এমন জামাতকে সালাম দেয়া মাকরূহ যারা ওজু-গোসল করছে, খাচ্ছে, যুদ্ধ করছে, কুরআন তিলাওয়াত বা যিকির করছে, তালবীয়া পাঠ করছে, হাদিস পড়াচ্ছে, ভাষণ দিচ্ছে, ওয়াজ করছে, ওয়াজ-নছীহত বা ভাষণ শুনছে, ফিকহের আলোচনা করছে, পাঠদান করছে, গবেষণা করছে, আযান দিচ্ছে, সালাত আদায় করছে, পেশাব-পায়খানায় লিপ্ত আছে, স্ত্রীর সাথে খেল-তামাশা করছে, বিচার কাজে লিপ্ত আছে ইত্যাদি। যদি কোনো ব্যক্তি এমন সময় সালাম দেয়, যখন সালাম দেয়া মাকরূহ, তার সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব নয়। আল্লামা খালওয়াতী রহ. যাদের সালাম দেয়া মাকরূহ তাদের কথা কাব্য আকারে একত্র করে আলোচনা করেন। তিনি বলেন,
“সালামের উত্তর দেয়া সবার উপর ওয়াজিব। তবে যে ব্যক্তি সালাত আদায়ে ব্যস্ত অথবা খাওয়া বা পান করায় ব্যস্ত তার জন্য সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব নয়। অনুরূপভাবে দো‘আ, যিকির, খুতবা, তালবীয়া পাঠ, পায়খানা-পেশাবে লিপ্ত ব্যক্তির উপর সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব নয়। আযান ইকামত দেয়া অবস্থায় সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব নয়। বাচ্চাদের জন্য সালামের উত্তর দেয়া, মাতাল, যুবতী নারী যার সালামের উত্তর দেয়াতে ফিতনার আশংকা থাকে তার সালামের উত্তর ও ফাসেকের সালামের উত্তর দেয়া, ওয়াজিব নয়। তন্দ্রাচ্ছন্ন, ঘুমন্ত, স্ত্রীর সাথে সহবাস অবস্থায়, বিচার কার্য পরিচালনার সময় [সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব নয়] অথবা যখন কোন ব্যক্তি গোসল খানায় থাকে বা মাতাল থাকে [তখনও সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব নয়] এখানে দুটির কথা আলোচনা হল, এর পূর্বে বিশটি।
এখানে যতগুলো লোককে সালাম দেয়া মাকরূহ হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, অধিকাংশের বিষয়টি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আর যাদের বিষয়ে কোন হাদিস পাওয়া যায় না, তাদেরকে হাদিসের উপর ক্বিয়াস করে মাকরূহ বলা হয়েছে। যখন ওয়াজিব না থাকে, তখন মুস্তাহাব বা বৈধ হওয়া বাকী থাকে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উত্তর দেয়াও মাকরূহ হয়ে যায়। যেমন যে লোকটি পেশাব-পায়খানা বা স্ত্রীর সাথে লিপ্ত এ ধরনের ক্ষেত্রে সালামের উত্তর দেয়া মাকরূহ হয়ে যায় ।
সালামের উপকারিতা ও ফলাফল
এক- মনে রাখবে সালাম দেয়ার উপকারিতা অনেক। তার মধ্যে একটি উপকার, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ এর সুন্নত পালন করা।
দুই- যারা বলেন, প্রথমে সালাম দেয়া ওয়াজিব, তাদের কথা অনুযায়ী হারাম থেকে রেহাই পাওয়া। যদিও বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য মত হল, সালাম দেয়া ওয়াজিব না হওয়া।
তিন- কৃপণতা থেকে মুক্ত হওয়া। হাদিসে বর্ণিত, কৃপণ জান্নাতে আদনে প্রবেশ করবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বলেন,
أي داء أدوى من البخل، والبخيل بغيض إلى الله، بغيض إلى الناس، بعيد من الجنة، حبيب إلى الشيطان، قريب إلى النيران، والجنة دار الأسخياء .
