মাহে রমযান হতে আমরা কি উপকারিতা গ্রহণ করলাম? আমরা তো কোরআনের মাস কে বিদায় জানালাম। অমরা অতিবাহিত করলাম তাকওয়ার মাস। আমরা বিদায় জানালাম ধৈর্যের মাস। যাতে আমরা আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ ও পাপাচার হতে বিরত থাকর মাধ্যমে ধৈর্যের অনুশীলন করেছি। আমরা অতিবাহিত করলাম জিহাদের মাস। ২য় হিজরীর এ মাসেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ফুরকান তথা হক ও বাতিলের পার্থক্য নিরূপণ কারী বদর যুদ্ধ। আমরা অতিবাহিত করলাম রহমতের মাস, বরকতের মাস, মাগফিরাতের মাস ও জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তির মাস (উল্লেখ্য উক্ত বিষয়গুলি একমাত্র রমজানের জন্যই নির্ধারিত নয় বরং সব সময়ের জন্য তবে এ মাসে এ গুলির গুরুত্ব ও ফজীলত বেশী)।
যেহেতু আমরা রমযানের প্রতিষ্ঠান হতে মুত্তাকীর সনদ নিয়ে বের হলাম, তবে কি আমরা যথাযথ তাকওয়া অর্জন করতে পেরেছি?
আমরা কি আত্মা ও প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদে বিজয় লাভ করতে পেরেছি, না অপসংস্কৃতি, কুসংস্কার, বদভ্যাস, যত অনৈসলামী কৃষ্ঠি-কালচার আমাদের মাঝে ছেয়ে বসেছ? আমরা কি রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও মুক্তি পাওয়ার মাধ্যম গুলির অনুশীলন করেছি? বহু জিজ্ঞাসা…এর উত্তর নিজেই তালাশ করি।
রমযান হল ঈমান বৃদ্ধির এক মহাবিদ্যালয়। এটি অবশিষ্ট বছরের আত্মিক পাথেয় সংগ্রহের এক মহা কেন্দ্র। সুতরাং যে এই রমাযান হতে উপদেশ ও উপকার গ্রহণ করতে পারল না এবং স্বীয় জীবনকে পরিবর্তন করতে পারল না তবে কখন?
আসুন আমরা এই মহাবিদ্যালয় হতে আমাদের আমল, আখলাক চরিত্র, অভ্যাস ও ব্যবহারকে ইসলামী শরীয়ত সম্মত করি। আল্লাহ তায়ালা বলেন :-
إِنَّ اللّهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنْفُسِهِمْ
“আল্লাহ কোন জাতির অবস্থান পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা তাদের নিজেদের অবস্থান নিজে পরিবর্তন না করে।” (আর রাদ: ১১)
রমাযান কেন্দ্রিক মানুষের প্রকারভেদ:
১) রমাযানের পূর্বেও তারা আল্লাহর অনুগত হয়ে ইবাদত-বন্দেগী করত। রমাযান মাসের আগমনে এর ফজীলত ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে তারা আরও তৎপর হয়। তাঁদের প্রতি আমাদের আহ্বান তাঁরা যেন রমাযানের পরেও আল্লাহর আনুগত্য ও অনুসরণে এবং ইবাদত- বন্দেগীতে সদা অটল থাকেন।
২) রমাযানের পূর্বে তারা ছিল গাফেল-উদাসীন। রমাযান মাসের আগমনে এর ফজীলত ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে তারা তৎপর হয়। এদেরকে আমরা আহ্বান জনাই , তারা যেন রমাযানের পর ইবাদত-বন্দেগী হতে পুনরায় গাফেল না হয়ে আজীবন ইবাদতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।
৩) রমাযান আগমন করল ও বিদায় হয়ে গেল তাদের কোন উপলব্ধি ও পরিবর্তন ঘটল না। তাদেরকে আমরা উদাত্ত আহ্বান জানাই, আল্লাহর নিকট তওবা করতে ও তাঁর আনুগত্যের পথে ফিরে আসতে।
প্রিয় পাঠক । আপনি যদি রমযান হতে যারা উপকৃত তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে মুত্তাকী পরেহেযগারদের গুণে গুণান্বিত হন এবং যথাযথ রোযা পালন করে থাকেন। প্রকৃত ভাবেই ইবাদত বন্দেগী করে থাকেন এবং কু প্রবৃত্তিকে যথাযথ দমন করে থাকেন তবে আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন এবং তার উপর মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করুন। পক্ষান্তরে আপনাকে সতর্ক থাকার আহবান জানাই, আপনি ঐ ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত হবেন না যেমন এক বুড়ি উত্তমরূপে চরকায় সূতা, কেটে সুন্দর একটি পোশাক তৈরি করল যার ফলে সবাই তার প্রশংসা করল ও মুগ্ধ হল এবং সে নিজেও আনন্দিত হল। হঠাৎ করে একদিন অকারণেই উক্ত পোশাকটি একটি একটি করে সুতা খুলে নষ্ট করে ফেলল। অতএব মানুষ তাকে কি বলতে পারে?
