অতঃপর সুদীর্ঘ তেইশ বছর যাবৎ প্রয়োজন অনুসারে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.) -এর প্রতি অবতীর্ণ করেছেন। (ইবনে কাসীর) দুনিয়ার বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্যবান ও মর্যাদাপূর্ণ রজনী হলো কদরের রজনী। এ রজনীর গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে উম্মতে মুহাম্মদীকে অবহিত করানোর জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন “সূরা কদর” নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা অবতীর্ণ করেছেন। এ সূরায় উম্মতে মুহাম্মদীকে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। এই একটি রাতের ইবাদত হাজার মাস ইবাদতের চেয়েও উত্তম বলে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে।
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা.) বলেছেন : যে ব্যক্তি কদরের রাতে পূর্ণ বিশ্বাস ও সওয়াবের নিয়্যাতে ইবাদত করবে তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (বুখারী)
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার রমযান মাসের আগমনে রাসূল (সা.) বললেন : দেখ এ মাসটি তোমাদের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে। এতে এমন একটি রাত আছে যা হাজার মাস থেকে অধিক উত্তম। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে যাবতীয় কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো। আর চিরবঞ্চিত ব্যক্তিই কেবল এর সুফল থেকে বঞ্চিত হয়। (ইবনে মাযাহ)
আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বলেন : রমযানের শেষ ১০ দিন শুরু হলে রাসূল (সা.) লাইলাতুল কদর লাভ করার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিতেন। নিজে রাত জাগতেন এবং নিজের পরিবারের লোকজনকেও জাগাতেন। (বুখারী ও মুসলিম)
রাসূল (সা.) বলেছেন : শবে কদরে হযরত জিবরাঈল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট বাহিনী নিয়ে অবতীর্ণ হন এবং যারা এই রাতে ইবাদত করে তাদের জন্য রহমতের দু’আ করতে থাকেন। (বায়হাকী)
মহান আল্লাহ মহিমান্বিত লাইলাতুল কদরেই তার কুদরতী বাণী মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল করেন। এজন্য এ রাতের তাৎপর্য ও মর্যাদা এত বেশী যেটা অচিন্তনীয়। যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরের ফযীলত থেকে মাহরুম হবে তার মতো হতভাগা আর দ্বিতীয়টি নেই।
লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান : রমযানের শেষ দশকের রাতগুলোতে এ মহিমান্বিত রজনীকে তালাশ করো। কেননা সারা বছরের মধ্যে এ রজনীই শ্রেষ্ঠ। লাইলাতুল কদরের সঠিক তারিখ জানাতে সাহাবায়ে কেরামদের সম্মুখে রাসূল বের হয়েছিলেন কিন্তু দুজন লোক ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়ার কারণে রাসূল এর কাছ থেকে এর ইল্ম উঠিয়ে নেয়া হল। হযরত উবাদা ইবনে সামিত বর্ণনা করেন, রাসূল আমাদেরকে লাইলাতুল কদর সম্বন্ধে অবহিত করার জন্য বেরিয়ে আসলেন। এমন সময় দু’জন মুসলমান ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত ছিল। তখন তিনি বললেন, আমি বের হয়েছিলাম তোমাদেরকে লাইলাতুল কদরের সঠিক তারিখ সম্বন্ধে সংবাদ দেয়ার জন্য, কিন্তু অমুক-অমুক ব্যক্তি ঝগড়ায় লিপ্ত হল, তাই এর ইল্ম আমার থেকে উঠিয়ে নেয়া হল। সম্ভবতঃ এর মধ্যেই তোমাদের কল্যাণ নিহিত ছিল। অতএব তোমরা লাইলাতুল কদর রমযান মাসের শেষ দশকের নবম, সপ্তম, ও পঞ্চম রাতে তালাশ কর। (বুখারী)
হযরত আইশা সিদ্দীকা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল বলেছেন : তোমরা রমযান মাসের শেষ দশকে লাইলাতুল কদরকে অন্বেষণ কর। (বুখারী)
হযরত আইশা সিদ্দীকা (রাঃ) থেকে আরও বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল বলেছেন : তোমরা রমযান মাসের শেষ দশকের বে-জোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদরকে তালাশ কর। (বুখারী)
অন্যত্র হাদীসে হযরত আইশা সিদ্দীকা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি জানতে পারি কোন রাতটি কদরের রাত, তাহলে এ রজনীতে কোন দু’আ পড়ব ? জবাবে তিনি বললেন : তুমি বলবে, ”আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউয়ুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী ” (হে আল্লাহ! নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা করা পছন্দ করো, অতএব আমাকে ক্ষমা করো। (তিরমিযী, ইবনে মাযাহ)
মহিমান্বিত রজনীর নিদর্শনসমূহ : ১. কদরের রাত্রি তিমিরাচ্ছন্ন হবে না। ২. নাতিশীতোষ্ণ হবে। ( না গরম না শীত এমন হবে) ৩. মৃদু বায়ু প্রবাহিত হবে। ৪. উক্ত রাতে মু’মিনগণ কিয়ামুল লাইল বা ইবাদত করে অন্যান্য রাত অপেক্ষা অধিক তৃপ্তি বোধ করবে। ৫. হয়তোবা আল্লাহ তা’আলা কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে উহা স্বপ্নে দেখাবেন। (দেখুন : ইবনে খুযায়মা, ইবনে হিব্বান, মুসনাদে আহমদ) ৬. ঐ রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে। (বুখারী) ৭. সকালে হালকা আলোক রশ্নিসহ সূর্যোদয় হবে, পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায়। (মুসলিম)
লাইলাতুল কদর বা কদরের রাতে আমাদের কি কি করণীয় ?