“কৃপণতার চেয়ে আর কোন ব্যাধি এত বেশি মারাত্মক? কৃপণ আল্লাহর নিকট ঘৃণিত, মানুষের নিকট ঘৃণিত, জান্নাত হতে বিতাড়িত, শয়তানের বন্ধু এবং জাহান্নামের নিকটে অবস্থানকারী। আর জান্নাত হল, দানশীলদের ঠিকানা” ।
চার- যে সব কারণগুলো মানুষকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে, সালাম একটি অন্যতম কারণ। যেমন- আব্দুল্লাহ ইবন সালামের হাদিসে বর্ণিত। এ ছাড়াও সালাম জান্নাতে প্রবেশকে ওয়াজিব করে। যেমন-আবু সারাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’ এর হাদিস; তিনি বলেন,
يا رسول الله أخبرني بشيء يوجب الجنة، قال: «طيب الكلام، وبذل السلام، وإطعام الطعام»
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ কে জিজ্ঞাস করা হল, হে আল্লাহর রাসূল! তুমি আমাকে এমন আমল বাতলেয়ে দাও, যা জান্নাতে প্রবেশকে ওয়াজিব করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বললেন, “মিষ্টি কথা, সালামের প্রসার এবং মানুষকে খানা খাওয়ানো। বর্ণনায় তাবরানী, ইবনে হিব্বান স্বীয় সহীহতে এবং হাকেম তার সহীহতে।
পাঁচ- সালামের প্রসার করা, মাগফিরাত ও ক্ষমা লাভ করার কারণ।
আল্লামা তাবরানী আবু সারহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’ হতে বিশুদ্ধ সনদে হাদিস বর্ণনা করে বলেন,
“قلت يا رسول الله دلني على عمل يدخلني الجنة، قال: «إن من موجبات المغفرة بذل السلام وحسن الكلام».
“আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন আমল বাতলেয়ে দাও, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বললেন, ক্ষমা লাভের কারণ হল, সালামের প্রসার ও সুন্দর কথা”।
ছয়. সালাম মুসলিম ভাইদের মধ্যে পরস্পর মহব্বত সৃষ্টি করে। যেমন উপরে উল্লেখিত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’ এর হাদিস ও অন্যান্য হাদিসে বিষয়টি বর্ণিত( )। আর একটি কথা মনে রাখবে মহব্বতের শান অধিক মহান, তার মর্তবা অনেক বড়। আর ঊর্ধ্ব জগত ও নিম্ন জগতের ভিত্তিই হল, মহব্বত।
সমগ্র জগতের উত্থান-পতন, নড়-চড়, সবই মহব্বত থেকেই সৃষ্ট। এ কারণেই মহব্বতের গুরুত্ব সম্পর্কে বর্ণিত হাদিস অনেক। এ ছাড়াও মহব্বত ঈমানের ঝাণ্ডা হওয়াটা তার গুরুত্ব বুঝার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ্ তা‘আলাই ইহসানের অভিভাবক।
সাত- সালাম দেয়া দ্বারা অপর মুসলিম ভাইয়ের অধিকার আদায় করা হয়। যেমন- সহীহ মুসলিমে আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’ হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বলেন,
«حق المسلم على المسلم ست، قيل وما هن يا رسول الله؟ قال: إذا لقيته فسلم عليه، وإذا دعاك فأجبه، وإذا استنصحك فانصح له، وإذا عطس فحمد الله فشمته، وإذا مرض فعده، وإذا مات فاتبعه».
