এক শিক্ষক ও ছাত্র
এক শিক্ষক তার সাত বছরের ছাত্র কাযিমকে জিজ্ঞেস করল, “আমি যদি তোমাকে একটি আপেল, একটি এবং আরও একটি আপেল দিই, তাহলে তোমার কাছে মোট কতটি আপেল থাকবে?”
কযকে সেকেণ্ডের মধ্যেই কাযিম আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দিল, “চারটি”।
বিস্মিত শিক্ষক আশা করেছিলেন সহজ ও সঠিক উত্তরটি (তিনটি), তিনি হতাশ হলেন। “কাযিম বোধহয় আমার কথা ঠিকমত বুঝতে পারেনি, ”তিনি মনে মনে ভাবলেন এবং আবার বললেন, “কাযিম মনোযোগ দিয়ে শোন। যদি তোমাকে একটি আপেল, একটি আপেল এবং আরও একটি আপেল দিই, তাহলে তোমার কাছে মোট কতটি আপেল থাকবে?”
কাযিম তার শিক্ষকের চোখেমুখে হতাশার ছাপ দেখতে পেল। সে আবার তার আঙ্গুলে গুণে দেখল। কিন্তু এর মাঝে সে সেই উত্তরটি খুঁজছিল, যা তার শিক্ষককে খুশি করবে। কিছুক্ষণ ভেবে দ্বিধান্বিতভাবে সে উত্তর দিল, “চার”।
শিক্ষকের চোখে মুখে হতাশা রয়েই গেল। তার মনে আসল কাযিম আম পছন্দ করে। তিনি ভাবলেন কাযিম আপেল পছন্দ করে না, আর এটি হয়তো তার মনোযোগ নষ্ট করছে। এবার গুরুত্ব সহকারে ও সামান্য হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি যদি তোমাকে একটি আম, একটি আম এবং আরও একটি আম দিই, তাহলে তোমার কাছে মোট কতটি আম থাকবে?”
শিক্ষকের খুশি খুশি ভাব দেখে কাযিম আবার তার আঙ্গুলে গুণে দেখল। সে কোন চাপ অনুভব করল না এবার, বরং চাপে থাকল তার শিক্ষক। কারণ, তিনি চাইছিলেন তার এবারের প্রচেষ্টাটি সফল হোক।
মুখে সামান্য দ্বিধার হাসি নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কাযিম উত্তর দিল, “তিনটি?”
এবার শিক্ষকের মুখে জয়ের হাসি দেখা দিল। তার প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। কিন্তু একটি কাজ এখনও বাকি। তিনি আবার কাযিমকে জিজ্ঞেস করলেন, “এখন আমি যদি তোমাকে একটি আপেল, একটি আপেল এবং আরও একটি আপেল দিই, তাহলে তোমার কাছে মোট কতটি আপেল থাকবে?”
অনুরোধের সুরে কাযিম উত্তর দিল, “চারটি”
শিক্ষক আবার বিস্মিত এবং হতাশ হয়ে পড়লেন। সামান্য বিরক্ত কণ্ঠে তিনি জানতে চাইলেন, “কীভাবে কাযিম?”
মৃদু কণ্ঠে কাযিম জবাব দিল,“কারণ আমার ব্যাগে আগে থেকেই একটি আপেল আছে।”
গল্পের শিক্ষাঃ যখন আপনাকে কেউ কোন ব্যাপারে উত্তর দেয় আর সেটা আপনার আশা করা উত্তরের সাথে না মিলে, তবে ভাববেন না সেটা ভুল। কারণ, তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আপনি হয়তো ব্যাপারটি ভেবে দেখেননি। তাই প্রতিটি ব্যাপারে আগে মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং বোঝার চেষ্টা করুন, তবে অবশ্যই পূর্বনির্ধারিত ধারণা বা বিশ্বাস নিয়ে নয়। (একটি ইংরেজি গল্পের অনুকরণে)
প্রচণ্ড রাগী এক ছেলে
খুব ছোট্ট এক ছেলে প্রচণ্ড রাগী ছিলো। তার বাবা তাকে একটা পেরেক ভর্তি ব্যাগ দিল এবং বললো যে, যতবার তুমি রেগে যাবে ততবার একটা করে পেরেক আমাদের বাগানের কাঠের বেড়াতে লাগিয়ে আসবে। প্রথমদিনেই ছেলেটিকে বাগানে গিয়ে ৩৭ টি পেরেক মারতে হলো। পরের কয়েক সপ্তাহে ছেলেটি তার রাগকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলো এবং প্রতিদিন কাঠে নতুন পেরেকের সংখ্যাও ধীরে ধীরে কমে এলো। সে বুঝতে পারলো হাতুড়ী দিয়ে কাঠের বেড়ায় পেরেক বসানোর চেয়ে তার রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক বেশি সহজ। শেষ পর্যন্ত সেই দিনটি এলো যেদিন তাকে একটি পেরেকও মারতে হলো না। সে তার বাবাকে এই কথা জানালো। তারা বাবা তাকে বললো, এখন তুমি যেসব দিনে তোমার রাগকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে সেসব দিনে একটি একটি করে পেরেক খুলে ফেলো। অনেক দিন চলে গেল এবং ছেলেটি একদিন তার