ইসলাম মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম ভারসাম্য পূর্ণ জীবন বিধান। মানব জীবনের এমন কোন দিক নেই, যেই দিকটা ইসলাম স্পর্শ করেনি। আল্লাহর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীব হিসেবে মানুষ যেমন স্রষ্টার ইবাদত বন্দেগী করে পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করবে, তেমনি ইকহালেও সুস্থ, সুন্দর, সুখী জীবন-যাপন করে পৃথিবীকে সুখময় করে তুলবে। এটা ইসলামের শিক্ষা।
ইসলাম মানুষে মানুষে বিভেদ বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে একটি সমৃদ্ধ ও কল্যাণকর সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সম্পদ ও শ্রম বণ্টনের যে আলোকোজ্জ্বল অর্থনৈতিক নীতিমালা বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করেছে, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে মানুষের মধ্যে কোন শ্রেণী বৈষম্যের সৃষ্টি হতে পারে না।
মানুষের মধ্যে কোন শ্রেণীর বৈষম্যের সৃষ্টি হয় মূলতঃ সম্পদ বণ্টনের অসমনীতির কারণে। এর ফলে এক শ্রেণীর মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে, আরেক শ্রেণীর মানুষ দিনরাত পরিশ্রম করেও চরম দারিদ্রের মধ্যে মানবেতর জীবন-যাপন করতে বাধ্য হয়। ইসলামে যাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা এবং সম্পদ বণ্টনের বিভেদ বৈষম্যহীন নীতিমালা মানবসমাজ থেকে দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর ও ফলপ্রসু অবদান রাখতে সক্ষম।
পৃথিবীতে যুগেযুগে আল্লাহপ্রদত্ত জীবন বিধান প্রচারিত ও বাস্তবায়িত হয়েছে নবী-রাসূলের মাধ্যমে। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর মাধ্যমেই আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক মনোনীত দ্বীন ইসলামের পূর্ণতা এসেছে।
নবী-রাসূলগণই যুগেযুগে আল্লাহর দেওয়া জীবন বিধানের জীবন্ত বাস্তব নমুনা। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন মুসলিম উম্মাহর জন্য উসওয়াতুন হাসানাহ বা উত্তম আদর্শ।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। মানুষের অর্থনৈতিক জীবনও এর আওতাভুক্ত। অর্থনৈতিক জীবনের দুটি প্রধান দিক। সম্পদ উপার্জন ও সম্পদ বণ্টন। ইসলাম মানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী। অর্থনীতির ক্ষেত্রে মানুষের বিশ্বজনীন কল্যাণ নিশ্চিত করতেই ইসলামে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক বিধান দেওয়া হয়েছে।
ইসলামের সমস্ত বিধানের মূলে রয়েছে আল্লাহর প্রতি আমাদের সমস্ত কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে চূড়ান্ত জবাবদিহির ধারণা। এটাই আখেরাতে বিশ্বাসের মর্মকথা। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) কর্তৃক বর্ণিত; তিরমিযী শরীফের এক হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: কিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নে জবাব না দিয়ে আদম সন্তানের কেউ এক কদম অগ্রসর হতে পারবে না।
(এক) তার গোটা জীবন কিভাবে কাটিয়েছে,
(দুই) তার যৌবন সে কিভাবে কাটিয়েছে।
(তিন) তার ধন-সম্পদ কিভাবে অর্জন করেছে,
(চার) উপার্জিত ধন-সম্পদ সে কিভাবে ব্যবহার করেছে।
(পাঁচ) তার জ্ঞানকে সে কিভাবে ব্যবহার করেছে। দেখা যাচ্ছে, এই হাদীসে উল্লেখিত পাঁচটি প্রশ্নে মধ্যে দুটিই বর্তমান আলোচ্য বিষয় সম্পর্কিত। অর্থাৎ ধন-সম্পদ উপার্জন ও ব্যয়। এর কোনটাই যেনতেন পথে আয়-ব্যয় করলে চলবে না। করতে হবে আল্লাহর নির্ধারিত এবং রাসূল প্রদর্শিত পথে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টিতে দারিদ্র্য:
