মাহে রমযান : কল্যাণের অফুরন্ত ভাণ্ডার

Ramadan-Kareem-

অজস্র-অফুরন্ত কল্যাণের এক মহাভাণ্ডার রমজানুল মুবারাক। রহমত-বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের মহান সওগাত নিয়ে প্রতি বছর এ মাস আমাদের মাঝে হাজির হয়। রমজান মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি এক নিয়ামত বিশেষ। সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়া, জীবনমান উন্নত করা, আত্মগঠন ও উত্তম নৈতিক চরিত্র গঠন এবং নির্মল, পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর সমাজ গঠন করা এ মাসের অনুশীলনের মাধ্যমে সম্ভব। এ মাস পরিশুদ্ধি এবং প্রশিক্ষণ লাভের মাস।

রমজান আসমানী কিতাব নাযিলের মাস : আমরা সবাই জানি রমজান মাসে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। (সূরা বাকারা-১৮৫) কিন্তু এটি শুধু কুরআন নাযিলের মাসই নয়, বরং সকল আসমানী কিতাব এ মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লামা ইবনে কাছীর বলেন, এটা সেই মাস যে মাসে নবীগণের উপর আল্লাহর কিতাবসমূহ নাযিল করা হয়েছে। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম বলেন, সৃষ্টি জগতের সকল কল্যাণ শরীআত হতে গৃহীত ও অর্জিত। শরীআতের মূল উতস হলো আসমানী গ্রন্থ। এ মাসে আল-কুরআন ও অন্যান্য আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করে পৃথিবীবাসীর প্রতি কল্যাণের যে শুভ সূচনা আল্লাহ করেছিলেন তা এখনো অব্যাহত আছে। কুরআন ও অন্যান্য আসমানী কিতাব নাযিলের জন্যই রমজান কল্যাণের আধারে পরিণত হয়েছে। সুতরাং রমজানকে যথাযথভাবে, গুরুত্ব সহকারে পালন করতে হবে এবং তার চেয়েও বহুগুণ বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। এ মাসে নাযিল হওয়া আল-কুরআনকে এ মহাগ্রন্থকে গভীর অভিনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করতে হবে এবং এখান থেকে, শুধু মাত্র এখান থেকেই সংগ্রহ করতে হবে জীবন চলার পাথেয়। তাহলেই প্রকৃত কল্যাণ লাভ সম্ভব হবে।

রমজান সিয়াম সাধনার মাস : রমজানের অন্যতম দায়িত্ব হলো রোযা পালন। এ মাসে যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, তা সমগ্র মানব জাতির সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য। কিন্তু এ কুরআন থেকে সঠিক পথের দিশা পেতে হলে কিছু যোগ্যতা ও গুণাবলীর প্রয়োজন। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে, এটা সেই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই। এটা সেই মুত্তাকীদের জন্য পথ প্রদর্শক যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে, নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। যারা ঈমান আনে তোমার এবং তোমার পূর্ববর্তী নবীদের প্রতি অবতীর্ণ কিতাবের প্রতি, আর নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে আখিরাতের প্রতি। (সূরা বাকারা-২/৪) তাকওয়ার সাথে উল্লেখিত গুণাবলী সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে। এজন্য মুসলমানদেরকে কুরআন থেকে হিদায়াত লাভের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য আল্লাহ কুরআন নাযিলের এ মাসে রোযাকে ফরজ করে তার উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। সুতরাং রমজানের সকল নিয়মাবলী যথাযথভাবে পালন করে কাঙ্গিত গুণাবলী নিজের মধ্যে তৈরী করে কুরআন থেকে হিদায়াত লাভের যোগ্য করে গড়ে তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। এ রোযা শুধু আমাদের উপর নয় বরং অতীতের সকল নবী ও উম্মতের উপর ফরজ ছিল। আল্লামা ইবনে কাছীর বলেন, হযরত আদম (আঃ) থেকে হযরত নূহ (আঃ) পর্যন্ত প্রতি মাসে তিনটি রোযা ফরজ ছিল। নূহ (আঃ) থেকে এ অবধি সকল উম্মতের জন্য রমজান মাসে রোজা ফরজ করা হয়েছে।

