Main Menu

মায়ের প্রতি সন্তানের আচরণ

imagesCA3PEMBZ

হযরত ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহতাআলার নিকট মাতাপিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার চাইতে অধিক প্রিয় আর কোনো আমল হতে পারে তা আমার জানা নেই।
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, কিছু দিন আবু হুরায়রার (রা.) মা এক বাড়িতে এবং আবু হুরাইরা (রা.) অল্প দূরে ভিন্ন এক বাড়িতে বসবাস করতেন। আবু হুরাইরা (রা.) যখনই বাইরে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা করতেন তখন মায়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বলতেন, ইয়া আম্মাজান! আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া রাহমাতুল্লাহ। তাঁর মা ভেতর থেকে বলতেন, প্রিয় পুত্র! ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া রাহমাতুল্লাহ। অতঃপর হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বলতেন, আম্মাজান, শৈশবকালে যেভাবে আপনি স্নেহ ও মায়া মমতাসহকারে আমাকে লালন-পালন করেছিলেন। তেমনিভাবে যেন আল্লাহতাআলা আপনার প্রতি রহম করেন। জবাবে তিনি বলতেন, প্রিয় পুত্র! এ বৃদ্ধ বয়সে তুমি আমার সঙ্গে যেমন সুন্দর ও সদাচরণ করছ তেমনি আল্লাহও যেন তোমার প্রতি রহমত বর্ষণ করেন।
মাতাপিতার জন্য অর্থ ব্যয় :যেভাবে সন্তানের ওপর মাতাপিতার অধিকার রয়েছে তেমনিভাবে সন্তানের সম্পদের ওপরও তাদের অধিকার রয়েছে।

এ সম্পর্কে আল্লাহতাআলা বলেন, (হে নবী) লোকেরা আপনাকে জিজ্ঞেস করে, আমরা কি ব্যয় করব। আপনি তাদের বলে দিন, যে মালই তোমরা ব্যয় কর না কেন? তার প্রথম হকদার হল তোমার মাতাপিতা।
এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহের কাছে স্বীয় পিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলল, তিনি যখনই ইচ্ছা করেন আমার সম্পদ নিয়ে নেন। রাসুলুল্লাহ তার পিতাকে ডাকলেন। লাঠি ভর করে এক দুর্বল বৃদ্ধ হাজির হলেন। তিনি বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন।

বৃদ্ধালোকটি জবাব দিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এক সময় আমার এ ছেলে দুর্বল, অসহায় ও কর্পদহীন ছিল। আমি তখন ছিলাম শক্তিশালী ও বিত্তশালী। আমি কখনো তাকে আমার সম্পদ নিতে বাধা দেইনি। আজ আমি দুর্বল ও কপর্দকহীন, সে শক্তিশালী ও বিত্তশালী। এখন সে তার সম্পদ আমাকে দেয় না।একথা শুনে রাসুলুল্লাহ বললেন, তুমি এবং তোমার সম্পদ তোমার পিতার।

মাতাপিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা সম্পর্কে হাসান বসরীকে (রা.) জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তোমার মালিকানাধীন সম্পদ তাদের প্রয়োজন মাফিক ব্যয় করবে। তাঁরা যা আদেশ করেন তা যদি গুনার কাজ না হয়, তবে তা মেনে চলবে।
মাতাপিতার বদলা

হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম রাসুলুল্লাহের বলেছেন, কোনো সন্তান পিতার স্নেহ-ভালোবাসা, লালন-পালন এবং কষ্টের হক আদায় করতে বা তার বদলা দিতে সক্ষম নয়। তবে সে যদি তাঁকে কারো দাসরূপে পায়, অতঃপর তাঁকে খরিদ করে মুক্ত করে দেয়, তাহলে কিছু হক আদায় হয়।
আবু মূসা আশআরী (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা.) দেখলেন, জনৈক ইয়ামেনী স্বীয় মাতাকে পিঠে বসিয়ে কাবা শরীফ তাওয়াফ করছিল এবং আবেগের সঙ্গে এ কবিতা আবৃত্তি করছিল_

