প্রতিটি মানবশিশু আল্লাহ তায়ালার একত্বের পূর্ণ পরিচয় নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করে। হক গ্রহণ করার এবং তাওহিদ ও রিসালাতের প্রতি ঈমান আনার স্বভাব-যোগ্যতা প্রতিটি মানবশিশুর মধ্যে জন্মগতভাবেই থাকে। হোক সে মুসলিম পরিবারের শিশু কিংবা অমুসলিম পরিবারের। পরে বাবা, মা-ই নিষ্পাপ শিুশুর এই স্বভাব-যোগ্যতা বিনষ্ট করে তার সর্বনাশ করে। তাকে ইহুদি, খ্রিষ্টান ও নাস্তিক বানায়। এ ব্যাপারে রাসূলে কারিম সা: হাদিস শরিফে এরশাদ করেন, ‘প্রতিটি শিশুই ফিতরাত তথা ইসলাম গ্রহণের যোগ্যতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তারপর তার বাবা-মা তাকে ইহুদি, খ্রিষ্টান অথবা অগ্নিপূজক বানায়’ (মিশকাত পৃ : ২১)।
সুতরাং বোঝা গেল, সুন্দর ও ইসলামী চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার স্বাভাবিক প্রেরণা প্রতিটি শিশুর মধ্যে থাকে। শিশুর বাবা-মা যদি সুশিক্ষা ও সুপরিচর্যার মাধ্যমে তাকে গড়ে তুলতে পারেন, তবে তার মধ্যে অনুপম চরিত্রের বিকাশ ঘটে। সে হয় একজন খোদাভীরু ও নেককার সন্তান। একজন আলোকিত মানুষ। পৃথিবীর এই মানববাগানে সে ফুল ফোটায়, আলো ছড়ায়। আবার এই কোমলমতি শিশুই সুশিক্ষা ও সুপরিচর্যার অভাবে কিংবা ধর্মহীন পরিবেশে বড় হওয়ার কারণে একসময় সে হয়ে ওঠে চরম ইসলামবিদ্বেষী কিংবা অতি ধর্মনিরপেক্ষবাদী। তার আচার-আচরণে, ধ্যানধারণায় ইসলামের কোনো স্বভাব আর থাকে না। সুতরাং শিশুর বিপথগামী হওয়ার পেছনে তার বাবা-মা প্রধানত দায়ী। বাবা-মা যদি ইসলামবিদ্বেষী হয় কিংবা ইসলামবিদ্বেষী শিক্ষকের হাতে তার শিক্ষাদীক্ষার দায়িত্বভার অর্পণ করেন, তবে সে তাদের অনুগামী হিসেবে ইসলামবিদ্বেষী হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই হাদিসে বলা হয়েছে, ‘বাবা, মা-ই তাকে ইহুদি, খিষ্টান কিংবা অগ্নিপূজক বানায়।’
আমাদের এ কথা মনে রাখতে হবে যে, সন্তান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক বিশাল নেয়ামত। আল্লাহ তায়ালা এ নেয়ামত সবাইকে দান করেন না। পৃথিবীতে এমন অনেক লোক রয়েছে, যারা হাজার চেষ্টা ও সাধনা করেও সন্তান লাভ করতে পারেন না। তাদের সম্পদের অভাব নেই, কিন্তু তা ভোগ করার কোনো আপনজন নেই। আবার অসংখ্য লোক এমন আছে যারা কামনা না করেও বহু সন্তানের জনক হন। বোঝা গেল, সন্তান আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ। তিনি যাকে ইচ্ছা এই অনুগ্রহ দান করেন। যাকে ইচ্ছা বঞ্চিত করেন। এখানে মানুষের কোনো হাত নেই, ইচ্ছামতো সন্তান জন্মানোর ক্ষমতা তার নেই। এ ক্ষেত্রে মানুষ বড় অসহায়, আল্লাহ তায়ালা কুরআন কারিমে ইরশাদ করেন, ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর আধিপাত্য আল্লাহ তায়ালার। তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন, অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তাকে বন্ধ্যা। তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান’ (সূরা শুরা : ৪৯-৫০)।
ইসলামে শিশুর উপযুক্ত পরিচর্যার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটি বাবা-মায়ের ওপর তাদের সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে নেককার সন্তান হিসেবে গড়ে তোলা প্রধান দায়িত্ব। ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের মাঝে নৈতিকতাবোধ জাগিয়ে তোলা এবং ইসলামী অনুশাসন মেনে চলতে বাধ্য করা বাবা-মায়ের অবশ্য কর্তব্য। শিশু পরিচর্যার দু’টি দিক রয়েছে। এক. শারীরিক পরিচর্যা, অর্থাৎ উপযুক্ত খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে শিশুর প্রতি যত্ম নেয়া। দুই. মানসিক পরিচর্যা, অর্থাৎ শিশুর দৈহিক সুস্বাস্থের পাশাপাশি তার মানসিক পরিপক্বতা বৃদ্ধি করা, তার মনমানস ও চরিত্র গঠনে চেষ্টা করা, দৈহিক খাদ্যের পাশাপাশি তাকে চিন্তার খোরাক দেয়া। আমরা আমাদের সন্তানকে কত কিছু শেখাই! তাদের পেছনে কত শ্রম ব্যয় করি! কিন্তু তাদের ফরজ ইলমটুকু শেখাই না। আমাদের সন্তানেরা দেশ-বিদেশের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চশিক্ষায় ডিগ্রি অর্জন করে; কিন্তু কুরআন শরিফের বিশুদ্ধ তেলাওয়াতটা তারা জানে না। নামাজ-রোজার সঠিক পদ্ধতিটা তারা জানে না। অনেক পরিবারে তো ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে রীতিমতো বিরূপ ধারণা দেয়া হয় এবং সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলা হয়। যার ফলে আমাদের সন্তানেরা নৈতিক শিক্ষা থেকে সব সময়ই বঞ্চিত থাকে। বড় হয়ে তারা অনৈতিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে। শিশুর প্রথম পাঠশালা হলো তার পরিবার। বাবা-মা হলেন তার প্রথম শিক্ষক। বাবা-মায়ের চলন-বলন, কর্ম-বচন হলো তার পাঠ্যবিষয়। তবে শিশুর নৈতিকতা বিকাশে বাবার চেয়ে মায়ের ভূমিকাই বেশি। কারণ শিশুরা বাবার চেয়ে মায়ের সান্নিধ্য বেশি পায়। তাই আদর্শ মা-ই উপহার দিতে পারেন আদর্শ সন্তান। সুতরাং সন্তানকে আদর্শবান বানাতে হলে প্রথমে বাবা-মাকে আদর্শবান হতে হবে। তারপর পরিবারকেও আদর্শ পরিবার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।