বাবাকে জানালো যে সব পেরেকই সে খুলে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। তার বাবা এবার তাকে নিয়ে বাগানে গেল এবং কাঠের বেড়াটি দেখিয়ে বললো, তুমি খুব ভালভাবে তোমার কাজ সম্পন্ন করেছো, এখন তুমি তোমার রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারো কিন্তু দেখো, প্রতিটা কাঠে পেরেকের গর্তগুলো এখনো রয়ে গিয়েছে। কাঠের বেড়াটি কখনো আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। যখন তুমি কাউকে রেগে গিয়ে কিছু বলো তখন তার মনে ঠিক এমন একটা আচড় পরে যায়। তাই নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখো। মানসিক ক্ষত অনেক সময় শারীরিক ক্ষতির চেয়েও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।
এক কৃষক ও তার গাধা
একদিন এক কৃষকের গাধা গভীর কুয়ায় পড়ে গেলো। গাধাটা করুণ সুরে কেঁদে কৃষকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালাতে লাগলো। কৃষক ভাবলো, যেহেতু গাধাটা বৃদ্ধ হয়ে গেছে, কাজেই একে উদ্ধারের ঝামেলায় না গিয়ে মাটি ফেলে কুয়ার মাঝেই কবর দিয়ে ফেললেই ল্যাঠা চুকে যায়। কাজেই কৃষক শাবল দিয়ে মাটি ফেলতে লাগলো গাধার ওপর। প্রথমে গাধা ঘটনা আঁচ করতে পেরে চিৎকার করে গলা ফাঁটিয়ে কাঁদতে লাগলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সব শান্ত হয়ে গেলো। কৃষক এই নীরবতার কারণ উদ্ঘাটন করতে গিয়ে কুয়ার ভিতর উঁকি দিয়ে অবাক হয়ে গেলো। প্রতিবার যে-ই গাধাটার ওপর মাটি ফেলা হয়েছে, সে তা পিঠ ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিয়ে সেই মাটিকে ধাপ বানিয়ে একধাপ একধাপ করে বেশ খানিকটা উপরে উঠে এসেছে। এটা দেখে কৃষক আরো মাটি ফেললো এবং পরিশেষে গাধাটা বের হয়ে আসলো কুয়া থেকে।
শিক্ষা : জীবনে আপনার ওপর শাবল ভর্তি মাটি ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। আপনার কাজ হচ্ছে সেই চাপা দেয়া মাটিকেই কাজে লাগিয়ে উপরে উঠা। প্রতিটি সমস্যাই আসলে সমাধানের একটি করে ধাপ, যদি আপনি তা কাজে লাগানোর মতো ইতিবাচক হয়ে থাকেন। যেকোন সুগভীর কুয়া থেকেই মুক্তিলাভ সম্ভব, যদি না আপনি হাল ছেড়ে দেন। [সংগৃহীত]
এক খেয়ানতকারী ও ইমাম হুসাইন (রা) এর বিচারকার্য
কাফেলা রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত। উটদের চিৎকার এরই জানান দিচ্ছিল। শহরের অধিবাসীরা এই শব্দের অর্থ জানে। মদিনার আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চল হতেও অনেক সফরের প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র নিয়ে কাফেলার উদ্দেশ্য রওনা হল। কেউ ঘোড়ায় চড়ে, কেউ উটের পিঠে, আবার কেউ পায়ে হেটে। যার যেটা ছিল সেটা নিয়েই তারা বেরিয়ে পড়লো, উদ্দেশ্য একটাই; কাফেলার সাথী হওয়া। তাদের সবারই জানা যে, একটি লম্বা সফর তাদের সামনে রয়েছে। নতুন যাত্রীরা সংযুক্ত হওয়ার সাথে সাথে কাফেলার রূপ বৃহদাকার ধারণ করতে লাগলো এবং মদিনাকে পিছনে ফেলে কাফেলা প্রাণহীন মরুর বুক চিরে গন্তব্যের দিকে এগুতে থাকলো। হুসাইন (রা.) ও উক্ত কাফেলায় যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর সাথে একটি ঘোড়া থাকা সত্ত্বেও তিনি ঘোড়ার লাগাম ধরে পায়ে হাটছিলেন। কাফেলা আল্লাহর ঘর যেয়ারত করার উদ্দেশ্যে শহর ত্যাগ করেছিল। কয়েকদিন আরবের মরু রাস্তা অতিক্রম করার পর অবশেষে মক্কার নিকটবর্তী হল। কোনরকম দুর্ঘটনা ছাড়াই এই রাস্তা অতিক্রম করায় যাত্রীরা খুবই খুশি। সে জন্যে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করল। কাফেলার যাত্রীরা কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর