রাসূলের জীবনে সর্বশেষ অভিযান
কালজয়ী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত শান্তির ধর্ম ইসলামকে প্রতিরোধ করার জন্য দুশমনেরা যুদ্ধের ময়দানে মুসলমানদেরকে বার বার আহ্বান করেছে। তাদেরকে কখনো শান্তিতে জীবন যাপন করতে দেয়নি। প্রতি পদে পদে তাদেরকে উৎপীড়ন করেছে, জুলুম- নির্যাতন চালিয়েছে, ঘরবাড়ী ছাড়া করেছে, এমনকি শহীদ করেছে। তাদেরকে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলার জন্য বার বার যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। মক্কায় থাকাকালীন সময় আবু জেহেল, উৎবাহ, শায়বার নেতৃত্বে মুসলমানদের ওপর যুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে। আর মদীনায় আসার পর থেকে মক্কার দুশমনদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তৎকালীন বিশ্ব মোড়লেরা। যেমন, রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস, পারস্য সম্রাট খসরু, মিসরাধিপতি মোকাওকাস, আরবের গাসসানী বংশোদ্ভূত শোরাহবীল ইবনে আমর প্রমূখ ব্যক্তি ও সাম্রাজ্যসমূহ মুসলমানদের বিরুদ্ধে সবসময় খড়গহস্ত থেকেছে। হিজরী অষ্টম সালে রাসূল (সা.) হারেস ইবনে উমাইর (রা.)কে শোরাহবীলের নিকট দূত হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন। এই কুলাঙ্গার আন্তর্জাতিক রীতি-নীতির কোন তোয়াক্কা না করে রাসূল (সা.)এর পাঠানো দূত হারেস (রা.)কে শহীদ করে। যার সূত্র ধরে মুতার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যে যুদ্ধে পর পর তিনজন মুসলিম সেনাপতি শহীদ হয়েছিলেন। এর মধ্যে প্রথম ছিলেন যায়েদ বিন হারেস (রা.)। রাসূল (সা.)এর জীবনের শেষ দিকে এসে সেই যায়েদের পুত্র উসামা (রা.)-এর নেতৃত্বে রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতির নির্দেশ প্রদান করেন। বিশাল এলাকার অধিকারী পরাশক্তি রোম স¤্রাজ্যের শাসকেরা ইসলাম ও মুসলমানদের বেঁচে থাকার অধিকার মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলনা। যার ফলে এ এলাকায় কারো ইসলাম গ্রহণ করা ছিল বিপজ্জনক। রোম স¤্রাজ্যের শাসকবর্গের এ ধরনের ঔদ্ধত্য ও অহংকারপূর্ণ আচরণের কারণে তাদের বিরুদ্ধে রাসূল (সা.) একটি বাহিনী প্রেরণের সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই বাহিনীর সেনাপতির দায়িত্ব দিলেন যায়েদ বিন উসামা (রা.)-কে। রাসূল (সা.) নির্দেশ দিলেন যে, বালকা এলাকা এবং দারুমের ফিলিস্তিন ভূখন্ড নাস্তানাবুদ করে এসো। রোমকদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বসবসকারী মুসলমানদের নিরাপত্তা বিধান ও তাদের মনে সাহস সঞ্চার করাই ছিল এ অভিযানের উদ্দেশ্যে। যাতে কেউ একথা ভাবতে না পারে যে, খ্রিস্টানদের বাড়াবাড়ি ও স্বেচ্ছাচারিতার সামনে কথা বলার কেউ নেই। তা ছাড়া কেউ যাতে এই ভয়ে ভীত না হয় যে, ইসলাম গ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে নিজের মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানো।
রাসূল (সা.) আজীবন মানবতার কল্যাণে সংগ্রাম করেছেন। বিশেষ করে মুসলমানদের নিরাপত্তা বিধানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কেন তিনি এ বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন? কারণ, শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত হচ্ছে মানুষের জীবনের নিরাপত্তার গ্যারান্টি থাকা। ‘নিরাপত্তা’ শব্দটি একটি বহুমাত্রিক অর্থবোধদ শব্দ। এর সাথে জড়িত রয়েছে মানুষের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু, ন্যায্যবিচার, রাজনীতি, অর্থনীতি ও ধর্মীয় নিরাপত্তাসহ জীবনের প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ের নিরাপত্তার গ্যারান্টি। নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার মাইেন হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ ও বিপজ্জনক হওয়া। কোথাও যদি নিরাপত্তা বিঘিœত হয় তাহলে সেখানে পরিস্থিতি থাকে মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। নিরপরাধ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনি-মিনি খেলা হয়। সম্মানিত ব্যক্তিদের অপমান করা হয়, মানুষের প্রতি বেপরোয়া জুলুম-নির্যাতন বেড়ে যায়। নারীদের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়, শিশুদেরকে হত্যা করা হয়, ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া হয়। ন্যায়বিচার থাকে না, অজ্ঞতা-মূর্খতা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। শান্তির পরিবর্তে সর্বত্র ভয়ভীতি বিরাজ করে। স্বচ্ছলতার পরিবর্তে অভাব-অনটন ও বেকারত্ব দেখা দেয়। মানুষের জীবনে নেমে আসে এক মহা বিপর্যয়।