আমি তাঁর নিতান্ত অনুগত সাওয়ারি উট
যখন তাঁর সাওয়ারি ভয়ে ভাগে তখন আমি দেই না ছুট।

অতঃপর সে হযরত আবদুল্লাহকে (রা.) দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি মনে করেন, আমি আমার মায়ের বদলা দিয়েছি? ইবন উমার (রা.) বললেন, মায়ের বদলা! এটা তো তার এক আহ্ শব্দের বদলাও হয়নি।

একবার এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহের খেদমতে হাজির হয়ে অভিযোগ করল, হে আল্লাহর রাসুল! আমার মা বদমেজাজি মানুষ। একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যখন তোমাকে গর্ভে ধারণা করে একাধারে নয় মাস সীমাহীন কষ্ট সহ্য করেছেন, তখন তো তিনি খারাপ মেজাজের ছিলেন না? লোকটি বলল, হযরত আমি সত্য বলছি, তিনি বদমেজাজি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার খাতিরে তিনি যখন রাতের পর রাত জাগতেন, তোমাকে দুধ পান করাতেন, তখন সে তো তিনি বদমেজাজি ছিলেন না। লোকটি বলল, আমি আমার মায়ের সে সব কাজের প্রতিদান দিয়ে ফেলেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি সত্যিই প্রতিদান দিয়ে ফেলেছ? সে বলল, আমি মাকে আমার কাঁধে চড়িয়ে হজ করিয়েছি। নবী বললেন, তুমি কি তাঁর সেই কষ্টের বদলা দিতে পারো, যা তোমার ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় তিনি সহ্য করেছেন।

অমুসলিম মাতাপিতার প্রতি আচরণ

সন্তানের ইসলাম গ্রহণ করার পরও যদি মাতাপিতা কুফর ও শিরকের পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত থাকে এবং তাকে কুফরিতে ফিরে আসতে বাধ্য করে, তবে কোনোক্রমেই তাদের কথা মানা ও তাদের আনুগত্য করা যাবে না। কেননা আল্লাহর নাফরামানিমূলক কাজে কোনো মানুষের আনুগত্য করা হালাল নয়। তবে অবশ্যই মাতাপিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার ও সদাচারণ করে যেতে হবে।এ সম্পর্কে আল্লাহতাআলা বলেন, মাতা-পিতা যদি আমার কাউকে শরিক করার জন্য তোমার ওপর চাপ প্রয়োগ করে যে সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই_ তাহলে অবশ্যই তাদের আনুগত্য করবে না এবং দুনিয়ার জীবনে তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে সহবস্থান করবে। আর তাদের আনুগত্য করবে যারা আমার দিক প্রত্যাবর্তনকারী। সূরা লুকমান : ১৫।

মাতাপিতা সন্তানকে কুফরি করার জন্য যত কঠিন চাপ প্রয়োগ করুক না কেন, তাদের কথা মানা ও তাদের আনুগত্য করা যাবে না। তবে তাদের সঙ্গে অবশ্যই সদ্ব্যবহার ও সুন্দর আচরণ করে যেতে হবে।

