বিয়ে জীবনের অন্যতম অংশ। আর বিয়ের পর সুখী সংসারের জন্য শর্ত হলো স্বামী স্ত্রীর মধ্যে অকুণ্ঠ ভালোবাসা। ঠিক এই কাজেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় যৌতুক। অনেকে মোটা অংকের যৌতুকের আশায় অপছন্দের মেয়ে বিয়ে করেন। কিছুদিন যেতেই এটা হয় গলার কাটা। সেই কাটা নামাতে সংসারে বাঁধে নানা ফেকরা। আবার অনেক ক্ষেত্রে মোটা অংকের যৌতুক দেয়া স্ত্রীরা স্বামীর ওপর বাড়তি ক্ষমতা দেখান। এটিও সংসারকে ভাঙনের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। কিংবা স্বামী কম ক্ষমতাবান হলে সারা জীবন কষ্টের কাচির নিচেই জীবন কাটান।
ইসলাম এজন্য যৌতুক সমর্থন করে না। ইসলাম চায় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে অবাধ মিল ও মহব্বত। অফুরন্ত শান্তিময় সংসার। কণ্টকহীন দাম্পত্য জীবন। কিন্তু যৌতুকের মতো ঘটনাগুলো বিয়ের আগেই সম্পর্কের অবাধ সাগরে একটি বাধা সৃষ্টি করে। যার কারণে ভেঙে যায় আদর্শ পরিবার। লোপ পায় মানসিক শান্তি। আজকাল জ্ঞানী ব্যক্তিরাও বুঝে শুনেই এসব করে যাচ্ছে বিনা বাধায়।
বিয়ে-শাদী প্রত্যেক মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা। এ চাহিদা পূরণার্থেই ইসলামী শরিয়ত বিয়ের হুকুম আরোপ করেছে। বিয়ে বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা.এর গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত। প্রাপ্তবয়স্ক ও সামর্থ্যবান হলে জলদি বিয়ে করে নেয়া উচিত। বিয়ে শুধু জৈবিক চাহিদা পূরণই নয় বরং গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদতও বটে। বিয়ের মাধ্যমে দ্বীন ও দুনিয়ার কল্যাণ লাভ করা যায়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, সে সব মেয়েদের থেকে যাদের তোমাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই দুই, তিন তিন, কিংবা চার চারটি পর্যন্ত। আর যদি আশঙ্কা কর যে, তাদের মাঝে ন্যায়-সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না তবে একটি। [সূরা নিসা: ৩]
বৈবাহিক সম্পর্ক ভালবাসা ও সম্প্রীতির এক পবিত্রতম বন্ধন হওয়া সত্ত্বেও অনেক সময় এর মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় যৌতুক নামের অভিশাপ। যৌতুক সামাজিকভাবে যেমন ঘৃণিত তেমনি ইসলামেও তা নিষিদ্ধ এবং গর্হিত কাজ।
যৌতুকের কী?
বিয়ে উপলক্ষ্যে বর পক্ষ কন্যা পক্ষ থেকে বিয়ের আগে, বিয়ের মুহূর্তে কিংবা বিয়ের পরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দাবি করে যে সব অর্থ, বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট বা অন্য যে কোনো সামগ্রী আদায় করে নেয় তাকেই যৌতুক বলে।
জাহেলি যুগে নারীকে শুধু ভোগের সামগ্রী মনে করা হত। সমাজে তার ন্যূনতম মূল্য ছিল না। তাই মোটা অংকের সম্পদের বিনিময়ে তাকে বিয়ে দিতে হত। আর এ বিনিময় প্রথাই হচ্ছে যৌতুক। ইসলাম সেই ঘৃণ্য যৌতুক প্রথার মূলোৎপাটন করেছে। এক সময় হিন্দু সমাজে পিতার সম্পত্তিতে কন্যার অধিকার স্বীকৃত ছিল না। সে কারণে বিয়ের সময় পিতা কন্যাকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সাধ্যানুযায়ী দিয়ে দিত। সেটিই পরবর্তীকালে হিন্দুদের ধর্মীয় রীতিতে পরিণত হয়েছে। আর সমাজে যখন কোনো রীতি একবার প্রতিষ্ঠা পায় তখন একে সমূলে উৎখাত করা মোটেও সহজ কাজ নয়।
ভারতে ১৯৫৫ ও ১৯৫৬ সালে ভারতে আইন করে পিতার সম্পত্তিতে কন্যার উত্তরাধিকার নিশ্চিত করার পরও দেখা গেল, যৌতুকপ্রথা লোপ পায়নি। ১৯৬১ সালে তো ভারতে খোদ যৌতুককেই ‘বে-আইনী’ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তারপরও পুরোপুরি লোপ পায়নি এ কুপ্রথা। পাক ভারত বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিমের পাশাপাশি বসবাস থেকেই মুসলিম সমাজেও যৌতুক প্রথার অনুপ্রবেশ ঘটে।
শরীয়তের দৃষ্টিতে যৌতুক