কুরআন ও হাদীসের আলোকে এ রাতে আমাদের করণীয় হলো :- (১) মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের ভিত্তিতে প্রত্যেক অভিভাবক নিজে রাত জাগবেন এবং পরিবার-পরিজনকে জাগরণে উদ্বুদ্ধ করবেন। (২) সাধ্যানুপাতে তারাবীহ বা তাহাজ্জুদ নামায লম্বা কিরাআত ও লম্বা রুকু সিজদা দ্বারা দীর্ঘক্ষণ যাবৎ আদায় করবেন। সিজদায় তিন বা ততোধিক বার সিজদার তাসবীহ পাঠ করে কুরআন ও হাদীসে উল্লেখিত দু’আসমূহ পাঠ করবেন। এ মর্মে বিশুদ্ধ হাদীসও রয়েছে। অনেকে আবার খুব পেরেশান থাকেন যে, কদরের নামাযের নিয়্যাত কি হবে ? কোন-কোন সূরা দিয়ে নামায পড়তে হবে ? আমাদের ভালভাবে জানা থাকা প্রয়োজন যে, ইশার নামাযের পর থেকে নিয়ে ফযর পর্যন্ত যে নফল নামায পড়া হয়, তাকে বলা হয় কিয়ামুল-লাইল বা তাহাজ্জুদ। অতএব কদরের রাতে ইশার পর থেকে ফযর পর্যন্ত যত নামায পড়া হবে সে গুলোকে নফলও বলা যাবে অথবা তাহাজ্জুদও বলা যাবে। লাইলাতুল কদর উপলক্ষে নামাযের জন্য বিশেষ কোন নিয়্যাত নেই বা অমুক-অমুক সূরা দিয়ে পড়তে হবে এমনও কোন বাধাধরা নিয়ম নেই। (৩) অতীতের করীরা গুনাহ বা বড় পাপের জন্য একনিষ্ঠভাবে তাওবা করবেন ও অধিকরূপে ইস্তেগফার করবেন। (৪) কুরআন মাজীদ পাঠ করবেন। শরীয়াত সম্মত পদ্ধতিতে তথা চুপিসারে, একাকী, রিয়ামুক্ত অবস্থায় যিকির-আযকার করবেন। (৫) পাপ মোচনসহ পার্থিব ও পরকালীন সার্বিক মুক্তি ও কল্যাণের জন্যে বিনয়ী ভাবে একাগ্রচিত্তে দু’আ কবুলের প্রত্যাশা নিয়ে দু’আ করবেন। নিম্নের দু’আ বিশেষভাবে পাঠ করবেন, “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউয়ুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী ” নিঃসন্দেহে ঐ বরকতপূর্ণ রাতটি যে ব্যক্তি অবহেলায় বা অলসতায় অবমূল্যায়ন করল, এর যথার্থ গুরুত্বারোপ করল না, সে সমূহকল্যাণ থেকে নিজকে বিরত রাখল। প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির উচিত যে, ঐ রাতের যথাযথভাবে হক আদায় করে মহান আল্লাহর পক্ষথেকে কল্যাণ, ফযীলত, বরকত ও আশাতীত সওয়াব লাভে ধন্য হওয়া। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে বেশি-বেশি করে ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে লাইলাতুল কদরের ফযীলত অর্জন করে তার নৈকট্য লাভের তাওফীক দান করুন। আমীন ইয়া রাব্বাল আলামীন ॥