রাজনৈতিক নিরাপত্তার অন্যতম দিক হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য অটুট রাখা। কারণ, ইসলামের শত্রুরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে মুসলমানদের দোষারোপ করতে চায়। যাতে তারা মুসলিম উম্মাহর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সহজে হস্তক্ষেপ করতে পারে। কাজেই যে কোন মূল্যেই হোক এ ঐক্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মুসলিম নেতৃত্বের উচিত শত্রুদের ষড়যন্ত্রের বিষয় জাতির সামনে তুলে ধরা। জাতির উচিত শত্রুর কোন ফাঁদে পা না দেয়া। আজ মুসলমানদের রাজনৈতিক নিরাপত্তা না থাকার কারণে মুসলিম উম্মাহ শত্রুর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক নিরাপত্তার সাথেই জড়িত রয়েছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। ইসলামী রাজনীতির নিরাপত্তা না থাকায় আজ মুসলমানদের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে শত্রুরা। বহুজাতিক কোম্পানীগুলো মুসলমানদের অর্থনীতিকে সুদের সাথে মিশিয়ে দিয়েছে এবং তারাই বাজার অর্থনীতি দখল করে রেখেছে। যে পর্যন্ত মুসলমানরা কুরআনী রাজনীতির নিরাপত্তা বিধান না করবে, সে পর্যন্ত তাদের অর্থনীতি রাহুমুক্ত হবে না। আর উল্লেখিত ক্ষেত্রসমূহে নিরাপত্তা না থাকায় আজ মুসলমানদের ধর্মীয় নিরাপত্তা টুকুও হারিয়েছে। সঠিকভাবে ইসলামের প্রতিটি বিধান পালন করতে গেলেই তাকে জংঙ্গিবাদী, মৌলবাদী, সন্ত্রাসীসহ নানা অপবাদ দিয়ে হত্যা করছে। এর ফলে আজ মুসলমানরা তাদের উত্থান-পতনের একমাত্র কিতাব আল কুরআনের অনুসরণ ছেড়ে দিয়ে বিজাতীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করছে। এখন বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, রাসূল (সা.)কে কেন একের পর যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল। সর্বশেষ তাঁর জীবন সায়াহ্নে এসেও তিনি মুসলমানদের সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পিছপা হননি।
তরুন নেতৃত্বে তৈরীর ক্ষেত্রে রাসূল (সা.)-এর বলিষ্ঠ পদক্ষেপ বিশ্বে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। উসামা বিন যায়েদ (রা.)-এর বয়স আঠারো থেকে বিশ বছরের মত হবে। হযরত আবু বকর ও উমর (রা.)মতো সাহাবী থাকার পরেও তাকে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করলেন যা অনেক সাহাবীরই মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে। যারা তাকে সেনাপতি মানতে আপত্তি করেছিলেন রাসূল (সা.) তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘তার পিতা যায়েদ (রা.)-কে যখন মুতার যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়েছিলো তোমরা তখন তার বিরুদ্ধেও আপত্তি করেছিলে’। রাসূল (সা.) তাদের আপত্তিতে মোটেই কর্ণপাত করেননি। হযরত আবু বকর, উমার, সা‘দ বিন আবি ওয়াক্কাস, আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ প্রমুখ প্রথম কাতারের সমর বিশারদ সাহাবীগণ এ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হলেন। আজ মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের বড়ই সংকট চলছে। যে কোন জাতির উত্থান বা পতন নির্ভর করে সে জাতির যোগ্য নেতৃত্বের ওপর। এ ক্ষেত্রে মুসলিম নেতৃত্ব তার যোগ্য উত্তরসূরী তৈরীতে বড়ই উদাসীন। যিনি একবার নেতৃত্বে সমাসীন হয়েছেন তিনি আজীবন তা ধরে রাখার চেষ্টায় থাকেন, ইল্লা মাশা-আল্লাহ। নেতৃত্ব তৈরীর ক্ষেত্রে এ জাতি কি রাসূলের অনুসরণে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে?