জঠর জ্বালায় অস্থির মানুষ হিতাহতি জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। অভাবে দহনে দগ্ধ হয়ে ন্যায় অন্যায় ভুলে মানুষ পাপকাজে নিমজ্জিত হয়। নারী তার জীবনে শ্রেষ্ঠ সম্পদ বিসর্জন দিতে দ্বিধাবোধ করে না। ক্ষুধার তাড়নায় বাঘিনী যেমন আপন সন্তান পর্যন্ত ভক্ষণ করে থাকে, তেমনি দারিদ্র্যের পঙ্কিলে নিমজ্জিত মানুষ ন্যায়-অন্যায় ভুলে নিজের অজান্তেই আত্মবিধ্বংসী পথে অগ্রসর হয়। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; দারিদ্র্য মানুষকে কুফরের পথে নিয়ে যায়। (বায়হাকী, ইবনু আবী শায়বা)
মানুষকে যা কুফরের দিকে ঠেলে দেয়, তা কখনই ইসলাম সম্মত হতে পারে না। কুফরের সাথে ইসলামের কোন আপোস নেই। অনুন্নত দেশসমূহে দেখা যায়, জাতীয় চরিত্রের অবনতি, মিথ্যার বেসাতি, ক্রমবর্ধমান অপরাধ প্রবণতা, এসবের অন্যতম কারণ দারিদ্র্য। আল কুরআনের ইরশাদ হয়েছে; শয়তান কসম করেছে যে, সে তোমাদেরকে দারিদ্র্যের মধ্যে নিক্ষেপ করে পাপের পথে টেনে নিয়ে যাবে। আল্লাহ ওয়াদা করেন তোমাদের তা হতে রক্ষা করতে এবং সচ্ছলতার মধ্যে রাখতে সাহায্য করতে। (সূরা বাকারা: ২৬৮)
সাধারণ মানুষদের জন্য দারিদ্র্য পাপের প্রথম পর্যায়ের। যারা চরম দারিদ্র্যতার মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে, তারা শয়তানের প্রভাববলয়ের সীমান্তে অপেক্ষা করছে, যে কোন সময় তারা শয়তানের ওয়াসওয়াসার শিকার হতে পারে।
প্রশ্ন হতে পারে দারিদ্র্যের এতসব খারাপ দিক বর্ণিত হওয়ার পরও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন দারিদ্র্যতাকেই তিনি শ্রেষ্ঠ মনে করলেন? উত্তরে বলবো; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; “দারিদ্র্যতা আমার ভূষণ, দারিদ্র্যতা আমার গৌরব” (আহমদ, নাসাঈ) কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দারিদ্র্যকে নিজের ভূষণ বলে আখ্যায়িত করেছেন, তা হলো স্বেচ্ছাপ্রনোদিত দারিদ্র্য। এ দারিদ্র্যকে তিনি নিজেই বরণ করে নিয়েছেন। বিশাল মুসলিম রাজ্যের অধিপতি হয়েও তিনি থাকতেন অভূক্ত অর্ধভূক্ত, ছিন্নবস্ত্র। পারস্য এবং রোম সাম্রাজ্যের অংশ বিশেষের সম্পদরাজি যখন তার পদতলে ভুলণ্ঠিত হচ্ছে, তখনও তিনি স্বেচ্ছায় দারিদ্র্যই বরণ করে নিয়েছেন। আরবের সবচেয়ে ধনীবতী মহিলা বিবি খাদিজা (রা.) হতে প্রাপ্ত সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। এতে তার ক্ষোভ ছিল না বরং সম্পদ বিলিয়ে দারিদ্র্য বরণ করতে তাঁর ছিলো আনন্দ।
দারিদ্র্য নিয়ন্ত্রণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম :
বিশ্বমানবের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শক নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: উপরের হাতা নিচের হাতের চেয়ে উত্তম। (বুখারী ও মুসলিম) অর্থাৎ দাতার হাত, গ্রহীতার হাত অপেক্ষা উত্তম। আরও খুলে বললে অর্থ দাঁড়ায়, যে মানুষ অপর মানুষকে টাকা-পয়সা, অর্থ-বিত্ত, খাদ্য-বস্ত্র, ইত্যাদি জীবনোপকরণ; জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রযুক্তি যা কিছু প্রদান করবে, সেই ব্যক্তিই এসব বস্তু গ্রহণকারীর তুলনায় উত্তম। এসব প্রয়োজনীয় বস্তুর দাতা-গ্রহীতা যেমন ব্যক্তি মানুষ হতে পারে, তেমনি জাতিগত, রাষ্টগত পর্যায়ের হলে তার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বই স্বীকৃত হবে গ্রহীতার দেশটির উপর, ফলে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ঐ দাতা দেশের ন্যায় রীতি-নিয়ম, যাবতীয় শর্ত ও দাবী গ্রহীতা দেশটিকে মেনে নিতে হবে। এটা করতে গিয়েই গ্রহীতা দেশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরিতাপের বিষয়, মুসলিমরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীর তাৎপর্য যথাযথভাবে উপলব্দিতে ব্যর্থ হবার কারণেই আজ তারা