যেয়ারাতের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করলেন। তারা একই রঙ্গের “ইহরামের” পোশাক পরিধান করলেন যাতে করে সাতবার আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ করতে পারেন। কা’বা মাসজিদুল হারামের উঠানে অবস্থিত এবং মসজিদুল হারামের চতুর্দিক ছোট ছোট টিলা দ্বারা ঘেরা। বেশ কিছু আশ্চার্যজনক জিনিস সেখানে ছিল। “যমযম” কুপ যা ঐ লবনাক্ত মরুর মাঝেও যুগযুগ ধরে যেয়ারতকারীদের মিষ্টি পানি দান করে আসছে এবং একটি পাথর যার ওপর ইবরাহিমের (আ.) পায়ের ছাপ এখনো পরিলক্ষিত হয়। পুরুষেরা একদিকে এবং মহিলারা অপরদিকে, প্রজাপতিদের মত কা’বার চারপাশে তাওয়াফ করছিলেন। এমন সময় এক মহিলা অনুভব করলো যে, একজন অপরিচিত পুরুষ তার হাতে চাপ প্রয়োগ করছে। সে আল্লাহর ঘরের নিকট এই ধরণের নোংরা কাজে খুবই রাগান্বিত হল এবং সেই খেয়ানতকারী ব্যক্তিটিকে বলল- কেন আল্লাহর ঘরের সম্মান নষ্ট করেছো এবং একজন মুসলমানের সম্ভ্রমে খেয়ানত করেছো। লোকটি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চাইল নিজের হাতটি টেনে নিতে কিন্তু কোন লাভ হল না কেননা লোকটির হাত মহিলার হাতের সাথে জোড়া লেগে গিয়েছিল। তারা উভয়েই হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু কোন লাভ হল না। যেসব যেয়রতকারীদের তাওয়াফ শেষ হয়ে গিয়েছিল তারা এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। ঐ খেয়ানতকারী লোকটিকে গ্রেফতার করে তৎকালীন শাসকের নিকট নিয়ে যাওয়া হল। কেউ কেউ বলছিল লোকটিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া উচিৎ। আবার কেউ কেউ বলছিল তার হাত কেটে ফেলা হোক। সবাই কিছু না কিছু বলছিল। শাসক সকল বিচারকদেরকে রাজপ্রাসাদে এসে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। ঘোষণাকারী সমস্ত অঞ্চলে শাসনকর্তার নির্দেশ ঘোষণা করে দিল। কিছুক্ষণ পরেই শাসনকর্তার প্রাসাদে সবাই প্রবেশ করল। শাসনকর্তা বিচারকদের উদ্দেশ্যে বলল ঐ খেয়ানতকারী ব্যক্তিটির বিরুদ্ধে হুকুম জারী করতে। শহরের বিচারকগণ অনেক চিন্ত-ভাবনা শলা-পরামর্শের পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, খেয়ানতকারী লোকটির হাত কেটে ফেলা হোক। বিচারকদের রায়ে শাসনকর্তা তুষ্ট হল না এবং গভীর চিন্তায় মগ্ন হল। হঠাৎ কিছু একটা তার মাথায় আসল এবং রক্ষীদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন- হুসাইন কি এই শহরেই আছে? রক্ষীগণ বলল, জ্বি তিনি গতরাতে শহরে প্রবেশ করেছেন। শাসনকর্তা বললেন- সেই সর্বোত্তম ব্যক্তি যে এই বিষয়ের বিচার করতে ও সমাধান দিতে পারবে। সাথে সাথে এ বিষয়ে তাঁর মতামত জানার জন্য একজন লোককে প্রেরণ করা হল। হুসাইন (রা.) যখন ঘটনা সম্পর্কে অবগত হলেন, আল্লাহর ঘরে গেলেন এবং আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন তারপর শাসকের প্রাসাদে গেলেন। তিনি কি বিচার করেন এটা দেখার জন্য তখনও সবাই অপেক্ষা করছিল! হুসাইন (রা.) উক্ত পুরুষ এবং মহিলার দিকে একবার দৃষ্টি দিলেন এবং অতি নিম্নস্বরে ঠোঁটের কোণে কিছু একটা বললেন এবং হঠাৎ করে লোকটির হাত মহিলার হাত হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। শাসনকর্তা খুশি হয়ে হুসাইন (রা.)-কে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন: এখন যে শাস্তিই আপনি এই লোকটির জন্য ধার্য করবেন আমি নির্দেশ দেব সেটা পালন করার জন্য?
তিনি বললেন : কোন শাস্তি দেবার প্রয়োজন নেই তাকে ছেড়ে দাও সে যেখানে খুশি চলে যাক। তার জন্য শাস্তি এটাই যথেষ্ট যে, তার সম্মান মানুষের সামনে নষ্ট হয়েছে। হ্যাঁ, যে ব্যক্তি পায়ে হেটে যেয়ারতে আসে আল্লাহও তার দোয়া এভাবেই কবুল করেন।