আবু বকরের (রা.) কন্যা আসমা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহের যুগে আমার মা মুশরিক অবস্থায় আমার নিকট এসেছিলেন। আমি রাসুল রাসুলুল্লাহের নিকট আরজ করলাম, আমার নিকট আমার মা এসেছেন, তিনি ইসলাম থেকে বিমুখ রয়েছেন। আমি কি তাঁর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করব? তিনি বললেন, হ্যাঁ মায়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর। সহীহ আল বুখারি, ২খ পৃ. ৮৮৪; সহীহ মুসলিম, কিতাবুল যাকাত ২ খ. পৃ. ৬৯৬।
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) মুসলমান হওয়ার পরও দীর্ঘদিন যাবৎ তাঁর মা শিরকে নিমজ্জিত ছিলেন। তিনি মাকে সর্বদা শিরকের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করতেন এবং ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিতেন। আর তাঁর মাও সর্বদা অস্বীকৃতি জানাতে থাকেন। তা সত্ত্বেও আবু হুরাইরা গ্রহণ করার দাওয়াত দিতাম। একদিন আমি তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি রাসুলুল্লাহের সম্পর্কে আমাকে এমন কিছু কথা শুনালেন, যাতে আমার অন্তর বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। আমি ক্রন্দনরত অবস্থায় রাসুলের খেদমতে হাজির হয়ে আরজ করলাম, হে আল্লাহ রাসুল! আমি সব সময় আমার মাকে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকি, তিনি সব সময় তা অস্বীকার করতে থাকেন। আজ আমি তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি রাগান্বিত হয়ে আপনার শানে বেয়াদবি করে বসেন এবং আপনাকে গালমন্দ করেন। আমি তা সহ্য করতে পারিনি। আপনি আল্লাহর দরবারে দুআ করুন, যেন তিনি আবু হুরাইরার মাকে হেদায়াত নসীব করেন। রাসুলুল্লাহ দুআ করলেন : হে আল্লাহ! আপনি আবু হুরাইরার মাকে হেদায়াত করুন। আমি নবী রাসুলুল্লাহের দুআর সুসংবাদ নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আমি বাড়ি পেঁঁৗছে দেখি ঘরের দরজা বন্ধ। তিনি আমার পায়ের শব্দ শুনে ভেতর থেকে বললেন, আবু হুরাইরা অপেক্ষা কর।

তিনি তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করে দোপাট্টা পরিধান করে ওড়না পরা ছাড়াই দরজা খুলে দিলেন। অতঃপর বললেন, আবু হুরাইরা! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ আল্লাহর বান্দা ও আল্লাহর রাসুল। আমি আনন্দে ক্রন্দনরত অবস্থায় রাসুলুল্লাহের খেদমতে হাজির হয়ে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল আমি আপনাকে সুসংবাদ শুনাতে এসেছি। আল্লাহতাআলা আপনার দুআ কবুল করেছেন। তিনি আবু হুরাইরার মাকে হেদায়াত নসীব করেছেন। একথা শুনে তিনি খুশি হলেন এবং আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করলেন এবং আমাকে নসীহত করলেন।

এরপর আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনি দুআ করুন যেন আল্লাহ আমাকে ও আমার মাকে সকল মুমিনের প্রিয় বানিয়ে দেন। রাসুলুল্লাহ দুআ করলেন : ইয়া আল্লাহ! আবু হুরাইরা ও তার মায়ের প্রতি ভালোবাসা সকল মুমিনের অন্তরে সৃষ্টি করে দিন। এ দুআর পর সে মুসলমানই আমাকে দেখেছে অথবা আমার কথা শুনেছে সেই আমাকে ভালোবেসেছ। : সহীহ মুসলিম, ফাযায়িল অধ্যায়, অনু : আবু হুরাইরার (রা.) ফজিলত। হাদিস নং ২৪৯১

দুধ মায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন

হযরত আবু তুফায়েল (রা.) বলেন, আমি দেখলাম, নবী জিয়রানা নামক স্থানে গোশত বণ্টন করেছিলেন। এমন সময় একজন মহিলা এসে সরাসরি নবীর নিকটে চলে গেলেন। তিনি তাঁর জন্য নিজের চাদর বিছিয়ে দিলেন। অতঃপর ভদ্র মহিলাটি তার ওপর আসন গ্রহণ করলেন। (বর্ণনাকারী বলেন) আমি লোকদের কাছে জানতে চাইলাম, ইনি কে? তারা বললেন, ইনি হচ্ছেন রাসুলুল্লাহের দুধ মা_ হযরত হালীমা সাদিয়া রাসুলুল্লাহ । তিনি তাঁকে দুধ পান করিয়েছিলেন।

(সমাপ্ত)

Related Post