তাকওয়ার প্রশিক্ষণের মাস রমজান : কুরআন যে জীবনাদর্শ ও জীবন ব্যবস্থা উপস্থাপন করে তা প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপালনের জন্য এক দল আল্লাহভীরু, সত ও সত্যনিষ্ঠ লোকের প্রয়োজন, যারা একমাত্র আল্লাহর ভয় ও আখিরাতের জবাবদিহির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল প্রকার অন্যায় অনাচার লোভ-লালসা, অনুরাগ বা বিরাগের ঊর্ধ্বে থেকে সার্বিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবে। সমাজ ও জনগণের কল্যাণই হবে যাদের ব্রত। রোযার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে : হে ঈমানদারগণ, তোমাদের প্রতি রোযাকে ফরজ করে দেয়া হলো যেমন তা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। (সূরা বাকারা-183) মুত্তাকী বলা হয় তাদেরকে যারা আখিরাতের জন্য ক্ষতিকর সকল কথা, কাজ ও চিন্তাকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে চলে। অর্থাত, দুর্নীতি মুক্ত কর্তব্য পরায়ণ সুনাগরিকই হলেন মুত্তাকী। কুরআন উপস্থাপিত কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য এ ধরনের মুত্তাকী নাগরিক একান্ত প্রয়োজন। এজন্য কুরআন নাযিলের এ মাসে রোযা ফরজ করে দিয়ে মুত্তাকী বানানোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, শুধুমাত্র দিনের বেলায় পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকলেই তাকওয়া অর্জন হবে না। বরং তাকওয়া অর্জন করতে হলে এর পাশপাশি সকল অন্যায় কথা, কাজ, ভাব-চিন্তা, আচার-আচরণ, লেনদেন প্রভৃতি একেবারেই বর্জন করতে হবে এবং এ অন্যায় বর্জন সাময়িক নয় বরং স্থায়ী স্বভাবে পরিণত করতে হবে। হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি অন্যায় কথা ও কাজ বর্জন করে না তার পানাহার বর্জন আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (বুখারী)

ধৈর্য, সংযম ও সমবেদনার মাস রমজান : ধৈর্য ও আত্মসংযম মানুষের সফলতা ও নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের চাবিকাঠি। রোযা সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মানুষকে পানাহার থেকে বিরত রাখে। এর ফলে ক্ষুধা পিপাসায় চরম কষ্টের সময়েও তাকে সেগুলো বজর্ন করে আত্মসংযম ও ধৈর্য ধারণ করতে হয়। এভাবে দীর্ঘ এক মাস অনুশীলনের ফলে ভোগবিলাসের প্রতি তার লোভ-লালসা হ্রাস পায় এবং সে আত্মসংযমে অভ্যস্ত হয়। কঠিন ক্ষুধার সময় যে কষ্ট অনুভব হয় তা সহ্য করার মাধ্যমে সে ধৈর্যশীল ব্যক্তিতে পরিণত হয়। এর ফলে সে অন্য যে কোন কঠিন পরিস্থিতি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করার প্রশিক্ষণ পায়। এ জন্যই হাদীসে বলা হয়েছে, এ মাস হলো ধৈর্যের মাস, আর ধৈর্যের বিনিময় হলো জান্নাত। (মিশকাত)

হাদীসে রমজানকে সমবেদনা ও সহমর্মিতার মাস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সমাজে দরিদ্র শ্রেণীর লোকেরা অনাহারে অর্ধাহারে থেকে ক্ষুধায় যে কষ্ট পায়, ধনী ব্যক্তিরা তা উপলব্ধি করতে পারে না। কিন্তু রমজান মাসে রোযা পালন করতে গিয়ে দীর্ঘ সময় উপবাস থাকার কারণে ক্ষুধার যে কি যন্ত্রণা তা তারা উপলদ্ধি করতে পারে। এর ফলে তাদের মধ্যে ক্ষুধার্ত ব্যক্তিদের প্রতি অনুকম্পা ও সহমর্মিতার অনুভূতি জাগ্রত হয় এবং সমবেদনায় সিক্ত হয়ে তারা তখন দরিদ্রদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। রোযার মাধ্যমে এ অনুভূতি যদি সকল ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে জাগ্রত করা যায়, তাহলে তা দারিদ্র্য বিমোচনে সহযোগী ভূমিকা পালন করবে। এ মাসে বেশী বেশী দান করা, রোযাদারকে ইফতার করানো ও পরিতৃপ্তি সহকারে খাদ্য খাওয়ানো এবং অধিনস্ত ব্যক্তিদের কাজের ভার লাঘব করে দিতে হাদীসে বলা হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে পারস্পরিক মায়ামমতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও সমবেদনার পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা একটি সুন্দর সমাজের জন্য খুবই জরুরী।