শরীয়তের দৃষ্টিতে যৌতুক একটি অবৈধ ও ঘৃণিত প্রথা, যা কনে পক্ষের উপর অর্থনৈতিক জুলুম এবং অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জনের একটি হীন মাধ্যম। এ বিষয়ে আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।’ [সূরা বাকারা : ১৮৮]
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর যে কেউ সীমালঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা করবে তাকে আমি শিগগির আগুনে নিক্ষেপ করবে। এটা আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজ। [সূরা নিসা:৩০]
ইসলামী শরীয়তে যৌতুকের আদৌ কোন স্থান নেই বরং বিয়ে-শাদিতে শরিয়তের নির্দেশনা যৌতুকের সম্পূর্ণ বিপরীত। তা হচ্ছে স্বামীই স্ত্রীকে দেনমোহর হিসেবে শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সম্পদ আবশ্যিকভাবে প্রদান করবে। ইসলামে বিবাহ বন্ধনে মোহরানার গুরুত্ব অত্যধিক। মোহর প্রদান স্বামীর অন্যতম প্রধান দায়িত্ব এবং স্ত্রীর মৌলিক অধিকার। মোহরানা প্রদান বিষয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের দেনমোহর খুশিমনে প্রদান করবে। [সূরা নিসা:৪]
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এদের তথা মাহরাম ব্যতিত তোমাদের জন্য সকল নারীদের হালাল করা হয়েছে। শর্ত হচ্ছে-তোমরা তোমাদের অর্থের বিনিময়ে বিবাহের উদ্দেশে তাদের সন্ধান কর, ব্যভিচারের উদ্দেশে নয়। [সূরা নিসা:২৪]
যৌতুকের নেশা সমাজে মহামারীর আকার ধারণ করেছে। যৌতুক ছাড়া বিয়ে যেন সোনার হরিণ। কনের পিতার সামর্থ না থাকলেও কারো কাছ থেকে ধার-কর্জ করে কিংবা সুদের ওপর পয়সা নিয়ে হলেও জামাইয়ের যৌতুকের চাহিদা মেটাতে হয়। সমাজের এক শ্রেণির যৌতুকলোভী ব্যক্তিরা আবার যৌতুক নিচ্ছে অভিনব নামে। হাদিয়া, উপহার, সেলামি ও বখশিশসহ বিভিন্ন নামে গ্রহণ করছে ঘৃণ্য যৌতুক।
তবে কন্যার অভিভাবক বা আত্মীয়-স্বজন যদি স্বেচ্ছায় এবং সম্পূর্ণ চাপমুক্ত থেকে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী মেয়ে-জামাইকে কিছু প্রদান করে সেটাই শুধু হাদিয়া, উপহার বা বখশিশ বলে গণ্য হবে। অন্যথায় তা যৌতুক তথা হারামের অন্তর্ভুক্তই থেকে যাবে। রাসূল সা. বলেছেন, ‘যে উপহার খুশিমনে দেওয়া হয় সেটাই শুধু বৈধ।’ [মুসনাদে আহমাদ: হাদীস নং-২০৭১৪]
যৌতুকের সামাজিক ক্ষতি
যৌতুক পারিবারিক, সামাজিক ও বংশীয় দাঙ্গা-হাঙ্গামার অন্যতম কারণ। এর ফলে গোটা সমাজে বিভিন্ন সমস্যা, জুলুম-অত্যাচার ও অবিচারের সৃষ্টি হয়। পারিবারিক জীবনে অশান্তির ছায়া নেমে আসে। দাম্পত্য জীবনে দ্বন্দ¦-কলহের সৃষ্টি হয়। তাই যৌতুক একটি সামাজিক অভিশাপ। নারী নির্যাতনের এক ভয়াবহ হাতিয়ার। যা এখন আর দরিদ্র পরিবারেই সীমাবদ্ধ নেই। এর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়েছে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত বা ধনী পরিবারেও। যৌতুকের কারণে কনেকে খুনসহ বীভৎস নারী নির্যাতনের চিত্র প্রায়ই চোখে পড়ে। কেরোসিন ঢেলে স্ত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা করে পাষ- স্বামী। হতভাগী স্ত্রীর সুন্দর চেহারাকে এসিড মেরে দগ্ধ করে দেয়। আবার যৌতুকের দায়ে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গৃহবধু আত্মহত্যা করে। কখনো আবার এই যৌতুকের বলি হতে হয় সংসারের নিষ্পাপ ছেলে-মেয়েদেরও।
যৌতুক বিরোধী আইন ও এর বাস্তবায়ন
১৯৮০ সালে বাংলাদেশে যৌতুক বিরোধী আইন পাস হয়। তবে আইনটির যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই আইনের যথাযথ প্রয়োগ দরকার। যা সমাজে নারীকেন্দ্রিক বহু দূর্ঘটনার অবসান ঘটাতে পারে।
যৌতুক নারীকে পন্য করারই নামান্তর। এ জন্য আপামর জনতাকে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। যৌতুক অভিশাপ ছাড়া কিছুই নয়। আসুন যৌতুকের এ ভয়াবহতা থেকে নিজে বাঁচি। অন্যকে বাঁচাই