পূর্বেই আলোচনা হয়েছে, এ মাসের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যার জন্য মহান আল্লাহ এ মাসকে নির্ধারণ করেছেন। এ মাস কল্যাণ ও বরকতের মৌসুম। নেক আমল সম্পাদনের মৌসুম।
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান পাবার জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করতেন। রজব মাস আসলে তিনি এ বলে দোয়া করতেন।
: “اللهم بارك لنا في رجب وشعبان وبلغنا رمضان”
[ أخرجه البيهقي في شعب الايمان 7/398 رقم 3534، والبزار في مسنده 1/294ـ295 رقم 616 ـ كشف الأستار، وأبو نعيم في الحلية 6/269، وابن عساكر كما في كنز العمال رقم 18049 وضعفه الألباني في ضعيف الجامع رقم 4395 وكذا ضعفه محقق الشعب].
‘অর্থাৎ, হে আল্লাহ রজব ও শাবানকে আমাদের জন্য বরকতময় কর এবং আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দাও।,
(বাইহাকি/শুআবুল ঈমান, হাদিস নং ৩৫৩৪, বাযযার/মুসনাদ ৬১৬, প্রমূখ। আল্লামা আলবানি রহ. এ হাদিসকে জয়ীফ বলে মন্তব্য করেছেন, জয়ীফ আল-জামে হাদিস নং ৩৯৫ )
নবীজী নিজ সাহাবাদেরকে এ মাসের আগমনে সুসংবাদ প্রদান করতেন এবং তাদেরকে এর বৈশিষ্ট্যাবলি বর্ণনা করে শুনাতেন। বলতেন,
“أيها الناس قد أظلكم شهر عظيم مبارك”
অর্থাৎ, হে লোক সকল! এক মহান বরকতময় মাস তোমাদের উপর ছায়া ফেলেছে।
[فعن أبي هريرة رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: “أتاكم رمضان شهر مبارك، فرض الله عز وجل عليكم صيامه، تفتح فيه أبواب السماء وتغلق فيه أبواب الجحيم، وتغل فيه مردة الشياطين، لله فيه ليلة خير من ألف شهر، من حرم خيرها فقد حرم” أخرجه أحمد 2/230، 425 وعبد بن حميد في المنتخب رقم 1429 والنسائي 4 / 129]..
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের নিকট রমজান এসেছে, বরকতময় এক মাস। আল্লাহ তাআলা তোমাদের ওপর এর রোজা ফরজ করছেন। এ মাসে আকাশের সবগুলো দরজা খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের সবক’টি দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং দুষ্ট-অবাধ্য শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। এতে রয়েছে এমন এক রজনী, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে এ রাতের কল্যাণ হতে বঞ্চিত হয় সে (সর্বৈবভাবে) বঞ্চিত হয়। {বর্ণনায় আহমাদ২/২৩০, আব্দ বিন হুমায়দ, আল-মুন্তাখাব ১৪২৯ এবং নাসায়ী ৪/১২৯}
তিনি তাদেরকে এ মাসে ফরজ কিংবা নফল- সালাত, দান-সদকা, সৎ কাজ, দয়া-অনুগ্রহ, আল্লাহর ইবাদতে ধৈর্য্য ধারণ ইত্যাদি নেক আমল সম্পাদনে শ্রম ব্যয়ে উৎসাহ প্রদান করতেন। আরো উৎসাহ দিতেন মাসের দিবসগুলো রোজার মাধ্যমে আর রজনীগুলো কিয়ামের মাধ্যমে আবাদ করতে। প্রতিটি মুহূর্ত কোরআন তেলাওয়াত, আল্লাহ জিকিরে অতিবাহিত করতে।
সুতরাং শ্রদ্ধেয় পাঠক বৃন্দের নিকট আকুল আবেদন, এ মহিমান্বিত মাসকে উদাসীনতা ও উপেক্ষার মাধ্যমে নষ্ট করা হতে বিরত থাকুন। যেমনটি করে থাকে আত্মপ্রবঞ্চিত, দুর্ভাগা মানুষগুলো। যারা আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার কারণে আল্লাহ তাদেরকে তাদের নিজেদের সম্পর্কেই ভুলিয়ে দিয়েছেন। তাইতো কল্যাণকর মৌসুম অতিবাহিত হয়ে যায় কিন্তু তারা কোনোভাবে উপকৃত হতে পারে না। এর কোনো মূল্য, কোনো মর্যাদাই তারা জানে না।
বহু মানুষ আছে যারা এ মাসকে কেবল ভাল খাবারের মাস হিসাবে জ্ঞান করে থাকে। তাই নিজ চাহিদা পূরণে চেষ্টার ত্রুটি করে না। উন্নত খাদ্য-খাবার, উৎকৃষ্ট সব পানীয় জোগাড়ই তাদের মূখ্য কাজ হয়ে দাড়ায়। অথচ কে না জানে, অধিক পানাহার ইবাদতে বিঘ্নতার সৃষ্টি করে। প্রতিটি মুসলমানের নিকট শরিয়তের দাবিও হচ্ছে, পানাহার যতদূর সম্ভব কম করা যাতে ইবাদতের উদ্যম সৃষ্টি হয়। অধিকহারে ইবাদত করা যায়।
আবার কিছু মানুষ আছে যারা মাহে রমজানকে দিনে ঘুমানো আর রাতে জাগ্রত থাকার মাস হিসাবে জ্ঞান করে থাকে। ফলে দিনের বেলা ঘুমিয়ে কাটায় আর রাত অতিবাহিত করে অহেতুক ও ক্ষতিকর সব কাজে। সারা রাত জাগ্রত থাকার ফলে পূর্ণ দিন ঘুমোয়। জামাত বরং সময় মত নামাজের পর্যন্ত গুরুত্ব থাকে না।