উসামা বিন যায়েদ (রা.)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী যাত্রা শুরু করলো। এদিকে রাসূল (সা.) অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ক্রমান্বয় রোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় মুসলিম বাহিনী যাত্রাবিরতি করে মদীনার উপকন্ঠে ‘জুুরুফ’ নামক স্থানে অপেক্ষা করতে থাকেন। ইতোমধ্যে রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকাল হলে আবু বকর (রা.) খলীফা নির্বাচিত হন। তিনি উসামাকে যাত্রার নির্দেশ দেন। বাহিনী রওয়ানা দিলে আবু বকর (রা.) কিছুদূর পর্যন্ত সাথে যান। উসামা (রা.) ঘোড়ার পিঠে আর খলীফা পায়ে হেঁটে চলেছেন। উসামা (রা.) বললেন: হে আল্লাহর রাসূলের খলিফা! আল্লাহর কসম, হয় আপনি ঘোড়ায় উঠুন, না হয় আমি নেমে পড়ি’। খলীফা বললেন, ‘আল্লাহর কসম, তুমিও নামবেনা আমিও ঘোড়ায় ছওয়ার হবো না। কিছুক্ষণ আল্লাহর পথে আমার পদযুগল ধুলায় মলিন হতে দোষ কি? তারপর উসামাকে বললেন, ‘তোমার দ্বীন, তোমার আমানতদারী এবং তোমার কাজের সমাপ্তি আল্লাহর কাছে ন্যস্ত করলাম। রাসূল (সা.) যে নির্দেশ তোমাকে দিয়েছেন, তা কার্যকর করার উপদেশ তোমাকে দিচ্ছি’। তারপর উসামার দিকে একটু ঝুকে বললেন, ‘তুমি যদি উমারের দ্বারা আমাকে সাহায্য করা ভালো মনে কর, তাহলে তাকে আমার কাছে থেকে যাওয়ার অনুমতি দাও’। উসামা আবু বকর (রা.)-এর আবেদন মঞ্জুর করলেন। অর্থাৎ উমার (রা.)-কে মদীনায় খলিফা আবু বকরের সাথে থাকার অনুমতি দিলেন। উসামা (রা.) রাসূলের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করেন। মুসলিম বাহিনী এ যুদ্ধে বিজয় লাভ করে। ফলে এ অঞ্চল থেকে মুসলমানদের জন্য রোমান ভীতি দূরীভূত হয়। সেই সাথে গোটা সিরিয়া, মিসর ও উত্তর আফ্রিকাসহ কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা মুসলমানদের বিজয়দ্বার উন্মুক্ত হয়। উসামা (রা.)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী বিজয়ী বেশে মদীনায় ফিরে এলেন। খলীফা আবু বকরসহ (রা.) মুহাজির ও আনসারদের বিরাট একটি দল মদীনার উপকন্ঠে তাকে স্বাগত জানান। ঐতিহাসিকরা তার এ বিজয় সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, ‘উসামার বাহিনী অপেক্ষা অধিকতর নিরাপদ ও গণিমত লাভকারী অন্য কোন বাহিনী আর দেখা যায়নি। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন এবং প্রখর ব্যক্তিত্বের জন্য উসামা (রা.) মুসলিম সমাজের ব্যাপক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন। বিশ্ববাসীর স্মরণে থাকা উচিত যে, মুসলিম জাতি হঠাৎ করে এ পৃথিবীতে আসেনি যে, তাদেরকে পাইকারীভাবে হত্যা করলেই তারা নির্মূল হয়ে যাবে। মুসলিমদের ইতিহাস শ্রেষ্ঠতম ইতিহাস। বহু শতাব্দীর সভ্যতার পথ ধরে মানুষকে সভ্যতা শিখাতে এসেছে এবং তা মানব ইতিহাসে সর্বোত্তম সভ্যতা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। তারা শত্রু-মিত্র, মুসলিম-অমুসলিম, সাধা-কালো, ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকলেরই অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করে। কাজেই তাদেরকে নির্মূলের ষড়যন্ত্র মানেই হচ্ছে বিশ্বে শান্তির সর্বনাশ করা।