ব্যক্তিগত, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পৃথিবীর দাতা শক্তিগুলোর কাছে মুখাপেক্ষি। এই মুখাপেক্ষিতার সুযোগ নিয়ে এখন তারা আমাদেরকে ব্যক্তিগত, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রে অপমান ও জিল্লতীর সম্মুখীন করে তুলছে। আমরা দাতার হাতের অধিকারী হতে না পারায় আজ সর্বক্ষেত্রে পর মুখাপেক্ষি। এই কারণে ইসলাম মানুষকে অভাব থেকে রক্ষা করতে চায়। দারিদ্র্যপীড়ায় জর্জরিত জীবন থেকে রক্ষাকল্পে মহান আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের নির্দেশ করেছেন। তোমরা যখন নামায শেষ করবে, তখন আল্লাহর এই পৃথিবীতে তার প্রদত্ত রিযিকের তালাশে ছড়িয়ে পড়ো। (সূরা জুমুয়া: ১০)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভিক্ষাবৃত্তি নিষেধ করেছেন। কোন লোককে ভিক্ষা করতে দেখলে তিনি তাকে সেই অপমানকর কাজ হতে ফেরার জন্য কাজের যন্ত্রপাতি খরিদ করে দিতেন। হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: কষ্টোপার্জিত অর্থে কেনা খাদ্যই উত্তম। (বুখারী)
প্রয়োজনীয় সম্পদ ও জীবনোপকরণ না থাকলে দুস্থ মানবতার সেবায় এগিয়ে আসা যায় না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: সেই ব্যক্তি মুমিন নয়, যে নিজে পেট পুরে আহার করে আর তার প্রতিবেশী ক্ষুধায় কাতর থাকে। (তাবরানী ও বায্যার) পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য দূর করার জন্য এর চেয়ে মহোত্তম বাণী আর কি হতে পারে?
দারিদ্র্য দূর করার জন্য ইসলামে যাকাত ফরয করা হয়েছে। এই নির্দেশের অপরিহার্য দাবী হলো: সম্পদের অধিকারী হয়ে তুমি অহঙ্কারী হয়ো না, বরং মানবতার সেবা করা মুমিনের কর্তব্য। আর তা করতে হলে তাকে হতে হবে সম্পদের অধিকারী। শুধু যাকাত নয়, দারিদ্র্য দূর করার জন্যই ফিতরা ও সদকারও বিধান দেওয়া হয়েছে। দান করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জীবনে বারবার এ কথা বাস্তব করে দেখিয়েছেন। তিনি হযরত ইবরাহীমের ন্যায় দেশ-জাতি ও মানবসভ্যতার সুখ-সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের জন্য দোয়া করেছেন, এই জাগতিক জীবনে জাতির যাবতীয় সম্পদ দুর্নীতিবাজ, লম্পট, চরিত্রহীন নেতৃত্বের হাতে তুলে দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে নেতৃত্বের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার নীতি গ্রহণ করেন নি। দেশ রক্ষা, জাতি গঠন, দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, প্রচার মাধ্যম, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন কোনটাই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ লাহাব, আবূ জাহেলী নেতৃত্বের হাতে ছেড়ে দিয়ে জাতিকে অর্থনৈতিক ইয়াতীম বানানোর নীতি গ্রহণ করেননি। উম্মতকেও এমন আহমকী করার অনুমতি দেননি।
সম্পদ আল্লাহর, এ সম্পদ যেন মানবতার কল্যাণে ব্যয় হয় তার জন্যই ছিল তার অবিরাম সংগ্রাম ও সাধনা। তিনি পৃথিবী থেকে যেমন মনের দারিদ্র্য দূর করতে এসেছিলেন, তেমনি এসেছিলেন ধনের দারিদ্র্য দূর করতে।
ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর মাত্র তের বছরে তিনি তার জাতিকে এতটা সমৃদ্ধ করতে পেরেছিলেন যে, আরবে যাকাত নেওয়ার মত কোন ছিলো না। আজও তার আদর্শ গ্রহণ করলে পৃথিবী এমনি স্বাচ্ছন্দ্য ও সুখি সুন্দর হয়ে উঠতে পারে, রাসূলের আদর্শ গ্রহণের মধ্যেই রয়েছে বিশ্ব থেকে অভাব, কষ্ট ও দারিদ্র্য দূর করার একমাত্র উপায়, এ কথা আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবো, ততই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। এ ছাড়া বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য দূর করার জন্য কোন পন্থা নেই।