আত্মশুদ্ধি ও সমাজ পরিশুদ্ধির মাস রমজান : রমজানকে যথাযথভাবে প্রতিপালনের মাধ্যমে অতীতের ভুলত্রুটি পরিমার্জনের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হওয়া যায়। হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রোযা পালন করে, তার অতীতের গুনাহগুলোকে মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমান ও ইতিসাবের সাথে রমজানের রাত্রি জাগরণ করে তার অতীতের গুনাহগুলোকে মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে লাইলাতুল কদর জাগরণ করে তারও অতীতের গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়। (বুখারী ও মুসলিম)

তাছাড়া রোযা ব্যক্তির উপরে বেশ কিছু আচরণগত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। যেমন- রোযাদারের জন্য মিথ্যা কথা, অন্যায় কাজ, গীবত বা পরনিন্দা , ধোঁকা দেয়া, প্রতারণা করা, হিংসা-বিদ্বেষ, গালমন্দ, ঝগড়া-বিবাদ, অশ্লীল কথা ও কাজ প্রভৃতি নিষিদ্ধ। রোজার মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি সদস্য যদি সমাজের শৃংখলা বিনষ্টকারী উল্লেখিত মন্দ আচরণগুলো বর্জন করতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে সুন্দর, সুশৃংখল ও পরিচ্ছন্ন সমাজ গড়ে উঠবে।

রমজান কল্যাণের অফুরন্ত এক ভাণ্ডার : বরকত ও কল্যাণের বার্তাবাহক রমজান মাস। হাদীসে বলা হয়েছে, এ মাসের প্রথম দশক রহমতের, মধ্য দশক মাগফিরাতের এবং শেষ দশক জাহান্নাম থেকে নাজাতের। এ মাসে কেউ নফল ইবাদত করলে অন্য মাসের ফরজের সমতুল্য ছওয়াব পাবে। এ মাসে ১টি ফরজ আদায় করলে অন্য মাসে ৭০টি ফরজ আদায়ের ছওয়াব পাবে। এ মাসে কোন রোযাদারকে ইফতার করালে সেটা গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে নাজাতের কারণ হবে এবং রোযাদারের সমপরিমাণ ছওয়াব ইফতার যিনি করান তার আমলনামায় লিখে দেয়া হবে। অথচ রোযাদারদের ছওয়াবের কোন কমতি হবে না। (মিশকাত) হাদীসে আরো এসেছে, প্রতিটি মানুষের ভাল কর্মের বদলা দশ থেকে সাত শতগুণ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। কিন্তু রোযা এর ব্যতিক্রম। কারণ আল্লাহ বলেন, রোযা খাছ করে আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর বদলা দেব। (বুখারী ও মুসলিম) অন্য হাদীসে এসেছে রোযা এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে আল্লাহ আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও কামনা বাসনা থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ কর। আর কুরআন বলবে, হে আল্লাহ আমি তাকে রাত্রির ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ কর। এ দুটি সুপারিশই গ্রহণ করা হবে। (মিশকাত) এ মাসে লাইলাতুল কদর নামে একটি রাত্র রয়েছে যার ব্যাপারে কুরআনে বলা হয়েছে লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাত্রিতে ফিরিশতা ও রূহ (জিবরাইল আ.) আল্লাহর অনুমতিক্রমে তার গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশাবলী নিয়ে অবতরণ করে। ফজর উদয় হওয়া অবধি এ রাত্রিতে শান্তিবর্ষিত হতে থাকে। (সূরা কদর-৩/৫) রমজান মূলত ছওয়াব অর্জনের এক মৌসুম বিশেষ। নিজের আমল ও চেষ্টা-প্রচেষ্টার দ্বারা এ মাসে যে যত বেশী অর্জন করতে পারবে সে তত বেশী কল্যাণের অধিকারী হবে। এ মাসে রোযা পালন, রাত্রি জাগরণ ইত্যাদি ছাড়াও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুটি কাজ বেশী করে করতেন। তা হলো কুরআন তেলাওয়াত ও বেশী বেশী করে দান করা। আমরাও যদি অন্যান্য আমলের পাশাপাশি এ দুটি কাজ বেশী করে করি তাহলে বেশী কল্যাণ লাভ করতে পারব। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন…

Related Post