কেউ কেউ আছে, রকমারী সব খাদ্য-খাবার নিয়ে ইফতার করতে বসে আর জামাতের সাথে মাগরিবের নামাজ আদায় করার কথা খেয়াল থাকে না বরং সে দিকে কোনো গুরুত্বই থাকে না।
এসব মানুষের কাছে মাহে রমজানের কোনো গুরুত্ব নেই। করণীয় কর্তব্যে অবহেলা ও অবৈধ কাজ সম্পাদন করে এ মাসের সম্মানহানি হতে বাঁচার কোনো তাগিদই তাদের নেই। এরা রমজানকে কেবল ব্যবসা-বাণিজ্যের মৌসুম হিসাবেই দেখে থাকে। সম্পদ আহরণ ও পার্থিব ঐশ্বর্য্য কামানোর মোক্ষম সুযোগ হিসাবেই বিবেচনা করে। ফলে কেনা-বেচায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মসজিদ ছেড়ে বাজারকেই ঠিকানা হিসাবে বেচে নেয়। মসজিদে যদি যায়ও কিন্তু খুব তাড়াহুড়া করে। মোটেও অপেক্ষা করতে চায় না। কারণ বাজারেই তারা হৃদয় তরীর নোঙ্গর ফেলেছে। সেখানেই তাদের আত্মিক প্রশান্তি খুঁজে।
এমনও কিছু মানুষ আছে রমজান মাস যাদের নিকট মসজিদ, হাট-বাজার রাস্তা-ঘাটসহ জন সমাগমের স্থানসমূহে ভিক্ষাবৃত্তির মাস বলে পরিগণিত। ফলে তারা এ মাসকে অতিবাহিত করে এখানে সেখানে যাওয়া-আসা, এ শহর থেকে অন্য শহরে সফর এবং এ স্থান থেকে ঐ স্থানে ছুটাছুটি করে ভিক্ষাবৃত্তি ও সম্পদ আহরণের ধান্ধায়। তারা মূলত: অভাবহীন এবং সুস্থ সবল। কিন্তু মানুষের কাছে নিজেদেরকে উপস্থাপন করে দরিদ্র-অভাবী, সহায়-সম্বলহীনরূপে। আল্লাহ প্রদত্ত সুস্থতা ও অভাবহীনতার মত অমূল্য নিয়ামত অস্বীকার করে তারা সম্পদ আহরণ করে অনুনোমোদিত ও অবৈধ পন্থায়। মহা মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করে মহা ক্ষতিকর কাজে । এ শ্রেণীর লোকের কাছে রমজানের কোনো মূল্য ও বৈশিষ্ট্যই অবশিষ্ট থাকে না।
হে আল্লাহর বান্দাবৃন্দ, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী সম্বন্ধে কম-বেশি আমাদের সকলেরই জানা আছে। সমস্ত সৃষ্টিকুলের মাঝে আল্লাহর সর্বাধিক ইবাদত সম্পাদনকারী ব্যক্তি নি:সন্দেহে তিনিই। সারা বছর প্রতিটি মুহূর্ত তিনি মহা মহিমের ইবাদতে কাটাতেন। ইবাদতই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান কাজ। তা সত্ত্বেও রমজান মাসে তিনি অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক প্ররিশ্রম করতেন। নিবিষ্ট মতে ইবাদতের জন্য এ মাসে অন্যসব ব্যস্ততা কমিয়ে দিতেন যা মূলত: ইবাদতই ছিল। উত্তম কাজ হতে অবসর হয়ে অতি উত্তম কাজে মনোনিবেশের উদ্দেশেই এমনটি করতেন।
সালাফে সালেহীনরাও নবী আদর্শের অনুবর্তিতায় আধ্যাত্মিক উন্নতি ও মাওলা সুবহানাহুর সান্নিধ্য-সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদত-আনুগত্যে এ মাসকে অধিক গুরুত্ব দিতেন। নেক আমল সম্পাদনের লক্ষ্যে অন্যান্য ব্যস্ততা কমিয়ে দিতেন। রাতগুলো তাহাজ্জুদ আর দিনগুলো রোজা, জিকির, কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদির মাধ্যমে আবাদ করতেন। এসব আমলের মাধ্যমে মসজিদগুলো থাকত সদা সজীব। প্রতিটি স্থান হতে রাহমানুর রাহীমের জিকিরের গুঞ্জরণ প্রতিধ্বনিত হত। এ যেন নির্মল এক বেহেস্তি পরিবেশ।
তাদের সাথে আমরা আমাদের অবস্থা একটু তুলনা করে দেখিতো। এ মাস সম্বন্ধে আমাদের অনুভূতি কি? কত টুকু নাড়া দিতে পেরেছে আমাদেরকে এ মাস?
সম্মানিত ভ্রাতৃবৃন্দ! এ মাসে নেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করে দেওয়া হয় ঠিক। একইভাবে পাপকাজের শাস্তিও কিন্তু কঠিন করে দেওয়া হয়। সুতরাং আমাদের আল্লাহকে ভয় করা উচিৎ। সম্মান প্রদর্শন করা উচিৎ তাঁর নিদর্শনসমূহকে।
{ومن يعظم حرمات الله فهو خير له عند ربه} [الحج 30].
আর কেউ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত পবিত্র বিষয়সমূহকে সম্মান করলে তার রবের নিকট তা-ই তার জন্য উত্তম। (সূরা হাজ, আয়াত ৩০)
আল্লাহ আমাদের সকলকে নেক কথা ও কাজে ব্যস্ত হবার তাওফিক দান করুন। শত কোটি দরূদ ও সালাম আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর।