Main Menu

রমজান তাকওয়া অর্জনের মাস

রমজান তাকওয়া অর্জনের মাস

রমজান তাকওয়া অর্জনের মাস

রমজান মুসলিম মিল্লাতের জন্য বড় নিয়ামত ও ফজীলতের মাস। এ মাসে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার প্রিয় রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাজিল করেন মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। আল-কুরআনের সূরা বাকারায় ইরশাদ হয়েছে : রমজান মাসে অবতীর্ণ করা হয় কুরআন। শুধু আল-কুরআন নাজিল দ্বারাই এ মাসের ফজীলত ক্ষ্যান্ত করা হয়নি। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে : এ মাসে এমন একটি রাত আছে যার মর্যাদা হাজার মাসের চেয়েও অধিক। যেমন সূরা আল-কদরে বর্ণিত হয়েছে : কদরের রাত সহস্র মাসের চেয়ে উত্তম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি ঈমান ও সদিচ্ছাসহ রোজা পালন করল ওই ব্যক্তির আগের কৃত সব গোনাহ ক্ষমা করা হবে।

রমজান মাসের রোজা আল্লাহ তা’আলা সব বয়স্ক জ্ঞানবান লোকের ওপর ফরজ হিসেবে ঘোষণা করেছেন, সূরা বাকারায় ইরশাদ হয়েছে : তোমাদের উপর রোজা ফরজ করে দেয়া হয়েছে যেভাবে ফরজ করে দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়াবান হতে পার (সূরা বাকারা-১৮৩)

এ আয়াতে একটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যারা রোজা রাখবে তাদের জন্য ফলাফলস্বরূপ বলা হয়েছে তারা তাকওয়াবান হবে। তাকওয়া কি? এবং একটি মাস উপবাস থেকে এত ত্যাগ করে ওই বস্তু হাসিল করতে হবে এর মূল রহস্যই বা কি? এ বিষয় নিম্নের আলোচনায় স্পষ্ট হবে, ইনশা আল্লাহ।

তাকওয়া শব্দের অনেক অর্থ রয়েছে : তন্মধ্যে পরিত্যাগ করা, আত্মরক্ষা করা ও আল্লাহভীতি প্রসিদ্ধ।

পরিভাষায় তাকওয়া বলা হয় : মহান আল্লাহর ভয় অন্তরে সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেকে সব অপকর্ম থেকে বিরত রাখা এবং সব কর্তব্য পালন করা। এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। আল্লাহ তা’আলা তাকওয়া অর্জনের জন্য বহুবার মানুষকে তাগিদ দিয়েছেন পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে।

  • আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে ভয় কর এবং তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা আল ইমরান-১০২)
  • অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : হে ঈমানদাররা তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তি যেন লক্ষ্য করে আগামী দিনের জন্য কী প্রস্তুত করছে, আল্লাহ তোমাদের কর্ম সম্পর্কে অবগত। (সূরা হাশর-১৮)
  • আল্লাহ তা’আলা আরো ইরশাদ করেন : হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও। (সূরা তওবা-১১৯)
  • আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : নিশ্চয়ই আল্লাহ যারা মুত্তাকি এবং যারা সত্কর্মপরায়ণশীল তাদের সঙ্গে রয়েছেন। (সূরা নাহল-১২৮)
  • আল্লাহ তা’আলা আরো ইরশাদ করেন : তোমরা সত্ ও তাকওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা কর, তোমরা পাপ ও সীমালংঘনের কর্মে সহযোগিতা কর না, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা (সূরা মায়েদা-২)
  • অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা সফলতা অর্জন করতে পার। (সূরা বাকারা-১৮৯)
  • আল্লাহ তা’আলা আরো ইরশাদ করেন : হে নবী আপনি আল্লাহকে ভয় করুন এবং আপনি কাফের ও মুনাফিকদের অনুসরণ করবেন না, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী। (সূরা আহযাব-১)
  • আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানিত সে যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহভীরু। (সূরা হুজুরাত-13)

এছাড়াও অসংখ্য আয়াত রয়েছে যা দ্বারা আল্লাহ তা’আলা মানবজাতি এমনকি নবীদেরকেও তাকওয়া অর্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। যা দ্বারা তাকওয়া অর্জনের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা বোঝা যায়। কেননা তাকওয়া অর্জন ছাড়া একজন মানুষ মুমিনই হতে পারে না। তাকওয়া দ্বারা মানুষের গোটা জীবন পরিচালিত হয়। তাই যার মাঝে তাকওয়া নেই সে তার গোটা জীবন কুফরি অবস্থায় অতিবাহিত করে। পক্ষান্তরে যার মাঝে তাকওয়া রয়েছে তার গোটা জীবন পরিচালিত হয় মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিধান ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদর্শিত আদর্শ মোতাবেক।

তাই মানুষকে জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে হলে সর্বপ্রথম তাকওয়া অর্জন করতে হবে। কেননা তাকওয়া দ্বারাই প্রতিটি মানুষ স্বমহিমায় অবস্থান করতে পারে। তাকওয়া দ্বারা শুধু পরকালে লাভ রয়েছে এটাই শেষ কথা নয়। পার্থিব সুখ-শান্তি বজায় রাখতে হলে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাকওয়া অর্জন করা। তাকওয়া অর্জন করার গুরুত্ব ও তাত্পর্য কতটা ব্যাপক তা সূক্ষ্মভাবে আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের দিকে লক্ষ্য করলে স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন পূর্ববর্তী যত নবী ও রাসূল এ ধরায় আগমন করেছেন তাঁরা সব তাঁর স্বীয় জাতিকে সর্বপ্রথম যে দাওয়াত পেশ করেছিলেন তার মধ্যে আল্লাহকে উপাস্যরূপে গ্রহণ এবং তাকওয়া অর্জনই ছিল মূল বিষয়।

যথা হযরত হুদ (আ)-এর সম্পর্কে বলা হয়েছে : স্মরণ করুন সে সময়ের কথা, যখন হুদ তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন তোমরা কি তাকওয়াশীল হবে না? (সূরা শুয়ারা-১২৪)

অন্য আয়াতে সালেহ (আ)-এর সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে : স্মরণ করুন সে সময়ের কথা, যখন সালেহ (আ) তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, তোমরা কি তাকওয়া অবলম্বন করবে না। নিশ্চয়ই আমি তোমাদের জন্য বিশ্বস্ত রাসূল। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। (সূরা শুয়ারা-১৪২)

অন্যত্র শোয়াইব (আ) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে : স্মরণ করুন সে সময়ের কথা যখন শোয়াইব (আ) বলেছিলেন, তোমরা কি মুত্তাকি হবে না? আমি তোমাদের নিকট বিশ্বস্ত রাসূল। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। (সূরা শুয়ারা-১৭৭)

যে ব্যক্তি এ গুণ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে সেই মুত্তাকী। তার ইহকালে যেমন মানুষের কাছে সম্মান রয়েছে, পরকালে রয়েছে অফুরন্ত নেয়ামত। যেমনি পবিত্র কুরআনের সূরা আ’রাফের ৯৬ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে : যদি গ্রামবাসীরা ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি আসমান এবং জমিনের সব বরকত তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতাম।

তেমনি অন্য আয়াতে বর্ণিত আছে : নিশ্চয়ই যারা মুত্তাকী তাদের জন্য পরকাল মঙ্গলময় হবে। (সুরা আরাফ-১৬৯) এ গুণ লাভ করতে হলে সর্বোত্তম সময় হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। কারণ এ মাসে মানুষ রোজা রেখে সারাদিন কোনো প্রকার গুনাহের কাজ তার দ্বারা সম্পাদন হয় না। রাতের বেলা নফল নামাজ পড়ে এবং অধিক পরিমাণে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে। ফলে একজন মানুষ তাকওয়া অর্জনের মূলধারা বা পথ খুঁজে পায়। রমজানের মধ্যে মানুষ কোনো প্রকার খারাপ বা অশ্লীল কাজ করতে সাহস করে না। রমজান মাসে মূল যে শিক্ষা তা মূলত এটাই যে তাকওয়া অর্জন।

মানুষ রোজা রাখে, সারাদিন উপবাস করে। তার সামনে অনেক খাবার ও পানীয় থাকে সে ইচ্ছে করলে তা খেতে পারে; কিন্তু সে তা স্পর্শও করে না। বহু সুযোগ থাকে মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে কিছু খেয়ে নেয়ার; কিন্তু সে খায় না। এর মূল কারণ, সে মহান আল্লাহকে ভয় করে। যেমন হাদীসে কুদসী দ্বারা মহান আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে : রোজা আমার জন্য আর এর বিনিময় আমিই দেব। এখানে যেমন মানুষ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কিছু খায় না বা পান করে না সেহেতু সে জানে মানুষ না দেখলেও আল্লাহ ঠিকই সবকিছু দেখেন এবং তিনি সর্বত্র অবগত আছেন। তেমনি মানুষ পরবর্তী সময়ে যদি তার এ চরিত্র বা এ অবস্থা চালু রাখতে পারে তাহলে সে পরবর্তী সময় কোনো দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ড করতে পারে না। কারণ,  তার মনে ওই বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপে জানা আছে যদি সে কোনো কুকর্ম করে তাহলে আল্লাহ তার এ কর্মের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করবে।