ঠিক অনুরূপ ঐ ব্যক্তির অবস্থা যে রমাযানোত্তর পুনরায় পাপাচার ও অন্যায়ে ফিরে আসে এবং সৎ আমল পরিত্যাগ করে এরা কতইনা নিকৃষ্ট যারা আল্লাহকে শুধুমাত্র রমাযানেই স্মরণ করে।
এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَلاَ تَكُونُواْ كَالَّتِي نَقَضَتْ غَزْلَهَا مِن بَعْدِ قُوَّةٍ أَنكَا
” তোমরা সেই নারীর মত হয়ো না , যে তার সূতা মজবুত করে পাকাবার পর তার পাক খুলে নষ্ট করে দেয়।” (সূরা নাহাল: ৯২)
রমযানের পর অঙ্গিকার ভঙ্গ করে পাপাচারে ফিরে যাওয়ার লক্ষণ:
রমযান মাসে সৎ আমলের যথাযথ অনুশীলন করা সত্ত্বেও কৃত অঙ্গিকার ভঙ্গ করার বহু লক্ষণ রয়েছে দৃষ্টান্ত স্বরূপ:
(১) ঈদের দিনই জামাতের সাথে নামায আদায় না করা বা পূর্ণ পাঁচ ওয়াক্ত আদায় না করা।
(২) ঈদের খুশীর নামে গান বাজনা, ছায়াছবি, ডিশ ও ভিডিও তে অবৈধ অনুষ্ঠানমালা দর্শনে মেতে ওঠা এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার চর্চা।
(৩) ঈদ উপলক্ষে বেপর্দা ও অবাধে নারীদের বিচরণ করা এবং পার্ক, বিভিন্ন অনুষ্ঠান কেন্দ্র ও খেল-তামাশার স্থানে নারী পুরুষের অবাধ সংমিশ্রণ।
তবে এ গুলিই কি রমাযানের আমলগুলি কবুলের আলামত? না বরং এ সব হচ্ছে তার আমল কবুল না হওয়ার আলামত। কেননা প্রকৃত রোযাদার ঈদের দিন আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আদায় করে। খুশি হবে যে সে দীর্ঘ একমাস আল্লাহর হুকুম পালন করে আজ অনেক কিছু হতে মুক্ত। এবং সাথে সাথে সে ভয়ে ভিত থাকবে যে আল্লাহ আমার আমল নাও কবুল করতে পারেন। এ জন্য সে তাঁর নিকট প্রার্থনা করবে যাতে উক্ত আমল কবুল হয়। যেমন আমাদের মহান উত্তর সূরীগণ ছয়মাস পর্যন্ত রমযানের আমলগুলি কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতেন।
সুতরাং রমযানের আমল কবুলের আলামত হল, বান্দা নিজেকে তার পূর্বের অবস্থার চেয়ে উত্তমাবস্থায় পৌঁছাবে এবং সৎ কর্মে পূর্বের চেয়ে অগ্রগামী হবে। অতএব আমরা শুধু মৌসুম ভিত্তিক এবাদত করেই বিরত থাকব না বরং আমরা সব সময়ের জন্য এবাদত জারি রাখব। কেননা আল্লাহ বলেন:
وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ
” তুমি মৃত্যু অবধি তোমার রবের এবাদত করতে থাক।” (সুরা হিজর: ৯৯)
রমযানের পর আমলের ধারাবাহিকতা রক্ষা:
রমযান অতিবাহিত হয়ে গেলেও মুমিনদের জন্য মৃত্যু পর্যন্ত আমলের ধারাবাহিকতা ছিন্ন হবে না:
প্রথমত: রমযানের রোযা শেষ হলেও অবশিষ্ট মাসগুলিতে বহু নফল রোযা রয়েছে। যেমন,
(১) শাওয়াল মাসের ছয়টি রোযা: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি রমযান মাসের রোযা রাখার পর শাওয়াল মাসের ছয়টি রোযা মিলিয়ে নিলো তার পুরা বছরের রোযা রাখার সমতুল্য হল।” (মুসলিম)
কেননা সাওবান (রা.) হতে মারফু হিসেবে বর্ণিত হয়েছে, রমযান মাসের রোযা দশ মাসের তুল্য আর শাওয়ালের ছয় দিনের রোযা দুই মাসের সমান, এভাবেই পূর্ণ বছরের রোযা। (ইবনে খুজাইমা ও ইবনে হিব্বান আর ইবনে জারুল্লাহর রিসালাহ রমাযান হতে গৃহীত)
আর প্রত্যেক আমলের নেকি দশগুণ বৃদ্ধি পায়, অতএব রমাযান মাসের রোযা তিন শত দিনের সমান এবং শাওয়ালের ছয়টি রোযা ৬০দিনের সমান অতএব সর্বমোট ৩৬০দিন আর হিজরী বছর হয় ৩৬০ দিনে।
(২) প্রতি চন্দ্রমাসের তিন দিন রোযা রাখাঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “প্রতি মাসের তিন দিন এবং এক রমযান হতে অন্য রমযানের রোযা পূর্ণ বছর রোযা রাখার সমতুল্য। (মুসলিম) আর এ রোযা প্রতিমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রাখা উত্তম যা অন্য হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত।