“একজন মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের হক ছয়টি। জিজ্ঞাসা করা হল হে আল্লাহর রাসূল! সে গুলো কি? তিনি বললেন, তোমার সাথে সাক্ষাৎ হলে, সালাম দেবে। তোমাকে দাওয়াত দিলে, তাতে শরিক হবে, উপদেশ চাইলে, উপদেশ দেবে। হাঁচি দিয়ে আলহামদু লিল্লাহ বললে, তার উত্তর দেবে। অসুস্থ হলে, তাকে দেখতে যাবে এবং মারা গেলে, তার জানাযায় শরিক হবে”।
আট- আল্লাহর নিকট উত্তম ব্যক্তি হওয়া। প্রমাণ:
ইমাম আবু-দাউদ ও ইমাম তিরমিযী উভয় আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’ হতে হাদিস বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বলেন,
«إن أولى الناس بالله من بدأهم بالسلام» ولفظ الترمذي: “قيل يا رسول الله الرجلان يلتقيان أيهما يبدأ بالسلام؟ قال: أولاهما بالله تعالى.
“আল্লাহর নিকট সর্বাধিক উত্তম ব্যক্তি, যে মানুষকে আগে সালাম দেয়”। তিরমিযীর শব্দ নিম্নরূপ: জিজ্ঞাসা করা হল, হে আল্লাহর রাসূল! দুইজন লোক পরস্পর পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ হলে কে আগে সালাম দেবে? রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বললেন, “তাদের দুজনের মধ্যে যে আল্লাহর নিকট অধিক উত্তম”।
নয়- ফযিলত গ্রহণ করা। প্রমাণ:
ইমাম বাযযায ও ইবনে হিব্বান স্বীয় সহীহ কিতাবে জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’ হতে হাদিস বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ এরশাদ করে বলেন,
«يسلم الراكب على الماشي، والماشي على القاعد، والماشيان أيهما بدأ فهو أفضل».
“আরোহী ব্যক্তি পায়ে হাটা ব্যক্তিকে সালাম দেবে, আর পায়ে হাটা ব্যক্তি বসে থাকা ব্যক্তিকে সালাম দেবে। আর উভয় ব্যক্তি যখন পায়ে হাটা হবে, তখন যে প্রথমে সালাম দেবে সেই উত্তম”।
আল্লামা তাবরানী কবীর গ্রন্থে এবং স্বীয় কিতাব আওসাতে সহীহ সনদে আগার হতে এবং তিনি মুযাইনা গোত্রের আগার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’ হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
«كان رسول الله أمر لي بجريب من تمر عند رجل من الأنصار فمطلني به، فكلمت فيه رسول الله ، فقال: أغد يا أبا بكر فخذ له من تمره، فوعدني أبو بكر المسجد إذا صلينا الصبح، فوجدته حيث وعدني فانطلقنا، فكلما رأى أبا بكر رجل من بعيد سلم عليه، فقال أبو بكر رضي الله عنه أما ترى ما يصيب القوم عليك من الفضل لا يسبقك إلى السلام أحد، فكنا إذا طلع الرجل من بعيد بادرناه، بالسلام قبل أن يسلم علينا».
“রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ আমাকে একজন আনসারী লোক থেকে এক থলে খেজুর গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু সে খেজুর দেয়ার ক্ষেত্রে আমার সাথে টালবাহানা করে। বিষয়টি আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম’কে অবহিত করি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’কে ডেকে বললেন, হে আবু বকর! তুমি প্রত্যুষে তার কাছে যাও এবং তার জন্য খেজুর সংগ্রহ কর। তারপর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’ আমাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন ফজরের সালাতের পর মসজিদে উপস্থিত থাকার। পরদিন আমি তাকে সেখানেই পেলাম, যেখানে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আমি তার সাথে হাটতে হাটতে দেখলাম, যখন তিনি কোনো লোককে অনেক দূর থেকে দেখতেন, তখনি তাকে সালাম দিতেন। আমাকে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’ বললেন, তুমি কি দেখছ না? লোকেরা কিভাবে তোমার উপর ফযিলত লাভ করে ফেলছে, কেউ যেন তোমাকে আগে সালাম দিতে না পারে, সে দিকে লক্ষ রাখবে। তারপর থেকে যখন কোনো লোককে অনেক দূর থেকে দেখতাম, তখন তাকে আমরা অনেক দূর থেকে তার সালাম দেয়ার পূর্বেই সালাম দিয়ে দিতাম”।