রমজান এমন একটি মাস যে মাসে জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ থাকে, জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়। শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়, যাতে সে মানুষকে কুকর্মে প্ররোচিত করতে না পারে। অগণিত জাহান্নামীকে এ মাসের উছিলায় আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। একটি নফল ইবাদতের ছওয়াব একটি ফরজ ইবাদতের সমতুল্য করে দেন। একটি ফরজ ইবাদতের ছওয়াব ৭০ গুণ বৃদ্ধি করে দেন। এভাবে পবিত্র রমজান মাস পুরোটাই একটি নেয়ামত ও বরকতপূর্ণ মাস। যদি কোনো ব্যক্তি চায় অন্যান্য সময়ে ভালো কাজ করবে তার উচিত এ মাসে পূর্ণরুপে ইবাদতে মশগুল হওয়া। কারণ এর দ্বারাই সে পরবর্তী সময় নিজেকে একজন মুত্তাকী বান্দা হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। তাই রমজান মাস মানুষকে তাকওয়ার শিক্ষাই দিয়ে থাকে।

রমজান মাসে আসলে স্বাভাবিকভাবে মানব সমাজে অনেক পরিবর্তন আসে। এসব পরিবর্তন মানব জাতিকে নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। পরবর্তী ১১টি মাস যাতে সে নিয়ম মাফিক চলতে পারে তারই একটা ট্রেনিং হিসেবে পবিত্র রমজান মাস মানুষের দ্বারে দ্বারে প্রতি বছর একবার করে ঘুরে আসে। যে ব্যক্তি এ মাসকে গুরুত্ব সহকারে অতিবাহিত করবে সে পরবর্তী ১১টি মাস সব কাজই মহান আল্লাহর রেজামন্দী মোতাবেক করতে সক্ষম হবে। যে ব্যক্তি এ মাসকে অবহেলায় অতিবাহিত করল, রোজা রাখল না, নামাজ পড়ল না, দান-ছাদকা করল না, পবিত্র রমজান মাস তার জন্য অভিসম্পাত করে। যেমনিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন : ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক যে রমজান মাস পেল অথচ ইবাদত-বন্দেগী করে সে আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহকে ক্ষমা করিয়ে নিষ্পাপ হতে পারল না।

তাই প্রত্যেক মানুষের উচিত পবিত্র মাহে রমজানকে যথাযথভাবে ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করা। ইবাদতের পরিমাণ বৃদ্ধি করা, পবিত্রগ্রন্থ আল-কুরআন অধ্যয়ন করা, নফল ইবাদত বেশি পরিমাণে আদায় করা। সকল পাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। হাত, মুখ, চোখ ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা যেন কোনো প্রকার গুনাহ সংঘটিত না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখা। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : অনেক রোজাদার আছে যাদের রোজা উপবাস ছাড়া কিছুই হয় না। কতিপয় লোক আছে যারা রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে তাদের এ নামাজ রাত জাগ্রত ছাড়া কোনো উপকারে আসে না। এর কারণ হচ্ছে যারা রোজাও রাখে আর অন্যান্য পাপকর্ম ছাড়তে পারে না তাদের এ রোজা ওই ব্যক্তির কোনো উপকার করতে পারে না। তাই রোজা রাখতে হবে হক আদায়সহ। অর্থাত, সকল অপকর্ম পরিত্যাগ করতে হবে এবং পরবর্তী সময়ে যেন এর ফলাফল বিদ্যমান থাকে তার সার্বিক ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে যদি রোজার মাসে হক আদায় করে রোজা রাখা যায় তাহলে ওই ব্যক্তি তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হবে। আর তাকওয়া একবার যদি কারো মাঝে এসেই যায় তার ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতে সফলতা লাভ করতে পারবে। তাকওয়া অর্জন করতে বেশি ইবাদত করা দরকার। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে পবিত্র মাহে রমজানের মূল শিক্ষা তাকওয়া অর্জনের তাওফীক দান করুন। আমীন…

Related Post