(৩) প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার ও সোমবার রোযা রাখা: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: সোম ও বৃহস্পতিবার আমলনামা আল্লাহর নিকট পেশ হয়, সুতরাং আমি পছন্দ করি আমার আমল পেশ হচ্ছে এমতাবস্থায় আমি রোযা আছি”।(তিরমিযী:৭৪৭, তিনি হাদিসটি হাসান বলেছেন)
(৪) আরাফা দিনের রোযা: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম))কে আরাফা দিনের রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন: “এই রোযা বিগত বছর ও আগামী বছরের (ছোট গুনাহের) কাফফারা হয়।” (মুসলিম)।
(৫) আশুরার রোযা: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে আশুরার রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন: “বিগত বছরের (ছোট) গুনাহের কাফফারা।” (মুসলিম)
(৬) শাবান মাসে বেশি বেশি রোযা রাখা: শবে বরাত ধারণা করে ১৫ই শাবানকে নির্ধারণ না করে এ মাসে বেশি বেশি রোযা রাখা যায়। কেননা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমযানের পর এ মাসেই বেশি রোযা রাখতেন। ১৫ই রমযান খাস করেন নি।
দ্বিতীয়ত: রমাযানের তারাবীর নামায শেষ, তবে এই নামায তথা কিয়ামুল লাইল তাহাজ্জুদ হিসেবে সারা বছর পড়া যায়। নবী (সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ফরজ ব্যতীত সর্বোত্তম নামায হল রাত্রির নামায- তাহাজ্জুদ। (মুসলিম)
তৃতীয়ত: ফরজ নামায সংশ্লিষ্ট ১২ রাকাত সুন্নাতে মুয়াকাদাহ আদায়: জহরের পূর্বে চার রাকাত পরে দুই রাকাত, মাগরিবের পর দুই রাকাত, এশার পর দুই রাকাত এবং ফজরের পূর্বের দুই রাকাত। নবী (সাল্লাল্লাহু আলই হি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “যে ব্যক্তি ফরয ছাড়াও ১২ রাকাত দিবা রাত্রিতে সুন্নত আদায় করল আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করবেন।” (মুসলিম)
চতুর্থত: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইরশাদ কৃত নামাযের পরে ও সকাল সন্ধ্যার দোয়া জিকির।
পঞ্চমত: সাদাকাতুল ফিতর শেষ হলেও সারা বছর সাধারণ দান-সদাকা করা যায়।
ষষ্ঠত: কুরআন তেলাওয়াতের ফযিলত সব সময়ের জন্য; শুধু রমযানের জন্য নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যারা কোরআন হতে একটি অক্ষর পড়ল তার জন্য একটি নেকি, আর একটি নেকি দশগুণে বর্ধিত হয়। আমি বলি না যে “আলিফ লাম মিম” মাত্র একটি অক্ষর বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর, ও মিম একটি অক্ষর।” (তিরমিযী:২৯১০, তিনি হাদিসটি সহীহ হাসান বলেছেন)
তিনি আরও বলেছেন:
“তোমরা কোরআন পাঠকর, কেননা তা কিয়ামতের দিন পাঠকারীদের জন্য শাফায়াতকারী হিসেবে আসবে।” (মুসলিম)
সম্মানিত পাঠক, এ ভাবে সব সময়ের জন্য সৎ আমলের দ্বার উন্মুক্ত রয়েছে। অতএব আপনি যথাযথ প্রচেষ্টা জারি রাখুন, অলসতা বর্জন করুন। যদিও নফল সুন্নাতে আপনার দুর্বলতা থাকে কিন্তু কোন ক্রমেই যেন ফরজ আদায়ে ত্রুটি না হয়। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতের সাথে আদায় করা ইত্যাদি।
পরিশেষে, আল্লাহর নিকট প্রার্থনা তিনি যেন আমাদেরকে সহীহ আকীদাও সৎ আমলের উপর সুদৃঢ় রাখেন এবং এমতাবস্থায় মৃত্যু দান করেন। আমীন